ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন

০৮ অক্টোবর, ২০১৬ ০১:৩৫

রাজনীতির নাম উঠলেই যাদের চোখ বাঁকা হয়, তাদের ধারণা নেই কিনুদের সম্পর্কে

সাইফুর রাজ্জাক কিনু।
মেধাবী ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। দেশ মাতৃকার জন্য জীবনের আহবান আসলো। কিনু একাত্তরে হিসাবের খাতা রেখে অস্ত্র হাতে নিলেন।

গেরিলা কম্যান্ডার হিসাবে যুদ্ধ করলেন। দেশ স্বাধীন হলো। কিনু আর কর্মে ফিরে যাননি। দেশে তখন অন্য স্বপ্ন দেখছেন একদল স্বপ্ন বিলাসী। জাসদ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন সাইফুর রাজ্জাক কিনু।

ইতিহাস বড় বেদনাময়। স্বপ্ন বিলাসের মোহ ভঙ্গের ইতিহাস বড় করুণ।
কিনু ভাই হুলিয়া মাথায় নিয়ে দেশ ছাড়লেন। ইউরোপের দেশে গিয়েও বাংলাদেশের স্বপ্ন বিলাস আর তাদের যায় না। জড়ালেন বহি:বিশ্বে দেশজ রাজনীতিতে। এক দশক বাইরে কাটিয়ে দেশে ফিরলেন রাজনীতির টানে।

ততদিনে যৌবন চলে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশে ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়নি। কিনু ভাই সচ্ছল আধা সামন্ত পরিবার থেকে এসেও থেকে গেলেন রাজপথে। তার সংগের লোকজন ব্যাংকের, কর্পোরেটের বড় বড় কর্মকর্তা। সাইফুর রাজ্জাক কিনু কপর্দকহীন রাজপথের সাথী।

এ সময়টাতে বড় কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। মধ্যরাত। সুরমা মার্কেটের সামনে দাঁড়ানো। জানালেন খিদে লেগেছে।
তার মাত্র দুই টাকার দরকার। এক টাকায় নাকি ভাত পাওয়া যাবে। পঞ্চাশ পয়সা করে সবজি আর ডাল। খেয়ে নেবেন। জানা আছে, কোথায় পাওয়া যায়।
এমনি বহু রাত, দুপুরে দেখেছি। দেখেছি আপাদমস্তক এক সৎ, নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদকে।

এদের পরশে নিজেকে বড়ো ক্ষুদ্র মনে হয়েছে। আজো মনে হয়।
কপর্দকহীন কিনু ভাই বিয়ে করলেন। দুই সন্তান তার। সারা দিন ঘুরে বেড়ান রাজনীতির নানা কাজে। চেয়ে দেখেন, তার সংগের লোকজনের চাকচিক্য। বিকারহীন সাইফুর রাজ্জাক কিনু অনড় থাকেন তাঁর কাজে। একাত্তরের গেরিলা যুদ্ধ করে জাতিকে নতুন পতাকা দিয়েছেন। স্বাধীনতা দিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনের জন্য যুদ্ধ করার কোন তাড়না দেখিনি তাঁর কাছে।

আজ (৮ অক্টোবর) বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও ব্যাংকার মরহুম সাইফুর রাজ্জাক কিনুর ২০তম মৃত্যু বার্ষিকী।
১৯৯৬ সালে কিনু মৃত্যুর কূলে ঢলে পড়েন।
আমরা আর কেউ তার খোঁজ রাখিনি। পরিবারের খোঁজ রাখারও দায় পড়েনি কারো।
কেমন করে এক সৎ, নির্লোভ মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী দু'টি সন্তান নিয়ে এই বিশটি বছর পাড়ি দিলেন, আমি জানি না।

অন্য কেউ জানেন কি না জানিনা।
জানার আর কেই বা আছেন?
কে কার খোঁজ রাখে?
প্রায় দুই দশক এ অগ্রজকে কাছে থেকে দেখেছি। রাজনৈতিক নেতাদের নাম উঠলেই, যাদের চোখ বাঁকা হয়, তাদের কোন ধারনা নেই সাইফুর রাজ্জাক কিনুদের সম্পর্কে।
বহু বছর পর মধ্যরাতের মৃদু কোলাহলে হাঁটছি সুরমা মার্কেটের পাশ দিয়ে। পাশেই কোর্ট মসজিদ এলাকা। এখানেই ৯৬ সালে ঢলে পড়েছিলেন সাইফুর রাজ্জাক কিনু।

সুরমা মার্কেটের বাইরের কোলাহল দেখি। মধ্যরাত পেরিয়ে রিক্সার টুং টাং আওয়াজ। সুরমা মার্কেটের গলি দিয়ে দুই একজন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। কেউ সস্তায় খাবার খুঁজছেন। কেউ রাতটা কাটানোর কোন আশ্রয় খুঁজছেন।

আমি খুঁজছিলাম কিনু ভাইকে। কমরেড সাইফুর রাজ্জাক কিনু।
বন্ধু রুনুর অগ্রজ বলে বড় স্নেহ করতেন।
আজ তাঁর প্রয়াণের দিন কাকতালীয় ভাবে।
স্মৃতির শ্রদ্ধায় নীরব থাকি ক'টা মুহূর্ত।
সেলাম একাত্তরের বীর গেরিলা, কমরেড সাইফুর রাজ্জাক কিনু।

লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত