সৌরভ দাস

১৪ অক্টোবর, ২০১৬ ০১:৫৩

বান্দরবনের প্রকৃতির আড়ালে পাহাড়িদের সংগ্রামী জীবন

কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বললে বিটকেলে মুখভঙ্গিতে না করে উড়িয়ে দিবে এরকম মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে বিরল। যারা না করে দেখবেন হয় পকেটে সমস্যা, নয় স্বাস্থ্যে সমস্যা, নয় ব্যস্ততার সমস্যা, নয়তো বা বার্ধক্য এসে আশ্রয় নিয়েছে মনের কোটরে। ঘুরতে যাওয়ার একটা চাপা উচ্ছ্বাস কিন্তু সবারই থাকে। পূজার ছুটি চলছিলো ক্যাম্পাসে। সবার হাতে সময় আছে। কারো কারো অল্প স্বল্প টাকার সমস্যা। কিন্তু পিকনিক স্পটটা যখন বান্দরবন ঠিক করা হলো এই সমস্যাটাও উধাও!

সুজন, শাপলা, ইব্রাহিম, বিলকিস, প্রবাল, ফয়েজ, পুলক, সুমাইয়া সবার মুখে অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার আগেই ফুটে উঠলো রোমাঞ্চকর হাসি। এই হাসির টানে সুদূর এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছোট ভাই সোহাগও এসে যোগ দিলো টিমে। বাকৃবির নয় আর সোহাগকে নিলে দশ জনের বাহিনী দাঁড়ালো। বাড়িতে যাওয়ার কারণে কৃষ্ণা বেচারি সুযোগটা হতভাগার মতো মিস করে গেলো।

বান্দরবন যাওয়ার প্ল্যানটা বলা যায় হুটহাট করেই নেয়া হলো। বান্ধবী ইসরাত জাহান শাপলা সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই বান্দরবন বলে বলে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিলো। বিনিময়ে তাকে “বাঁদর” উপাধি দিয়েও থামানো যাচ্ছিলো না। কিন্তু কিভাবে যে আমরা সেই বান্দরবনটাই ঘুরে আসলাম সেটা ভাবলে এখনো দুচোখ স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যায়।

বান্দরবন প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি। প্রকৃতির সৃষ্টি যে এত মায়াবী হতে পারে বান্দরবন না আসলে তা বোঝার উপায় নেই। অথচ প্রকৃতির উপর আমরা ইদানিং যে নির্যাতন শুরু করেছি সেই নির্যাতনের করাল স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এরকম অসংখ্য সৃষ্টি। জানি না সুন্দরবন আর কতদিন থাকবে। কিংবা সুন্দরবনের মতো অসংখ্য জায়গা। যেসব জায়গার সন্নিকটে আসলে আমরা সবাই একরাশ আনন্দ, এক চিমটে হলেও শান্তি অনুভব করি। বান্দরবন টিকে আছে এজন্য প্রথমেই স্যালুট জানাই বান্দরবনের মানুষদের। বান্দরবনের মানুষজন তাদের নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণ মন্দির, বগালেক, শৈল প্রপাত, চিম্বুক পাহাড় এসবের গুরুত্ব বুঝে। তারা জানে এগুলো কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই না, এগুলোকে কেন্দ্র করে ঘুরে বান্দরবনসহ দেশের অর্থনীতির চাকা।

বান্দরবন পুরোটাই আদিবাসি অধ্যুষিত। এখানে মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা, বম, লুসাই, চাকমা, খুমী সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বাস করে। সম্প্রদায় ভিন্ন হলেও এদের অর্থনৈতিক জীবনের সবারই মিল আছে। সবাইই সাদামাটা জীবন যাপন করে। সাদামাটা বললে অবশ্য তাদের দরিদ্রতাকে আড়াল করা হয়ে যায়। আদিবাসীদের মধ্যে ধনীর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। মিডল ক্লাস হাতেগোনা। অধিকাংশই দরিদ্র কিংবা অতি দরিদ্র। আমাদের বাঙালি জীবন যাত্রায় এখনো যেরকম করে নারী পুরুষ ভেদাভেদ আমরা দেখতে পাই আদিবাসীদের মধ্যে সেরকমটি দেখতে পেলাম না। জীবিকার টানে নারী যখন যেকাজ হাতে পাচ্ছে করছে। ব্যবসা করা, জুম চাষ করা, গাছ কাটা এরকম অসংখ্য কাজে কোথাও নারী কোথাও পুরুষের উপস্থিতি দেখা যায়। সবকিছু মিলে তাদের জীবন সুখের না, সংগ্রামের, অনেক কষ্টের। প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত তাদের টিকে থাকার লড়াই করতে হয়। পাহাড়ে উৎপাদিত ফসলের বাইরে অন্য কিছু কিনে নিয়মিত খাওয়ার ক্ষমতা খুব কম পরিবারেরই আছে। থাকলেও সেই যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই।

আমরা সবাই প্রথমে বগালেক গিয়েছিলাম। বগালেক যেতে রুমা বাজার থেকে ২৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে জিপ (চাঁদের গাড়ি) ভাড়া করে ১১ কিলোমিটার গিয়ে আরো পাক্কা ৬ কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হয়েছে। পাহাড়ি উঁচু উঁচু খাড়া খাড়া রাস্তা। শহুরে বাবুদের একেবারে দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমাদের অবশ্য কারো কোনো সমস্যা হয় নি। সুমাইয়ার সবসময় টার্গেট ছিলো আমাকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগুনো। শাপলা তো আমাদের থেকে মিনিমাম ৫ মিনিটের সমান রাস্তা সামনে ছিলো। বিলকিস বেচারি অবশ্য আমার পেছনে থেকে মান ইজ্জত খানিকটা বাঁচিয়েছে। পুলক যথারীতি তার প্রতিদিন ২০ টা বুক ডাউন দেয়া বডির সার্থকতা প্রমাণ করেছে। ইব্রাহিম তার ক্লান্তি লুকিয়ে আমার আশে পাশেই ছিলো। সুজন, প্রবাল, ফয়েজ, সোহাগ পাক্কা বিড়িখোর। এরা বিড়ি খেয়ে খেয়ে অনায়াসে পুরো রাস্তা পার করে দিয়েছে। যদিও গতিটা সবার থেকে কম ছিলো!

এই দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে ঐ এলাকার মানুষগুলোকে রুমা বাজার থেকে কেনাকাটা করতে হয়। মানুষ গুলোর এই দুর্দশা কাছ থেকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমাদের মিডিয়া গুলোতে আদিবাসীদের পোশাক আশাক, কথাবার্তা, তাদের নাচ গান এরকম অসংখ্য বিষয়ের উপস্থাপন আমরা দেখতে পাই। কিন্তু তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা মিডিয়াকে বলতে দেখা যায় না বললেই চলে। অথচ এটাই তাদের জীবন।

বান্দরবনে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হলো সেনাবাহিনীর সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশের আর কোথাও এমনটি দেখা যায় না। আদিবাসীদের সাথে কথা বলে বোঝা গেল, সেনাবাহিনীর এই সরব উপস্থিতি তারাও চান না। তারা এটাকে জেলখানা মনে করেন। তারা এটাও মনে করেন যে তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তাহলে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাদের এখানে এত নিয়ন্ত্রণ করার মানে কি?

সেনা সদস্যরা মাঝে মাঝে খুব রূঢ় আচরণ করে পাহাড়িদের সাথে। অথচ তা পড়ে থাকে আড়ালেই। অযথাই প্রায়শ সেনাবাহিনীর হাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় পাহাড়িদের। যেনো তারা বাংলাদেশের বাসিন্দা নয়। এখানকার আশ্রিত। ১৯৯৭ সালে সম্ভবত একটি পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছিলো। কিন্তু সেই চুক্তির বাস্তবায়ন খুব একটা চোখে পড়ে না। বগালেকের আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় নাকি আরো ১২টির মতো সেনা ক্যাম্প স্থাপিত হবে। জানি না বিষয়টা কতটুকু সত্য। এটা পাহাড়িদের শোনা কথা। বান্দরবনে আজো সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে পাহাড়িদের প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখতে হচ্ছে। নজরে রাখতে হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে। সেই বিদ্রোহকে কখনো পাহাড়িদের সাথে বাঙালিদের সংঘর্ষ বলে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রচার করা হয়। চাগিয়ে দেয়া হয় উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। আড়ালে পড়ে থাকে পাহাড়িদের অধিকারের প্রশ্নটি।

বগালেকের পর নীলগিরি দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিলো আমাদের। নীলগিরির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। আমরা যখন গিয়েছিলাম চারপাশে প্রচণ্ড বাতাস বইছিলো। নীলগিরির উত্তাল হাওয়ায় ভেসেছিলাম আমরা সবাই। হাতে সময় কম থাকায় ঘণ্টা খানেক অবস্থান করে আমাদের আবার রওয়ানা দিতে হলো বান্দরবনের দিকে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে বাকৃবি।

তবে পাহাড়িদের স্মৃতি কিছু থেকেই মাথা থেকে যাচ্ছে না। তাদের সাথে কথা বলার সময় বের করার জন্য চিংড়ি ঝর্ণা না গিয়ে বগালেকে অবস্থান করেছি অনেকক্ষণ।কথাও হয়েছে। সহজ সরল মনের কথাগুলো এখনো গেঁথে আছে মনের কোণে কোণে।
পাহাড়িদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই থাকবে- অন্যায়, শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায় সঙ্গত। অধিকারের প্রশ্নে আপোষ করা চলবে না। এটা তোমাদের বাংলাদেশের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত অধিকার। হয়তো আবারো কোনো একদিন দেখা হবে। ভালো থেকো, সুস্থ থেকো।

সৌরভ দাস : সাধারণ সম্পাদক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাকৃবি শাখা।

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত