সেজুল হোসেন

২৯ জুন, ২০১৬ ২২:৪২

হিরো আলমের চেয়েও যোগ্যতাসম্পন্ন আপনি?

আমরা যারা ঢাকায় থাকি জন্মেছি অজপাড়া গাঁয়ে। নানাভাবে ঢাকায় এসে থিতু হয়েছি। নাগরিক ভাবে ধূর্ত হয়েছি, কৌশলী হয়েছি আর চালাক ও চতুরতায় পারঙ্গমতা অর্জন করে চলেছি। ঠকছি আর ঠকাচ্ছির ভিতর দিয়ে ভুলে যাচ্ছি শিকড় ও বেড়ে ওঠার সারল্য-সহজতা।

নায়ক-নায়িকাকে এক পলক দেখবে বলে এফডিসির গেইটে অনেক মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মনে মনে সে কল্পনাও করে ‘যদি আমি এমন হতে পারতাম।’ গ্রামে ফিরে গিয়ে গল্প করে। আরও একবার ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত সেই গল্প চলতে থাকে। ছোটবেলায় গ্রামে অনেককেই দেখতাম মারামারি করলে সিনেমার ফাইটিং দৃশ্যকে নকল করছে। নিজেকে নায়ক ভাবতে কার না ভালো লাগে।

যে ব্যক্তি গান জানে না সেও গান গাওয়ার কথা ভাবে। প্রতিযোগিতায় সাহস করে নাম লেখায়। আমিতো ছোটবেলা এক ছেলের কণ্ঠে বাউল গান শুনে বড় হয়ে বাউল শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখতাম।

বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামেই এমন লোক থাকে যারা মিডিয়াতে কাজ করতে চায়। কিন্তু সেই কাজে তার কোনও প্রশিক্ষণ নেই, পড়াশোনা নেই, সুযোগ নেই। এসব কাজ কিভাবে হয় তা জানে না বলে স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যায়। তবে জীবন যাপনে মনে মনে কাউকে না কাউকে সে কল্পনা করে। নিজে হয়তো মাছ ধরে, কৃষি কাজ করে কিন্ত চুল কাটে ওই নায়কের চুলের স্টাইলে। হাঁটাচলাও নকল করে।

গত কদিনে ফেসবুকে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তির নাম হিরো আলম। পুরো নাম আশরাফুল আলম। ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের সাথে বেড়ে ওঠা আলমকে অভাবের কারণে আরেক পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বাবা-মা। সেই আলম নিজের ভিতরের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন। বিয়ে করেছেন। দুটি সন্তানও আছে। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা আলম সিডি বিক্রি করতেন। সিডি যখন চলছিল না তখন বগুড়ার এরুলিয়া গ্রামে শুরু করেন কেবল নেটওয়ার্ক ব্যবসা।

চুরি করেননি, ডাকাতি করেননি, মন্ত্রীর ছেলের মতো ঢাকায় ইয়াবা কারখানা খুলেননি। নিজে আর্থিক ভাবে স্বচ্চল হবার পর সুপ্ত বাসনার বাস্তবায়ন করতে নিজে নিজেই বিভিন্ন শিল্পীর গানের সঙ্গে নেচে গেয়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়েছেন। সেটা প্রচার করেছেন নিজের কেবল নেটওয়ার্কে, নিজ গ্রামে। মানুষ সেটা দেখে আনন্দ পেয়েছে। উৎসাহ দিয়েছে। শুধু তাই নয় সাহস করে আলম দুটি নাটকও বানিয়েছেন। সেই নাটকও এলাকায় প্রচার করে খেটে খাওয়া মানুষকে বিনোদন দিয়েছেন।

না, আলম এই নাটক বা মিউজিক ভিডিও নিয়ে ঢাকায় এসে সিনেমা হলে চালাতে চাননি। নিজে মডেল হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাই সাহস করে নিজেই নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এতে আপনার আমার বিনোদিত হবার কিছু নাই।

গত কয়দিন ধরে এটাকে বিনোদন উপকরণ ধরে নিয়ে যারা মজা নিচ্ছেন তারা নিজেরা কি আলমের চেয়েও বেশি যোগ্যতাসম্প্ন্ন? আলমকে নিয়ে মশকরা করছেন এমন অনেক ডিরেক্টরকে চিনি যারা ফিল্মকে ‘ফ্লিম’ বলেন। ভুঁয়া গল্প, ভুঁয়া এ্যাকটিং, ফালতু প্রডাকশন নির্মাণকারী অনেকেই যারা চাকচিক্য দেখান নিজেদের প্রডাকশনে, সারবস্তু কিছুই নাই জিনিস বানান কোটি টাকা খরচ করে তারা বেশ মজা পাচ্ছেন হিরো আলমকে নিয়ে।

অথচ একটা লোক কোনও রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই, কোনও সহযোগিতা ছাড়াই নিজের ইচ্ছেতে ক্যামেরার সামনে যে ভাবে ফ্রেন্ডলি নাচলো, গাইলো আর অভিনয় করলো তার ইচ্ছা শক্তিকে সম্মান করা উচিৎ ছিল আমাদের।

কিঞ্চিত অডিও ভিজুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ জেনেও আমি ইউটিউবে হিরো আলমের পারফর্মেন্স দেখে সাহস সঞ্চয় করি। শিখি ক্যামেরার সামনে নার্ভাস না হওয়া।

গতকাল আলম ঢাকায় এসেছেন। অনেকেই তাঁর ইন্টারভিউ করেছে। ইউটিউবে ভিডিও দেখেছি। এত সহজ সরল ও ভালোমানুষ তিনি, ভিতরের চোখে দেখলেই বুঝতে পারবেন। কথায় কথায় ঘামছিলেন। একটু ভয়ও পাচ্ছিলেন। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলছিলেন তার স্বপ্ন পূরণের গল্প। এলাকার মানুষ তাকে ভালোবাসে। জানালেন ঢাকা থেকে অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। একবারের জন্যও আলম বুঝে উঠতে পারছেন না ঢাকার নাগরিক মূর্খূগুলো তাকে নিয়ে আয়োজন করে মজা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

আরেকটা কথা- আলমের চেহারা কালো, দাঁত উঁচু নিয়ে যারা মন্তব্য করেন তারা নিজেদের তলানীর খবর রাখেনতো? কোথায় কার কাছ থেকে কে কিভাবে কিসের বিনিময়ে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন এসব গল্প কিন্তু এখন মানুষ জানে। 

আলম ‘ভয়াবহ ভুল’ বানানে আপডেট দিচ্ছেন। আলমের দাবি- তাকে নিয়ে মজা করতেই কেউ কেউ এই ফেক আইডিগুলা খুলেছে। যদি ফেক নাও হয় তবু তার এই ভুল বানানের জন্য তাকে পরামর্শ না দিয়ে, তার ভুলটাকে ধরিয়ে না দিয়ে তাচ্ছিল্য করে নিজেকে কি ছোট করছি না আমরা?

অনেক বড় শিক্ষিত লোকদেরও দেখেছি- অভ্রতে ২০ টা শব্দ লিখলে ১৩ টা শব্দ ভুল হয়।

আর, একটা দুইটা নাটক বানিয়ে, একটা দুইটা নাটকের একটা দুইটা সিকোয়েন্সে অভিনয় করে, মডেল হয়ে, যারা নিজেদের মিডিয়া পার্সোনালিটি ভাবতে শুরু করেছেন, নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে আপনি কি নিশ্চিত?

প্লিজ হিরো আলমকে তার মতো কাজ করতে দিন। তার জীবন তার মতো করে এনজয় করতে দিন। শক্তির কবিতাকে একটু ঘুরিয়ে বলি- কারো অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে মশকরা করবেন না, কেননা কোনও না কোনওভাবে আপনিও সেই মশকরার যোগ্য’।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত