ফরিদ আহমেদ

১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২০:০৫

মারমা বোনেরা

দুই বোনের বয়সের পার্থক্য মাত্র পাঁচ মিনিটের। এক গর্ভে একই সাথে থেকেছে তারা নয় মাস পরস্পরকে জড়াজড়ি করে। পৃথিবীর আলো বাতাসে আসার আগে একজন আরেকজনকে টেক্কা দিয়ে পাঁচ মিনিট আগে বের হয়ে এসেছে মাতৃগর্ভ থেকে। জন্মেরও আগে মাতৃগর্ভের এই গভীর সম্পর্কের কারণে দুজনের আচরণ একই রকম হবার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। পাঁচ মিনিটের ছোট যে জন, সে বড় চঞ্চল, গতিময় এবং আক্রমণাত্মক। আর বড় জন ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে, শান্ত এবং বুদ্ধিমতী। ছোটজনের কাজ যেখানে গোল দেওয়া, বড় জনের দায়িত্ব হচ্ছে দলের হয়ে গোল ঠেকানো।

যে যমজের কথা বলছি আমি, তারা হচ্ছে মারমা বোনেরা।এদের ছোট জনের নাম আনুচিং, আর বড় জনের নাম আনাই। এরা দুজনই বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৬ প্রমীলা দলের সদস্য। বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে দুই ভাই বা দুই বোন একই সাথে খেলার ইতিহাস আছে। অনেক বছর আগে নান্নু এবং মঞ্জু ভ্রাতৃদ্বয় খেলেছে জাতীয় দলে। বাংলাদেশের প্রমীলা ফুটবল দলেও আছে দুই বোন, সুইনু প্রু মারমা এবং মাইনু মারমা। এরা দুজন জাতীয় দলের অধিনায়কত্বও করেছে। কিন্তু, যমজ দুই বোনের জাতীয় দলে খেলা এটাই প্রথম।

এই যমজের জন্ম খাগড়াছড়িতে ২০০৩ সালে। বাংলাদেশের মেয়েদের দলগত ইভেন্টে ঐতিহাসিকভাবেই পাহাড়ি মেয়েদের আধিপত্য রয়েছে। এরা বাঙালি মেয়েদের তুলনায় শারীরিকভাবে অনেক ফিট হয়। পাহাড়ের কষ্টকর জীবনে নিত্য শারীরিক পরিশ্রম করার কারণেই সাধারণত হয় বেশ শক্তপোক্ত। এছাড়া পরিবেশেরও একটা প্রভাব রয়েছে। বাঙালি সমাজে যেখানে মেয়েদের খেলাধুলার ব্যাপারে রক্ষণশীলতা রয়েছে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেটা নেই। এই সমাজগুলোর বেশিরভাগই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হবার কারণে মেয়েরা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে চলাফেরার ক্ষেত্রে। যার প্রতিফলন এসে পড়ে খেলাধুলাতেও। পাঁচ ছয় বছর আগে প্রমীলা ফুটবল দল নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম আমি। সেখানে দেখিয়েছিলাম যে, সেই দলটার অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ছিল পাহাড়ি মেয়েরা। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৬ দলেও আধিক্য না থাকলেও বেশ কয়েকজন পাহাড়ি মেয়ে রয়েছে। আনুচিং এবং আনাই হচ্ছে মারমা। এর বাইরে রয়েছে চাকমা মেয়ে মণিকা চাকমা এবং গারো মেয়ে মারিয়া মান্ডা। মারিয়া আবার দলের সহ-অধিনায়কও।

আনুচিং অনূর্ধ্ব ১৬ দলে থাকলেও মুল দলে তার খেলার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। দলের অন্যতম প্রধান স্ট্রাইকার স্বপ্নার ফর্মহীনতার কারণে সুযোগ এসে যায় তার। সেই সুযোগটা লুফে নেয় ক্ষিপ্রগতির এই ফরোয়ার্ড। কৃষ্ণার পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে তার কাছ থেকেই। কোচ গোলাম সারোয়ার ছোটন তাকে তুলনা করেছেন বাংলাদেশের এককালের সেরা স্ট্রাইকার শেখ আসলামের সাথে। শূন্যে ভাসা বলে আসলাম ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাঁর হেডওয়ার্ক, বাইসাইকেল কিক, কিংবা ব্যাকভলি আজ পর্যন্ত কেউ অনুকরণ করতে পারে নাই। কোচ ছোটনের বক্তব্য অনুযায়ী আনুচিংও এয়ারে অসাধারণ। সুবিধাজনক জায়গায় বল পেলে সেটাকে সে কখনই মিস করবে না। মাঠে আনুচিং বিরামহীন, প্রতি মুহূর্তে ছুটছে সে বল নিয়ে কিংবা বল ছাড়া।

অন্যদিকে আনাই হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথার প্রত্যয়ী একজন খেলোয়াড়। ওয়ান-টু-ওয়ানে দুর্দান্ত। ভয়ডর বলে কিছু নেই তার। প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে নিমিষেই আক্রমণভাগকে যোগান দিতে পারে নিখুঁত পাসে। আনুচিং যেখানে কথার খই ফোটাচ্ছে সারাক্ষণ, আনাই সেখানে কত কম কথা বলা যায় তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

এই দুই বোনের বয়স মাত্র তেরো। সবে কিশোরী তারা। সামনে পড়ে রয়েছে অফুরন্ত সময় এবং অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের ফুটবলকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাক এরা আগামী দিনে, সেই শুভকামনা রইলো।

খেলাধুলাসহ সব কিছুতেই মেয়েদের এখন এগিয়ে যাবার সময় এসেছে বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। মৌলবাদের যে কালো ছায়া আমাদের ঘিরে ধরছে শকুনের মতো, সেটা থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারে মেয়েরাই। কারণ, মেয়েরা যত এগোয়, মৌলবাদীরা তত পিছোয়। এটা হচ্ছে প্রমাণিত সত্য। সে কারণেই মৌলবাদীদের এত আক্রোশ মেয়েদের বিরুদ্ধে। সর্বশক্তি দিয়ে তারা মেয়েদের ঘরে আটকে রাখতে চায় প্রতিক্রিয়াশীলতার চাষ বাধাহীনভাবে করার জন্য।

আমাদের আনুচিং, আনাই, মারিয়া, কৃষ্ণাদের মতো মেয়েরা হাট, মাঠ, ঘাট সবকিছুর দখল নিক, ঝেঁটিয়ে বিদায় করুক মৌলবাদ আর কূপমণ্ডূকতাকে।
ফরিদ আহমেদ : কানাডা প্রবাসী লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত