সঙ্গীতা ইমাম

২৮ অক্টোবর, ২০১৬ ১০:৪৫

পরিবর্তন প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার

আমাদের মনে আছে আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এসিড সন্ত্রাস কীভাবে প্রতিদিনের খবরের সিংহভাগ জুড়ে থাকতো। প্রেমে অসফল,ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত্রুতা, সম্পত্তির রেষারেষি সবকিছু সেসময় শেষ হতো এসিডে এসে। অতীষ্ট সমাজ তখন প্রতিরোধ গড়ে তোলে সরকারকে বাধ্য করে এসিড কেনাবেচায় সতর্ক কঠোরতা অবলম্বণ করতে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

এখন এধরণের ঘটনা তেমন শোনা যায় না। তারপর দেখতাম গৃহপরিচারিকা নির্যাতন, প্রায় প্রতিদিন খবরের পাতা জুড়ে। স্ত্রী হত্যা পর পর বহুদিন। এদুটি ঘটনা আজও অল্প বিস্তর দেখা যায়। যৌন নির্যাতন কম বেশি বেশ কিছু দিন ধরেই চলে আসছে, তবে আজকের মত মহামারি আকারে ছিল না। আর ছিল না নির্যাতনের নৃশংসতম প্রকাশ এবং হত্যার মহাযজ্ঞ। আমি বলতে চাই যখন যা শুরু হয় তা এভাবে উপর্যুপরি ঘটতে থাকে কেন? এটা কি আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা বা মনোস্তত্ববিদরা গবেষণা করেছেন কখনো?

আজ আমরা দেখছি প্রেমে ব্যর্থ পুরুষ অনায়াসে প্রেমিকাকে কুপিয়ে হত্যা করছে বা জখম করে মৃত্যুর মুখোমুখি করছে। এত সহজ একটা প্রাণকে শেষ করে দেয়া! মানুষের এ অমানবিকতা কিসের প্রভাব? কখনো ভাবি, এভাবে বিস্তারিত বর্ণনাসহ প্রচার আরেকজন ব্যর্থ প্রেমিকের মনকে উদ্বুদ্ধ করে কি! একজন পারলে আমি পারবো না কেন বদলা নিতে এ ভাবনা থেকেই কি! সেই একজন হিরো হয়ে ওঠে অনেকজনের এবং প্ররোচিত করে আরেকটি নৃশসতায়। কিন্তু আবার মনে হয় প্রচার না করলে জানবোই বা কি করে? ভিকটিমরা সহায়তা পাবে কীভাবে? তবে কি ঢালাও বর্ণনা বন্ধ করা উচিত? ভেবে দেখবেন সংশ্লিষ্টরা।

শিশুরা যৌন লালসার বর্বরতার শিকার হচ্ছে ইদানিং ব্যাপকভাবে। এই নৃশংসতা যেকোন পর্যায়কে ছাড়িয়ে গেছে। শিশুর শৈশব আমরা বহুকাল ধরেই নানাভাবে ছিনিয়ে নিয়েছি।এখন একটা দু তিন বছরের শিশুও বর্বরতম আচরণ থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না। আমরা এ আচরণকে পাশবিক বলি।কিন্তু মজার বিষয় গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ ছাড়া অন্যকোন প্রাণির মধ্যে ধর্ষণ ব্যাপারটাই নেই।আর আমরা নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা বলে গর্ব করি। ছিঃ! আজ থেকে আমরা নিজেদেরকে কোন পশুর চেয়ে উন্নত বলার আগে যেন দু'বার ভাবি।

আমাদের দেশে বেশ কিছুদিন ধরে তিন থেকে ত্রিশ বছরের শিশু, নারী ধর্ষিত হবার ঘটনা প্রচন্ড বেড়ে গেছে। জ্ঞানীরা নানা তত্ত্ব দিচ্ছেন, শিশুদের good touch, bad touch চেনাতে বলছেন। আচ্ছা জানতে চাই কোন শিশুকে চেনাবো এই ভালো খারাপ স্পর্শ? দেড় বছর, তিন বছর, পাঁচ বছরের বাচ্চার শৈশবের নির্মল সরলতা ছিনিয়ে তাকে জানাবো এ কদর্যতার কথা! সে বুঝবে কিছু? আচ্ছা, নাহয় ধরে নিলাম সে বুঝলো। বুঝে করবেটা কি? একটা ৪৫ বছরের ষন্ডামার্কা পুরুষকে কি করে বাধা দেবে সে? কতটুকু শক্তি তার? আসলে পরিবর্তন প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার।

একেকটি ঘটনা ঘটে, আমরা সাধারণরা, সাংবাদিকরা, এনজিও কর্মীরা চিৎকার করি। দোষী গ্রেফতার হয়, আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুড় তুলি। আবার আরেকটি ঘটনা নিযে মেতে উঠি। জানার চেষ্টা করি না, খোঁজ রাখি না। প্রশাসনের উপর চাপ তো দূরের কথা, আগের মামলাগুলোর কি হলো? অগ্রগতি কি? আসামি আছে না জামিনে বেরিয়ে আরেক অপকর্মের পাঁয়তারা করছে! তনু,রিশা হত্যা নিয়ে কি তুমুল আবেগ আমাদের, খবরের কাগজ, চ্যানেলের পর্দা ভরপুর। চায়ের দোকান, অফিস, কলেজ ক্যান্টিন সরগরম। কিন্তু আজ ঐ মামলাগুলো শুধুই পরিবারগুলোর দায়। এ কারনেই প্রশাসনও সুযোগ পায় নানা অনিয়মের। অপরাধীও আইনের আঙুল গলে পালিয়ে বেরিয়ে আরেকটি অপরাধের পরিকল্পনা করতে সাহস পায়। আর যখন দুরাচার দেখে শাস্তি তো হয় ই না। তখনই আরো উদ্বুদ্ধ হয় অপরাধ প্রবণতায়।

যৌন নিপীড়কদের, বিশেষত যে বিকৃত মানসিকতার পিশাচেরা শিশু নির্যাতনকারী, তাদের অপরাধ জামিন অযোগ্য বলে আইন পাস করা হোক। এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাদের দেয়া হোক, যাতে ভবিষ্যতে কোন দুর্বৃত্ত এ ঔদ্ধত্য দেখাতে সাহস না পায়। কোন নারীকে দেখে নোংরা বিকৃত যৌন বাসনা জাগলেই যেন শাস্তির কঠোরতার কথাটিও সাথে সাথে তার মনে আসে।

এই যে একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে উপুর্যপরি, এর কারন কি বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন কোন সমাজ বিজ্ঞানী? কিংবা রাষ্ট্রের crime psychology বলে কি কোন বিভাগ নেই? যারা এই অপরাধীদের মনস্তত্ব নিয়ে কোন গবেষণা করতে পারে! শুধু শাস্তি দিলেই হবে না যদি এ বর্বরতা, নৃশংসতা নির্মূল করতে হয় তবে খুঁজতে হবে অপরাধীর কোন মানসিক বিকার বা অবস্থা এর জন্য দায়ী? সমাজের কোন দিকগুলো সেই মানসিক অবস্থাকে উষ্কানি দিচ্ছে বা প্রভাবিত করছে?

এগুলো খুঁজে সেগুলো থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হবে। আমি মনোবিজ্ঞানী বা সমাজবিজ্ঞানী নই। আমি এর সমাধান দিতে পারবো না। তবে চিন্তা প্রক্রিয়া এদিক থেকে শুরু করতে হবে বলেই মনে করি। জ্বর হলে প্যারাসিটামল খেয়ে তাকে কমিয়ে না রেখে, শরীরে কোন ইনফেকশন আছে কিনা সে পরীক্ষা করে এন্টিবায়টিক সেবনই জ্বর স্থায়ীভাবে সারাতে পারে বলে বিশ্বাস করি।

সঙ্গীতা ইমাম, শিক্ষক, সংগঠক ও সংস্কৃতি কর্মী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত