মাজহার মোশাররফ

০৯ অক্টোবর, ২০১৬ ২৩:০২

মনোবিজ্ঞান, বখে যাওয়া বদরুল এবং বখে যাওয়া সমাজ…

কৃষক ও দিনমজুর বাবার পাঁচ সন্তানের দ্বিতীয় বদরুল সুনামগঞ্জের ছাতকের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হতে পেরেছিল। তার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে যে সে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেনীতে বৃত্তি পেয়েছিল এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফালাফল করেছিল। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হওয়া কোন সহজ ব্যাপার নয় এবং বদরুল সেটা পেরেছিল।

‘মর্নিং সোজ দ্য ডে’ হলে মর্নিংটা তার খারাপ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮-০৯ সেশনে ভর্তি হয়ে তার ২০১২ সালে গ্রাজুয়েশন হয়ে যাবার কথা। কিন্তু দেখা গেল বদরুল ২০১২ সালে তার কথিত প্রেমিকা খাদিজা বেগম নার্গিসকে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ঘোপাল নামক স্থানে উত্যক্ত করতে যেয়ে স্থানীয় জনগণের কাছে গণ-পিটুনির শিকার হয়েছে যাকে সে জামাত-শিবিরের আক্রমন বলে চালিয়ে দিয়ে ক্যাপিটালাইজ করেছে এবং ছাত্রলীগের একটি পদ বাগিয়ে নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে মোটামুটিভাবে ২০১০ সাল থেকেই বদরুলের স্বাভাবিক শিক্ষার্থী জীবন থেকে স্খলন ঘটেছে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বদরুলের জীবন এক বল্গাহীন, দায়িত্বহীন, লক্ষ্যভ্রষ্ট জীবন। বড়ভাই দর্জি-দোকানীর সামান্য আয়ে অতি কষ্টে মা দিলারা বেগম বদরুলকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরেছেন। কত স্বপ্ন দেখছেন ছেলেটিকে নিয়ে। আজ দুঃখিনী মায়ের সারা জীবনের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।

যখন বদরুল একটার পর একটা সেমিস্টার ড্রপ দিচ্ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে নানাবিধ বিশৃঙ্খল কাজ-কর্মে যুক্ত হয়েছিল, তখন তাঁকে নিবৃত্ত করার কেও ছিল না। সামান্য রাজনৈতিক ক্ষমতা তাকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছিল। তার  পরিবার, গ্রাম, তার হল, তার বিভাগ, তার বিশ্ববিদ্যালয়, তার সংগঠন- কেউ তাকে রুখতে পারে নি। অথচ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব দায়িত্ব ছিল। বদরুলের জীবন থেকে দেখা যায় সে ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল এবং তাকে বাঁধা দেবার কেউ ছিল না। তাকে নিবিড়ভাবে দেখভালের দায়িত্ব কেউ নেয় নি।

একজন যুবকের হৃদয়ে প্রেম আসবে এবং সে প্রার্থিত প্রেমিকাকে পেতে চাইবে- এতো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রেমে প্রত্যাখ্যান প্রেমে পরার মতোই স্বাভাবিক। এই সহজ স্বাভাবিক বিষয়টি বদরুল সহজভাবে কেন নিতে পারলো না? কারন ততদিনে ক্ষমতা এবং বখাটেপনা তার মস্তিষ্কে  এক ‘ফল্স ইগো’ তৈরী করেছে, যেই ইগো কিছুতেই কোন প্রত্যাখ্যান মেনে নেবার জন্য প্রস্তুত নয়। খাদিজার প্রত্যাখ্যান তাই তার রক্তাত্ব হৃদয়ে এক অপমানের শেল হয়ে বিঁধেছে এবং খাদিজাকে সে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। এর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক সামান্য। মূল বিষয় হলো অপমানিত ইগো। সে তার ইগোকে জয়ী করতে চেয়েছে।

বদরুল যদি অন্য একটা স্বাভাবিক নিরীহ ছেলে হত, তাহলে সে হয়তো এটা মেনে নিত। কিন্তু সে ইতোমধ্যেই বখে যাওয়া, উদ্ধত, নিষ্ঠুর এক যুবক।  সময় মতো ব্যবস্থা নিলে, সাহায্য করলে বদরুলের এই বখে যাওয়া হয়তো ঠেকানো যেত। বদরুলের এই অপরাধের যথাযথ শাস্তি প্রয়োজন। কারন সমাজে শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি অপরাধী তৈরিতে সহায়তা করে। খাদিজা’র জন্য প্রার্থনা। আশা করি মৃত্যুর দুয়ার থেকে সে ফিরে আসবে।

মাজহার মোশাররফ : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত