অহিদুল ইসলাম

২৩ জুন, ২০১৬ ১১:৩৮

‘তোকে যে আমরা সবাই কত ভালবাসি তা জানাতে পারলাম না’

আমাদের রিপন মরে গেছে। তোকে যে আমরা সবাই কত ভালবাসি তা জানাতে পারলাম না।

আলী হোসেন রিপন। অসাধারণ মেধাবী এক ছবির কারিগর। এই মাত্র আমরা তাকে রেখে এলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালের হিমঘরে। সাধারণ ম্যালেরিয়ায ছেলেটা মরে গেল।

বান্দবানের গহীন বনে না খেয়ে থাকা আদিবাসীদের কথা সারা দেশের মানুষকে জানাতে গিয়েছিল রিপন। তাদের মুখে যেন সরকারের সহায়তা পৌঁছায়। সেই সংবাদ প্রচারের পর আদিবাসীদের ঘরে খাবার পৌঁছায়। আর রিপন আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলো।

অফিসে কয়েক দিন আগে দেখা হলো। হেই ম্যান কি অবস্থা? জানতে চাইলাম আমি। রিপন বললো, শরীর ভাল না, জ্বর। অফিসে ঝিমাইতাছেন কেন? ছুটি নিয়ে রেস্ট করেন। জ্বরের ভাইরাস অফিসে ছড়াইতাছেন? রিপন হাসে।

“অফিস কি ছুটি দিবো ভাই”। দিবে না কেন? বলবেন অসুস্থ, আসতে পারবেন না। বছরে ২০ দিন অসুস্থতার ছুটি পাবেন। ছয় মাস চলে গেছে। কোনো দিন অসুস্থতার ছুটি নিয়েছেন? ছুটি নেন। বাসায় গিয়ে রেস্ট করেন। আমি আমার মতো করে বলেছিলাম রিপনকে। রিপন আবার শুধু হাসলো।

আর খোঁজ নেয়া হয়নি রিপনের। কি অবস্থা? জ্বর কমলো? না বাড়লো? কিছুই না। আবার যখন জানতে পারলাম রিপনের জ্বরের কথা, ততক্ষণে ম্যালেরিয়ার ভাইরাস রিপনের মস্তিস্ক, ফুসফুস সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ কুইনাইন খেলেই রিপন আমাদের মাঝেই থাকতো। আহারে রিপন, কি করলি রে তুই?

আর আমাদের অফিসগুলোতেও শারিরিক বা মানসিক সামান্য যন্ত্রণার কথা বলা ও তা থেকে সহানুভূতি পাওয়ার একটা বড় জায়গা থাকা দরকার।

রিপনের সাথে আমার পরিচয় একাত্তর টেলিভিশনেই। এক দেখাতেই ওর চেহারা মুখস্ত হযে গিয়েছিল। ওর বিশেষ সাদা রঙ্গের চোখের কারণেই মিষ্টভাষী রিপনকে মনে রাখা যায় হাজারো মানুষেরে মাঝে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্ট বা আইসিএফজে এর একটি ফেলোশীপে আমার একটি নিউজ সেরা পুরস্কার পেয়েছিল ২০১৪ সালে। ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া মানুষদের নিয়ে করা নিউজটিতে কাজ করেছিল রিপন। সেই নিউজের সূত্র ধরে আইসিএফজে সাথে আমার গভীর সখ্য গড়ে ওঠে।আমি নানান ভাবে উপকৃত হয়েছি এবং হচ্ছি। এই সেদিনও আইসিএফজের হয়ে ভারতে সাংবাদিকদের একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামে অনুবাদের কাজ করে দিলাম।

প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফরের সংবাদ সংগ্রহের পিএম বিটের নিয়মিতরা না থাকায় প্রক্সি দিতে আমার সঙ্গী হয়েছিল রিপন। দুই রাত আমরা এক রুমে ছিলাম। একজন মানুষের রুচিবোধ, মানবিকতা, দক্ষতা আর প্রচণ্ড কাজের প্রতি ভালবাসা টের পেয়েছিলাম আমি। এতো মমতা আর যত্ন নিয়ে কাজ করতে আমি খুব কম ক্যামেরাম্যানকেই দেখেছি।

তখন থেকেই রিপনকে আমি ও মাহাবুব স্মারক ভাই প্রধানমন্ত্রীর বিটে পাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম বারবার। রিপন প্রধানমন্ত্রীর বিটে কাজ করতে চায়নি। “প্রধানমন্ত্রীর বিটে ক্যামেরায় ক্রিয়েটিভ কিছু করার সুযোগ নেই”, এই বলে বারবার এড়িয়ে গেছে রিপন। ও শুধু চাইতো মানুষ আর প্রকৃতির চিত্রধারণ করতে। নিজের তোলা চলোচ্ছবিগুলো প্যানেলে এসে আবার দেখতো। পিছনে বসে থেকে এডিটিং দেখতো। ভিডিও এডিটিং এ রিপন ছিল সমান পারদর্শী। তাই ছবি তোলায় পরিমিত বোধ আর কারিগরি দক্ষতা অসম্ভব রকমের ছাপ ছিল রিপনের কাজগুলোতে।

এ জন্যই ভারতের নির্বাচন কভার করতে শামিম আল আমিন ভাই একজন ভালো ক্যামেরাম্যান চাইলে আমরা রিপনের নাম প্রস্তাব করি। কাজের ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস শামিম ভাই এসে উচ্ছসিত প্রশংসা করে রিপনের। নেপালে ভূমিকম্প কভার করতে ফারজানা রূপা আপার সঙ্গী হয় রিপন। রাশভারি বায়জিদ মিল্ক ভাইও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের কর্মকান্ড দেখতে আফ্রিকাতে নিয়ে যায় রিপনকে।সেনা সদস্যরা তেমন সময় না দিলেও অসীম দক্ষতায় ফটাফট ছবি তুলে এনেছিল রিপন। ছিল আমাদের সবার নির্ভরতার নাম।

অসম্ভব মেধাবী ও পরিশ্রমি একটি ছেলে হারিয়ে গেলো অবহেলায়।

একটাই অফসোস থেকে গেলো রে রিপন, তোকে যে আমরা সবাই কত ভালবাসি তা জানাতে পারলাম না!

লেখক : অহিদুল ইসলাম, রিপোর্টার, একাত্তর টেলিভিশন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত