রণেশ মৈত্র

২৭ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:১৪

বাংলাদেশের বাম আন্দোলন বর্তমানের নিরিখে-৩

পর পর দুটি চ্যাপ্টারে দেশের ও বিশ্বের প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রকাশ করেছি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মত। এগুলিকে আমার দলীয় অভিমত মনে করলে ভুল হবে কারণ এত দূরদেশ থেকে দলের পরিপূর্ণ অভিমত জানা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র এটুকু জানি যে ‘ঐক্য ন্যাপ’ ব্যাপক বাম প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের কার্যকর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠার সাথে আগ্রহী এবং চিন্তার ক্ষেত্রে সামান্যতম দলীয় সংকীর্ণতার বিরোধী। আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলীয় বামদের সম্পর্কিত বিষয়ে ঐক্য ন্যাপের বর্তমান অভিমত সম্পর্কেও আমি অবহিত নই।

নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে অতীতের কিছু কথার উল্লেখ করবো। দেশটা তখন পাকিস্তান। কমিউনিস্ট পার্টি কখনও কার্যত: কখনও সরকারীভাবেই নিষিদ্ধ। সাম্প্রদায়িকতাও তীব্র। ঐ সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্লোগান তুলেছিল, “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।” এই স্লোগান তুলে সিপিআই তখন ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। তখনও , যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টি তখনও বিভক্ত হয় নি বা হলেও সিপিআই-এর ঐ স্লোগানকে যথার্থ মনে করে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিও স্লোগান তুলেছিল, “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়” এবং তারাও সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছিল। পরিণতিতে প্রচণ্ড ধরপাকড়, আন্ডারগ্রাউন্ডে গমন ও ব্যাপক দেশত্যাগ। কমিউনিস্টরা চিহ্নিত হলেন “পাকিস্তানের দুশমন, “ইসলামের দুশমন” “মুসলমানের দুশমন ও “ভারতের দালাল” হিসেবে। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “রাজনৈতিকভাবে ভারত ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সাল থেকে যথার্থই স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনই হওয়া উচিত প্রধান লক্ষ্য।”

এই আন্তর্জাতিক অভিমত পাওয়ার পর ভারতের এবং পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির উপলব্ধিতে এলো যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে এবং “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়” স্লোগানটি ভুল। তখন থেকেই উভয় দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ঐ ভুল স্লোগান পরিত্যাগ করেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে এখনও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কোনো কোনো নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “আমরা কমিউনিস্টরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সঠিকভাবে বলেছিলাম “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়” তাই পাকিস্তানেও আমরা যে পরাধীন ছিলাম কমিউনিস্টরাই একথা প্রথম বলেছিল। এ জাতীয় উক্তি ইতিহাস পরিপন্থী সুতরাং পরিত্যাজ্য।

এর পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলন থেকে একদিকে যেমন স্ব-উদ্যোগে আমরা কতিপয় তরুণ সমাজতন্ত্রের ও সাম্রাজ্যবাদ- সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন পাবনাতে গড়ে তুলি (ঢাকাতে অল্পদিন পরেই) তখন থেকেই বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হই আজও রয়েছি। ১৯৫৪ তে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল করার সাথে সাথে গ্রেফতার হই তৎকালীন পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনে। দেড় বছর বিনাবিচারে আটক থাকার পর যখন মুক্তিলাভ করি সেই মুহূর্তে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন বলে দেন বাইরে গিয়ে যেন আওয়ামী লীগে যোগদান করি।

একথা বললাম এই তথ্যটুকু জানাতে যে এর আগেই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি তার সদস্যদেরকে (যাঁদের কমিউনিস্ট বলে সমাজে পরিচিতি কম) আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদানের নির্দেশ দিয়েছেন ঐ দলটি মার্কসবাদী দল না হওয়া স্বত্বেও। উদ্দেশ্য কর্মী নেতাদের জনসম্পৃক্তি বাড়ানো, আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক বানানো এবং যতটা সম্ভব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দলে পরিণত করা। উল্লেখ্য, শুধু আমিই নই তখন মোহাম্মদ তোয়াহা, আলি আহাদ, বেগম সেলিনা বানু, ভাষা-আন্দোলনের নেতা আবদুল মতিন সহ বহু সংখ্যক কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী ঐ সিদ্ধান্ত মোতাবেক আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং কয়েক বছরের মধ্যেই আওয়ামী মুসলিম লীগ “মুসলিম” শব্দটি তুলে দিয়ে “আওয়ামী লীগ” করতে তাঁরা সফল হন। এ কাজে মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানও উদ্যোগ নেন। তবে খোন্দকার মোশতাক সহ ৫/৬ জননেতা “মুসলিম” শব্দটি তুলে দেওয়ার তীব্র বিরোধিতাও করেন।

আওয়ামী লীগকে খানিকটা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিষ্ঠানেও পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৫৪ সালে ডাকসুর ভিপি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এসএ বারি এটি এবং ছাত্র ইউনিয়নের অপরাপর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে কিছুদিন আগে স্বাক্ষরিত “পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির” তীব্র বিরোধিতা করে ঐ চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। তাঁরা আবেদন জানান যুক্তফ্রন্টের সকল সংসদ সদস্যকে একই দাবিতে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করতে। দিন কয়েকের মধ্যেই প্রায় দেড়শত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের স্বাক্ষরিত এক যুক্ত বিবৃতিতে ঐ একই দাবি জানান হয়। এতে শেখ মুজিব সম্ভবত এক নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন।

তবে আওয়ামী লীগের অপর নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের মাত্র ১২ জন এম.পি. নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী একটি দলের সমর্থনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ (সম্ভবত: ১৯৫৬ সালে) করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটো ও সেন্টো চুক্তির প্রতি সমর্থন জানান আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, তখন থেকেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ঐ প্রশ্নে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তদুপরি ঐ একই সময়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বলে বসলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন পুরোপুরি স্বীকৃতি পেয়েছে (কিন্তু সংবিধান সংশোধন না করেই) তখন ১৯৫৭ সালের শুরুতে কাগমারীতে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। ঐ অধিবেশনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সহ সকল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। তীব্র বাদানুবাদের পর অধিকাংশ কাউন্সিলার সাম্রাজ্যবাদ ও স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে অবিচল থেকে পুনরায় ঐ দুটি প্রশ্নে মেজরিটি ভোটে প্রস্তাব পাশ করলে সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কাউন্সিল চলাকালেই ঢাকা চলে যান এবং ঢাকাতে পাল্টা কাউন্সিল ডেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অভিমতের প্রতি সমর্থন জানালে আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। মওলানা ভাসানী ও তাঁর অনুসারীরা ঐ কাউন্সিল অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত ছিলেন।

ফলশ্রুতিস্বরূপ মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির যাঁরা আওয়ামী লীগে কাজ করছিলেন তাঁরাও পদত্যাগ করলেন এবং হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মীও দলত্যাগীদের খাতায় নাম লেখালেন। ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে মওলানা ভাসানীর আহ্বানে ঢাকায় দু’দিন ব্যাপী “নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন” অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার সদর ঘাটের এক সিনেমা হলে। দু’দিন ব্যাপী ঐ সম্মেলনের পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশ থেকে বাম প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী নেতা-কর্মীরা এবং পূর্ব বাংলার কয়েক হাজার পদত্যাগী আওয়ামী লীগ কর্মী নেতাও যোগ দেন। গঠিত হয় “পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)” এটি উভয় পাকিস্তানের সকল প্রগতিশীল নেতা-কর্মীর মিলিত সংগঠনে পরিণতও হলো সারা দেশের কমিউনিস্টরাও এই দলের অভ্যন্তরে থেকে মূল দলে ও নানা ফ্রন্টে কাজ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও ফ্রন্টিয়ারে (পাখতুনিস্তান) ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে উভয় প্রদেশেই ন্যাপ সরকার গঠন করে। এভাবে কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ববাংলা সহ পাকিস্তানের নানা অঞ্চলে সংগঠনের বিকাশ ও বিস্তার ঘটাতে সমর্থ হয়।

ষাটের দশকের শুরুতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন বৈরুতের এক হাসপাতালে। অত:পর শেখ মুজিব হয়ে দাঁড়ান আওয়ামী লীগের একক এবং সর্বোচ্চ নেতা। দ্রুত তিনি কাউন্সিল অধিবেশন ঢাকায় ডেকে তাজউদ্দিন আহমেদকে দলের সাধারণ সম্পাদক - সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই দলে লক্ষ্য বলে ঘোষণা দেন। অত:পর ১৯৬৬ তে ঐতিহাসিক ছয় দফা, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা এবং অগ্নিঝরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হন এবং বাংলার সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন।

অপরপক্ষে ঐ দশকের শুরুতেই রুশ-চীন আদর্শগত দ্বন্দ্বের ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়ে এবং পরিণতিতে কমিউনিস্ট পার্টির (তখনও বে-আইনি) এবং ন্যাপ , ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি সকল বামপন্থী সংগঠন দুঃখজনক ভাঙনের কবলে পড়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে। তখন এটা বিশ্বব্যাপীই ঘটেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের মত ইসলামী রাষ্ট্রে যখন বামপন্থীরা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তে এই ভাঙন বাম সংগঠন গড়া ও আন্দোলন সৃষ্টি করার শক্তি বহুলাংশে হারিয়ে ফেলে। এতদসত্বেও ঐক্যের আহ্বান নিয়ে মস্কোপন্থী বলে কথিত ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন নতুন করে সংগঠিত হয় এবং ১১ দফা (৬ দফার সমন্বিত কর্মসূচী) এবং ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে অনেকটা শক্তি সঞ্চয় করতে সমর্থ হয়। অত:পর ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অংশের নিষ্ঠাবান ভূমিকা, সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থনে এই শক্তি মধ্যবিত্ত তরুণদেরকে সমাজতন্ত্রের ও বাম আন্দোলনের প্রতি বিপুলভাবে আকৃষ্ট করে। হঠাৎ সৃষ্ট জাসদের নেতিবাচকভাবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের উচ্চকণ্ঠ স্লোগান অবশ্য ন্যাপ-সিপিবি’র ভাবমূর্তিতে বেশ কিছুটা আঘাত হেনেছিল। তা স্বত্বেও জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীরা দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তিতে পরিণত হতে পেরেছিল। অথচ এই শক্তি ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের ফলে একদিকে ব্যাপক দেশত্যাগ, পুলিশি ধরপাকড় ও বছরের পর বছর আত্মগোপনে থেকে অতিমাত্রায় ক্ষীণকায় এবং পুরোপুরি প্রভাবহীন হয়ে পড়েছিল।

তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতৃত্ব বিদ্যমান বাস্তবতায় বিচার বিশ্লেষণ করে যে সকল যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার মধ্যে কমরেড মনি সিং, কমরেড বারিন দত্ত, কমরেড অনিল মুখার্জী , অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ ও কমরেড মো. ফরহাদের নাম এ দেশের বামপন্থী আন্দোলন সংগঠনের বিকাশে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখার কারণে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। আর নিজে মার্কসবাদী না হয়েও যিনি সাহসের সাথে দেশে কমিউনিস্টদের পক্ষাবলম্বন করে তাদের উত্থানে ভাষা আন্দোলন থেকে পঞ্চাশের দশক জুড়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন তার জন্য মওলানা ভাসানীকেও স্মরণে রাখা প্রয়োজন দেশের সকল বাম - প্রগতিশীল - গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের।

বারবার মনে পড়ে রুশ-চীন দ্বন্দ্বে যদি আমরা বিভক্তি এড়িয়ে ভিয়েতনামের মত ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারতাম - হয়তো বা সত্যিই বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এতদিনে বহুদূর অগ্রসর হতে পারতাম।

মনে রাখা প্রয়োজন, বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার বাম ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে। কেউ কাউকে বাদ দিয়ে নয়। ফলে বামপন্থীরা যেমন লাভবান হয়েছে তেমনই লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগও দেশের প্রধান জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রধান শক্তি ছিল এটি যেমন সত্য, সমভাবেই সত্য যে বামপন্থীরা ঐ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই শুধু পালন করে নি-তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব সক্রিয়ভাবে এগিয়ে না এলে বাঙালি জাতির জীবনে মহাবিপর্যয় ঘটে যাওয়ার সমূহ আশংকা ছিল। একথা অকপটে বলেছিলেন ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী।


আবার এ কথাও সত্য , ইতিহাস প্রমাণ করে, যখনই বাংলাদেশে বাম ও জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে দূরত্ব, ব্যবধান ও ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে তখনই উভয় শক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধুমাত্র অতীতে নয় বর্তমানেও এ কথা সমভাবে সত্য। একথাও সত্য, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বেও ক্রমাগত দক্ষিণমুখী প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে বাম শক্তিগুলির সাথে তার দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগ হয়তো তা বুঝে উঠতে পারছে না বা পেতে চাইছে না কিন্তু যতই তারা বামশক্তি থেকে দূরে চলে যাবে ততই তারা বেশী করে দক্ষিণপন্থার দিকে হেলে পড়বে। ফলে তাদের যেমন ক্ষতি হবে বামপন্থীদেরও (বৃহত্তর দেশাত্মবোধবশত:) বিস্তর ক্ষতি হবে। আর সর্বাধিক ক্ষতি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এবং বাংলাদেশের প্রগতির পথে ফিরে আসার ক্ষেত্রে। তাই আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থা থেকে ফিরে আসার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক আওয়ামী লীগের কাউন্সিল যদি একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে নিকট ভবিষ্যতে সক্ষম হয়, তাতে বাম শক্তির সাথে দূরত্ব কমতে এবং দেশের মঙ্গল সাধন করতে সক্ষম হবে।

তেমনই এও সত্য বামশক্তি যত বেশী শক্তিশালী হবে যত বেশী বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সৃজনশীল পন্থায় অগ্রসর হবে – উভয় শক্তির নৈকট্য ততই বাড়বে এবং দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। নতুবা আজ হোক কাল হোক ‘সহমরণে’ ঘটে যেতে পারে (‘সহমরণ’ শব্দটি শহীদ তাজউদ্দিন ব্যবহার করেছিলেন বামপন্থীরা যখন মুশতাক সহ গঠিত বাকশালে ঢুকতে রাজী হয়)।

এক্ষণে সমাপ্তি টানতে সামান্য কটি কথা:
এক. বিগত আশির দশকের মত এগারো দল এবং বর্তমানের ১৪ দল নিয়ে গভীরভাবে ভাবা হোক; আওয়ামী লীগের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওই দলটিকে অন্যতম মিত্র দল বলে ঘোষণা করে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করা হোক।

দুই. বিগত নির্বাচন বর্জন এক দল অপর আর এক দল বিপদের তত্ত্ব বর্জন যে ভুল ছিল তা স্বীকার করা প্রয়োজন।

তিন. ব্যাপকতর বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য অপরিহার্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি ভেবে তাকে দ্রুত কার্যকর কর্মসূচী গ্রহণ করা হোক;

পাঁচ. কোন মুসলিম প্রধান দেশে কমিউনিস্ট পার্টি নামে কোন পার্টি গণভিত্তি পেতে পারে কি না নতুন করে তা ভেবে দেখা হোক, ইরান ও ইন্দোনেশিয়া ও নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে।

ছয়. সবাই মিলে মিশে একটি ব্যাপক ভিত্তিক বামপন্থী দল গঠন করা যায় কিনা (১৯৫৭ সালের ন্যাপ জাতীয়) তাও ভেবে দেখা হোক।

সাত. দ্রুত একটি সর্বসম্মত নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি আগামী নির্বাচন যদি স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয়, তাতে অংশগ্রহণ করে ৪০/৫০ আসনে জিতে আসার উদ্যোগ নেওয়া হোক ও তার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হোক।

আট. নিজেদের প্রভাব-পরিচিতি জনতার মধ্যে বৃদ্ধি ও জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ জনসভা, মিছিল প্রভৃতি শুরু করা এখন যুগের দাবি । তাই তেমন কর্মসূচি গ্রহণ করে কংগ্রেস সফল করা হোক।

একদল বিপদ আর একদল আপদ; জয় হোক নিপীড়িত মানুষের!
[সমাপ্ত]

রণেশ মৈত্র : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ। ইমেইল : [email protected]

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত