আফসানা বেগম

১১ আগস্ট, ২০১৬ ১২:২৬

আমাদের জীবন কয়লা দিয়ে ময়লা হয়ে গেল!

পলিথিন যখন প্রথম বেরোলো, অবাক হয়েছিলাম, ওজনবিহীন একটা ব্যাগে এত ওজন নেয়া যায়! ধীরে ধীরে সমস্ত ড্রেন, মাটির স্তর ভরে গেল পলিথিনে। চোখের সামনেই দেখলাম পৃথিবীতে প্রথম এদেশে পলিথিন বাতিল হলো, তারপরও বাজারে গেলে পলিথিনের ব্যাগ পাই। নির্বাচনের সময়ে দেখলাম মেয়র এবং সম্ভাব্য মেয়রদের পোস্টার বাতিল পলিথিনে মোড়ানো, পতপত করে বাতাসে উড়ছে। পলিথিনের অস্তিত্ব সবখানে দেখেও আমি প্রতিবাদ করিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে টেক্সটাইল আর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে গলগল করে রঙিন বর্জ্য বেরোতে দেখেছি। একেকদিন একেক রঙ; শীতের ধূসর প্রকৃতিতে উজ্জ্বল রঙের স্রোত পাশের নদীতে গিয়ে মিশছে। বাসের জানালায় মাথা বাড়িয়ে ভেবেছি, মাছদের কী হবে এই রঙ খেলে, জলজ উদ্ভিদদেরাইবা কী করে বাঁচবে, আর যারা ওই নদীর পানি কোনো কাজে ব্যবহার করে, তাদের? কিন্তু ভাবনাটা ওই পর্যন্তই। তখন পত্রিকায় পড়েছি শিল্প বর্জ্যের কারণে বংশী আর তুরাগ নদীর পানি দূষণের কথা। মনে মনে ‘আহা রে’ বলে পাতা উল্টেছি, দেশে শিল্পের উন্নয়ন হচ্ছে, কর্মসংস্থান বাড়ছে, এত এত ভালো হচ্ছে... আমি প্রতিবাদ করিনি।

জৈব সারের ব্যবহার নেই, বড়ো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক সারের বাজারে পরিণত হয়েছে দেশ। রাসায়নিক সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষককে খুশি করা হচ্ছে। এদিকে, তিন বছরের চেষ্টাতেও জৈবসার কারখানা স্থাপনের একটা ছাড়পত্র বের করা গেল না। কৃষিভিত্তিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছি বলে মাটির ভয়াবহ ক্ষতি দেখে আসছি বছরের পর বছর। হাইব্রিড ফসল হচ্ছে, ফলন বাড়ছে, কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি হচ্ছে; ওদিকে মাটির উর্বরতা মৃতপ্রায়, সার ধুয়ে পুকুরে যাচ্ছে, মাছও সেই রাসায়নিক খাচ্ছে, দেখেছি কিন্তু প্রতিবাদ করিনি।

ছোটোবেলার স্মৃতিময় বুড়িগঙ্গায় একদিন পরিবারসহ বেড়াতে গিয়ে রাসায়নিক বর্জ্য আর পচা পানির গন্ধে কোনোরকমে পালিয়ে ফিরে এসেছি। মনে মনে ভেবেছি, আশেপাশের লোকজন থাকে কীভাবে এর মধ্যে! কিন্তু পালিয়ে দুর্গন্ধ সীমার বাইরে ফেরার পরে আর কি আমি প্রতিবাদ করেছি?

বিদ্যুতের প্রয়োজনে হাই ভোল্টেজ তারগুলো বাড়ির জানালার কয়েক ফুট দূর দিয়ে চলে গেল। নিয়ম না মেনে কাভারড তারের জায়গায় সেখানে লাগানো হলো ন্যাকেড তার। এখন কদিন পরপর বিদ্যুৎ কোম্পানি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নির্বিচারে রাস্তার ধারের বিশাল মেহগিনি গাছের ডালপালাগুলো কেটে দিয়ে যায়, তারপরেও কাক মরে ঝুলে থাকে, কার কী আসে যায়! কখনো মাটির নীচ দিয়ে পাইপ নেয়ার ছুতোয় রাস্তার সমস্ত গাছই রাতারাতি সাবাড়। গাছ কাটা পড়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় রাস্তায়, আমার শহরের স্মৃতিময় জায়গার, গাছ কাটছে আমার প্রিয়-অপ্রিয় সবাই... কই, তারপরেও তো প্রতিবাদ করিনি!

গাজীপুরে থাকতে হলো কয়েক বছর। কয়লার উপরে ভরসা করে শতশত ইটের ভাটা গড়ে উঠতে দেখলাম। দেশে অনেক ইমারত হচ্ছে, ইটের খুব চাহিদা। ছাদে উঠলে মনে হতো দিগন্তের সীমা বরাবর উল্টানো এক চিরুনি, ঘনঘন চিরুনির দাঁড়, প্রতিটি দাঁড় থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বিকেল চারটা নাগাদ ঝড়ের পূর্বাভাসের মতো আকাশে কালো ছাইয়ের স্তর থমথমে লোকালয়টাকে চেপে ধরত; গাছের উপরে ছাই, বারান্দায় ছাই, ঘর মুছলে এক বালতি কালি, কাপড়ে ছাই, ধুয়ে রাখা বাসনে ছাই... আমাদের জীবন কয়লা দিয়ে ময়লা হয়ে গেল।

প্রতিবার প্রচুর ফলন দেয়া নারকেল গাছে ছোটো ছোটো ডাব হয়ে বসে রইল, খেজুরের রসের হাড়িগুলোতে কয়লার গন্ধওলা ছাই ভরে থাকল। শখের বাগানে গাঁদা থেকে চন্দ্রমল্লিকা, সব ফুলই হলো কালো আর পঞ্চাশ পয়সার মুদ্রার সমান। ক্ষেতের বাঁধাকপিতে প্রতি পাতার পরে ছাইয়ের পরত, পুকুরের পানির উপরে ছাইয়ের স্তর, নীচে মাছদের কী অবস্থা, ভাবা যেত না বেশিদূর। পত্রিকায় দেখতাম, পুরো অঞ্চল জুড়ে অ্যাজমা আর ব্রঙ্কাইটিসের রোগী বেড়েছে মারাত্মক হারে। আমার ঘরেও সমস্যা বাড়ল। এক বছর বয়সী সন্তানের নাক কান থেকে তুলো দিয়ে ছাই পরিষ্কার করতে হয় কিছু পরে পরে। তাকে ধীরে ধীরে শ্বাসজনিত সমস্যায় পড়তে দেখলাম। বড়োজোর ওই এলাকা থেকে পালিয়ে বাঁচলাম, তবু প্রতিবাদ করলাম না।

সুন্দরবনের আশেপাশের যাদের বিদায় করা হয়েছে, তাদের কথা আলাদা, আর হয়ত বাকিরাও পালাবে। বনটা নিজেই পালাবে, যেমন প্রতিবছর ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে গাজীপুরের ভাওয়ালের বন। তবে সুন্দরবনের আশেপাশে অনেক বড়ো বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর বিশাল সব শিল্প স্থাপনা হবে; হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার, রাতারাতি চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমলে পরিবেশ, প্রচুর উন্নয়ন। আরো ধোঁয়া, আরো রঙ, আরো রাসায়নিক বর্জ্য... গাছের পাতা ছাইয়ের স্তর ভেদ করে শ্বাস নেবে না, ম্যানগ্রোভের উঁচু করে রাখা নাক চাইলেও একটু পরিষ্কার বাতাস পাবে না, প্রাণীগুলোর নাকে ছাইয়ের গাদা জমে যাবে, কে সরিয়ে দেবে ছাই? অবশ্য এভাবেও ভাবা যায় যে ব্রাশ না করেও কুকুরের দাঁত এত পরিষ্কার কী করে?

কিন্তু কোনোরকমে তারা যখন বাতাস টানবে, তখন? খেতেই হবে ছাই। আর মাছদের? পানির উপরের ছাইয়ের স্তর, পানিতে মিশে যাওয়া কয়লার গুঁড়ো, পিপাসা লাগলে এই থাকবে ওদের কপালে। তাদের যে পিপাসা লাগে সেটা তখন বোঝা গিয়েছিল যখন তেল খেয়ে মরে ভেসে ছিল তারা। যে জালে সেবারে ভেসে থাকা তেল উঠে এসেছিল, সে জালে কি নৌকা উলটে পানিতে গুলে যাওয়া কয়লার গুঁড়োকে ধরা যাবে? তবে হ্যাঁ, আমি এখনো প্রতিবাদ করছি না।

আচ্ছা, এই ‘আমি’গুলোর মধ্যে কোথাও না কোথাও কি আপনি আছেন? আমি অবশ্য ভাবছিলাম অন্য কথা, আগে কখনো প্রতিবাদ করিনি বলে কি এবারেও করব না? আর কত বড়ো সর্বনাশ হলে প্রতিবাদ করব? প্রতিবাদ আর বিরোধিতা করার জন্য সব উজাড় হয়ে শুধু কড়কড়ে টাকার নোট পড়ে থাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করা কি যৌক্তিক?

আপনার মন্তব্য

আলোচিত