মো. মাহমুদুর রহমান

০৪ অক্টোবর, ২০১৬ ১৬:১৪

খাদিজা হত্যাচেষ্টা : অমানুষের তাণ্ডবে হতবাক জাতি

প্রেমের সম্পর্ক তো গোলাপের সাথে। সত্যিকার প্রেম গোলাপের সৌন্দর্য, হাস্নাহেনার সৌরভ ছড়ানোর কথা। এ কোন প্রেমিক যার হাতে লাল গোলাপ নয়, চাপাতি! গোলাপের লাল নয়, এ যে রক্ত লাল! হা¯œাহেনার সৌরভ নয়, বেরিয়ে এসেছে মাথার খুলির ভেতর থেকে মগজ! না, ও প্রেমিক নয়। ও তো একটা অমানুষ। যদিও তার সব পরিচয় মানুষের মতো। নাম রাখা হয়েছিল বদরুল আলম।

হ্যাঁ, এটা মানুষেরই নাম! শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। এটাও তো ভাল ছাত্রদের বিদ্যাপীঠ! বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক! এ পরিচয়ও মানুষের। ইউটিউবের ভিডিওতে দেখা চেহারাও মানুষের! কিন্তু চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য আর মেয়েটির আর্ত-চিৎকারের দৃশ্য দেখে মানবতা কেঁদে ওঠে। না, ও মানুষ হতে পারে না! তার পরিচয়ের সব আলখেল্লা সরিয়ে সত্যিকার অমানুষটা বেরিয়ে এসেছে!

৩ অক্টোবর। বিকেল বেলা এম.সি. কলেজ থেকে পরীক্ষা শেষ করে খাদিজা আক্তার নার্গিসের মাথায় হয়তো পরীক্ষায় দেয়া উত্তরগুলোর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। অন্যদিকে পেটের ক্ষুধা ওই চিন্তার দরজার কড়া নাড়ছিল বড় বেসুরোভাবে। এমন সময় অমানুষ বদরুলের চাপাতির কোপ তাকে ফেলে দেয় এমসি কলেজ পুকুর পাড়ে। এত সুন্দর জায়গাটি যেখানে কোন শক্ত হৃদয়ের মানুষও প্রকৃতির সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নিষ্পাপ আনন্দে। কিন্তু এই নরপশুর হাত একটুও কাঁপেনি মেয়েটিকে আঘাত করতে। ওসমানী হাসপাতালে মেয়েটির চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। অবস্থা খুবই খারাপ! তাই রাতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য। আজ দেশের প্রতিটি মানব হৃদয় নার্গিসের সুস্থতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। যারা হাসপাতালে রক্তাক্ত চেহারা কিংবা ইউটিউবে বাঁচার করুণ আকুতি মিশ্রিত চিৎকার শুনেছেন তাদের চোখে পানি এসেছে। তাৎক্ষণিকভাবে ছেলেরা তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতে না পারলেও নরপশুটিকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে।

দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সরকার এই নৃশংস ঘটনার বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক এটাই মানুষের চাওয়া। আর খাদিজা আক্তার নার্গিসের উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে সরকারি পয়সায় তাকে বিদেশ পাঠানো হোক। এসবই সরকারকে করতে হবে তাৎক্ষণিক কর্তব্য হিসেবে।

কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সবাইকে চিন্তা করতে হবে কেন মানুষের ঔরসে এরকম অমানুষ জন্ম নিচ্ছে। নর-নারীর পারস্পরিক আকর্ষণবোধ এটা তো সৃষ্টিগত। এ আকর্ষণ, প্রেম-ভালবাসার উপরই ভর করে মানব সভ্যতা আজকের অবস্থানে এসেছে। পারস্পরিক বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ না থাকলে হাজার হাজার বছর আগে মানবকুল পৃথিবী থেকে বিদায় নিত। একটা ছেলে বা একটা মেয়ে তার ভালোলাগা একজন মানুষকে চাইতেই পারে। প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষ এরকম প্রস্তাবে সাড়া দিতেও পারে। আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। এখন প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেই মেয়েটিকে কোপাতে হবে এ কেমন কথা! আগে মুখে এসিড মারা হতো। এখন মনে হয় এসিডের যুগ চলে গেছে। চাপাতির জয় হচ্ছে সর্বত্র! জঙ্গিদের হাতে চাপাতি! এখন প্রেমিকের হাতে চাপাতি! তারপর!! না, আর চাপাতি নয়।

বজ্রমুষ্টি নিয়ে বেরিয়ে আসুন পুণ্যভূমি সিলেটের মানুষ। বেরিয়ে পড়ুন সারা দেশের মানুষ। প্রতিরোধ করুন সব ধরনের অমানুষিক ও অমানবিক কর্মকাণ্ড। নতুবা ভবিষ্যতে আপনার, আমার যে কারো মেয়েরই মগজ বেরিয়ে আসতে পারে মাথার খুলি থেকে! পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করতে হলে নীরবতার কোন সুযোগ নেই। সরব হতে হবে। সক্ষমও হতে হবে।

এমসি কলেজ পুকুরপাড়ে যখন অমানুষটি কোপাচ্ছিল অসহায় মেয়েটিকে তখন পাশে কয়েকটি ছেলে ছিল। তারা চাপাতির ভয়ে কাছে আসেনি। ভিডিও করছিল নির্মম ঘটনাটি। একজনের কণ্ঠে শোনা গেল পুলিশ ডাকার কথা। ওরা তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে প্রতিহত করলে মেয়েটি এত বেশি রক্তাক্ত হতো না। মেয়েটির জীবন আজ সঙ্কটাপন্ন হতো না। তারা আসেনি। যদিও তারাও এ ঘটনাকে খুব ঘৃণা করছে। মেয়েটিকে বাঁচানোর ব্যাপারে হৃদয়ের সব আকুতি ছিল। তাহলে কেন আসেনি? তারা চাপাতির সামনে আসতে সাহস করেনি। নিজের জীবন সঙ্কটাপন্ন হওয়ার ভয় ছিল। তারা এ ঘটনা প্রতিহত করার মত সক্ষম ছিল না। এভাবে হাজার হাজার যুবকের মধ্যে হয়তো দু’একটা অমানুষ। বাকি সবাই মানুষ। এত মানুষ একটা দুটো অমানুষকে প্রতিহত করতে পারছে না, কারণ তাদের সাহস ও শারীরিক সক্ষমতা নেই। সরকার বাধ্যতামূলক শারীরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের সাহস বাড়বে ও যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিহতের কৌশল আয়ত্ত করতে পারবে। প্রায়ই রাস্তা ঘাটে দেখা যায় ছিনতাইকারীরা মেয়েদের ব্যাগ ছিনতাই হচ্ছে বা কারো হাত থেকে মোবাইল নিয়ে পালাচ্ছে। চারপাশে অনেক মানুষ কেউ এগিয়ে আসছে না ওই ছিনতাইকারীকে ধরতে। এসব ঘটনা প্রতিহতের জন্য বাধ্যতামূলক সব নাগরিককে শারীরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে পুলিশি কাজে অনেক সাহায্য হবে। একইসাথে মানুষের জীবন ও সম্পদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হবে।

প্রতিটি নির্মম ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় হৃদয়ের হাহাকার ঝেড়ে আবার আমরা নিশ্চুপ হয়ে যাই। এসব ঘটনা প্রতিহতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই না। এসব ঘটনা প্রতিহতের জন্য তিনটি বিষয় খুবই জরুরি। এক. পরমত সহিষ্ণু সমাজ গঠন, দুই. শিশুদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান, তিন. যুব সমাজকে শারীরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধে প্রস্তুত করা।

ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা যে সমাজে থাকবে সেখানে এরকম ঘটনা ঘটতে পারেনা। একটা শিশু ভিন্নমত সহনীয় পরিবেশে বড় হলে তার মানসিক গঠন ভিন্ন হতো। সে বড় হয়ে অন্যে অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। তখন ছেলেটি জানতো একটি মেয়েকে তার যেমন ভালোলাগার অভিব্যক্তি হতে পারে তেমনি মেয়েটিরও তাকে ভাল না লাগার অভিব্যক্তি হতে পারে। মেয়েটিকে জোর করে ভালবাসায় বাধ্য করা যাবে না। তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন এক সমাজ ও রাষ্ট্রে বড় হচ্ছে যেখানে অন্যের ইচ্ছা ও মতামতকে সম্মান দেখানো দূরে থাক, পদদলিত করতেও কুণ্ঠাবোধ করা হয় না।

ভাল ও মন্দের বিভেদ ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে শিশুদের। নৈতিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই অপরাধ দমনে। ধর্মীয় শিক্ষা নৈতিক শিক্ষার অন্যতম একটি উৎস। যে কোন ধর্মের মুল শিক্ষাগুলো মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে। যদিও আজকাল বিভিন্ন ধর্মীয় উগ্রপন্থার কারণে সব ধর্মের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সবকিছুর পরও সমাজে কিছু অমানুষ থাকবে। এদেরকে দমনের জন্য আইনের শাসন খুবই জরুরি। আর তাৎক্ষণিকভাবে এদের অপতৎপরতা প্রতিহতের জন্য প্রয়োজন চারপাশের মানুষের সাহস ও শারীরিক সক্ষমতা। এজন্য প্রয়োজন শারীরিক প্রশিক্ষণ। একটা নির্দিষ্ট বয়সের সব নারী পুরুষকে শারীরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। যাতে আইন আদালতে যাওয়ার আগেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনগণ দর্শক না হয়ে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে।

এসব স্থায়ী পদক্ষেপ নিলে সমাজে গর্হিত অপরাধগুলো অনেক কমে আসবে। দেশটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যেতে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। অন্যথায় এসব অমানুষের দানবীয় তাণ্ডব দেখতে হবে নির্দিষ্ট বিরতিতে, ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চে। খাদিজা আক্তার নার্গিসই হোক এ ধরণের জঘন্য ঘটনার শেষ শিকার। আর কাউকে যেন এ নির্মমতার মুখোমুখি হতে না হয়। এই প্রত্যয়ে এগিয়ে যাক দেশ।

মো. মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক। ইমেইল : [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত