সহুল আহমদ ও সারোয়ার তুষার

১৫ অক্টোবর, ২০১৬ ১৪:৫৪

ভর্তি পরীক্ষার মূল্য বৃদ্ধির বিরোধিতা কেন করছি, আর কেন করা উচিত?

“শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড”- ছোটবেলায় শেখা এই আপ্তবাক্য আক্ষরিক অর্থেই সত্য। শিক্ষা তথা শিক্ষানীতিকে ঘিরে পরিকল্পনা রাষ্ট্রব্যবস্থারই প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। কেমন রাষ্ট্র চাই তার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা। একটি উন্নত,সভ্য ও কল্যাণরাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হচ্ছে শিক্ষাকে তার নাগরিকের নাগালের মধ্যে রাখা অর্থাৎ সহজলভ্য করা।সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ যাতে সহজেই সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সেদিকে যেকোনো কল্যাণরাষ্ট্রই লক্ষ্য রাখে। কারণ শিক্ষা মূলত বিনিয়োগ, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে শিক্ষার অপরিহার্যতা পৃথিবীর সকল মনীষীই একবাক্যে স্বীকার করেন। কোন রাষ্ট্রের নাগরিক তার সমস্ত যোগ্যতা নিয়ে যদি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায় এবং রাষ্ট্র তার ব্যবস্থা করতে না পারে তাহলে সেই রাষ্ট্রকে কল্যাণরাষ্ট্র বলা যাবেনা। এজন্যই, প্রায় সকল উন্নত রাষ্ট্রই শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তার ব্যয় ন্যুনতম রাখে যেন শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার প্রাপ্তিতে রাষ্ট্রের যেকোনো অর্থসঙ্গতির মানুষের কোন অসুবিধা না হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা ভিন্নচিত্র দেখছি।প্রায় প্রতিবছরই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ব্যয় আকাশচুম্বী হচ্ছে এবং তা নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত, দরিদ্র অংশ। সম্প্রতি ভর্তি পরীক্ষার ফি বর্ধনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, সিলেটের বাইরে থেকে কেউ যদি শাবিতে পরীক্ষা দিতে চায় তাহলে তাকে কম করে হলেও পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। আবার, একজন ছাত্র যদি চার-পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে আগ্রহী হয় তাহলে তাকে ন্যুনতম ২৫,০০০ টাকার বাজেট আগ থেকেই তৈরি করে রাখতে হবে।

যদিও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু হলে এমন অনেক কিছুর সমাধান পাওয়া যেত – যেমন যাতায়াতের খরচ ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু আমাদের শিক্ষক মহোদয়দের (গুটিকয়েক ব্যতীত) নিকট এটি সীমাহীন কষ্টের এবং পর্বতসম কাজের একটি। মানুষ চাঁদে – মঙ্গলে চলে যেতে পারে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবের জন্যে এই প্রথা চালু করার উপায় তাঁরা খুঁজে পান না। একে এই সীমাহীন দুর্ভোগ, সেই সাথে মড়ার উপর খাড়ার গা স্বরূপ যুক্ত হয়েছে প্রতি বছর জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকা ভর্তি ফি। শুধু শাবিপ্রবিতেই না, প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়েই বাড়ছে; কিন্তু শাবিতে যা ঘটেছে সেটা তুলনাহীন নির্মমতা।

গত পাঁচ বছরের মধ্যে ফরমের মূল্য ৫০০ থেকে ১২০০ হয়ে গিয়েছে। ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ভর্তি ফর্মের মূল্য একনজরে দেখা যাক:
২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ: ৩৫০-৪০০ টাকা
২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষ: ৪০০-৪৫০ টাকা
২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ: ৪৫০-৫০০ টাকা
২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ: ৫০০-৫৫০ টাকা
২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ: ৬০০-৬৫০ টাকা
২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ: ৬৫০-৭০০ টাকা
২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ: ৮০০-৮৫০ টাকা
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ: ১০০০-১২০০ টাকা
অর্থাৎ মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ফরমের মূল্য প্রায় ৪ গুণ বাড়ানো হয়েছে; শুধুমাত্র গতবছরের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে ৩৩%!

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমপরিমাণ টাকা খরচ করে আমাদের দেশের কতজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে যেতে পারবে?

অধিকাংশ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে; যারা শুধু টাকার অভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি- এমনকি ঢাকাতেও যাওয়ার সাহস করতে পারেননি টাকার জন্যে। পূর্বে শাবিতে এডমিট কার্ড প্রশাসনই দিত পরীক্ষার দিন। এখন সেটাও ছাত্রদের প্রিন্ট করে নিয়ে আসতে হবে। যুক্তি বলে যে, প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন সেটাকে সহজতর করে তুলে এবং তুলনামূলক মূল্য এনালগের চেয়ে কম হবে। কিন্তু বর্তমানে সেটা পুরো উল্টো!

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে,শাবিতে ইউনিট কম তাই খরচ বেশি অথচ উল্টোটাই হবার কথা। ইউনিট যত কম হবে, পরীক্ষা পদ্ধতি তত সেন্ট্রালাইজড হবে; ফলে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ট্রান্সপোর্টেশন সব মিলিয়ে খরচ তত কম হবে-এটাই কমন সেন্স।

তাহলে, এই টাকা কি হচ্ছে? কই যাচ্ছে? শাবিপ্রবিতে আমরা হিসেব পাইনি কখনো। তবে সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সংবাদ পাওয়া যায় সেখান থেকে কিছুটা আন্দাজ নেয়া যেতে পারে। ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে জাবি ভর্তি পরীক্ষা থেকে আয় হয় ০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা! এর মধ্যে স্টেশনারি কেনা বাবদ ০১ কোটি, টেলিটক চার্জ বাবদ দেওয়া হয় ৮৪ লাখ টাকা আর বাকি ০৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা যায় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পকেটে।

সংবাদ মতে, ভর্তি পরীক্ষা থেকে উপাচার্য নেন ০১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ প্রত্যেকে নেন ০১ লাখ ১৫ হাজার টাকা, পরীক্ষা কমিটির সচিব ও ১০ জন সদস্য প্রত্যেকে নেন ০১ লাখ ০১ হাজার টাকা, নিরাপত্তা কমিটির ১৩ জন শিক্ষক নেন ০১ লাখ ০১ হাজার টাকা করে, নিরাপত্তা কমিটির চারজন কর্মকর্তা প্রতিজন নেন ৫০ হাজার টাকা এবং ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনের জন্য ৪শ ৮৪ জন শিক্ষক প্রতিজন নেন ০১ লাখ ০১ হাজার টাকা।

এই সংবাদের হিসেব কাটায় কাটায় সঠিক নাও পারে, কিন্তু অংকটা যে মোটেও কম না সেটা নিশ্চিত। ২০১০ সালে জাফর ইকবাল স্যার সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে একটা লেখায় রেজিস্ট্রেশন ফি নিয়ে খুবই বিব্রত ধরনের সত্য কথা বলেছিলেন-

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি এখনো বলা হয়নি। এর কারণ, সেটি বলতে আমি সংকোচ বোধ করছি। প্রতিবছর ভর্তি-প্রক্রিয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির রেজিস্ট্রেশন করিয়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে, অনেক সময় ছাত্রছাত্রীরা টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেও ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পায় না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কতজনের পরীক্ষা নেবে, আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে। সেই কোটি কোটি টাকার বড় অংশ শিক্ষকেরা ভাগাভাগি করে নেন। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে তাঁদের অর্থ উপার্জনের বাৎসরিক এই পথটি বন্ধ হয়ে যাবে বলে অনেকের ধারণা।’

রুয়েটে কিছুদিন আগে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের সাথে যা করা হয়েছে সেটা অমানবিক। ৫০০০ ভর্তিচ্ছুদের ছাত্রদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে – সংবাদ মাধ্যমেও এসেছে এমন খবর।

জীবন ধারণের ব্যয় বাড়ছে – এই অজুহাতে কেন ছাত্রদের পকেট কাটা হবে? এটার সমাধানে কেন প্রশাসন শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়ানোর জন্যে ইউজিসি ও রাষ্ট্রকে চাপ প্রয়োগ করবে না? শিক্ষাকে যে রাষ্ট্র শুধুই বিত্তবানদের প্রিভিলেজ বানিয়ে ফেলছে – সেটা কি তাদের নজরে আসছে না? শিক্ষার অভাবই যদি হয় দারিদ্র্যেরর মূল কারণ, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরো দারিদ্র্যের পাকচক্রে ফেলার এই হীন চেষ্টা অত্যন্ত ঘৃণ্য।

তবে, প্রশাসন থেমে থাকবে না। সামনে আরো বাড়াবে। কারণ, প্রশাসনকে এমন অযৌক্তিক কাজে প্ররোচনা আমরাই দিয়েছি। ‘সিস্টেমে পড়ে গেছি, কী আর হবে’, ‘আন্দোলনে গেলে রাজনীতি হয়ে যাবে’, ‘পলিটিক্স: উহা খারাপ’ – এই ধ্যানধারণা থেকে যতদিন না বের হয়ে আসতে পারব, ততদিন শুধু দূরে দূরে থেকে সমালোচনা করেই ক্ষান্ত দিতে হবে; কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। উল্টো আমাদের এই উদাসীনতাকে পুঁজি করে প্রশাসন তার পকেট ফুলাবে।

সদা সক্রিয়তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে যায়- আমরা যেন সেকথা ভুলে না যাই কখনো। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের শিক্ষালাভের সুযোগকে সুগম করবে- এটা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। তাই আমরা মনে করি, কোন বিবেকসম্পন্ন শিক্ষক যিনি মনে করেন শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলাই তার দায়িত্ব, তিনি কখনোই শিক্ষার্থীদের উপর এই অন্যায়, জুলুমের অংশ নিজেকে করবেন না এবং শিক্ষার্থীদের এই ন্যায্য আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিবেন।

লেখকদ্বয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত