তপন কুমার দাস

৩০ অক্টোবর, ২০১৬ ২২:৫৭

বড়লেখায় বাড়ছে অপরাধ, উত্তরণের পথ কি?

মৌলভীবাজার জেলার উত্তরের প্রান্তিক জনপদ বড়লেখা। এ উপজেলায় সামাজিক অবক্ষয়ে নৃশংসতা এবং অপরাধ বাড়ছে ক্রমেই। একের পর এক সংঘটিত হচ্ছে নানা ধরণের অপরাধ। গত দু’মাসের অপরাধ চিত্র পর্যালোচনা করলেই চোখে পড়বে ছয়টি লোমহর্ষক খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক বিরোধে সহিংসতার মতো ঘটনা। এরকম ঘটনা এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ৮ বছরের শিশু কন্যাও। একের পর এক নৃশংস খুনের ঘটনায় সাধারণ মানুষদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। একটি খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটছে আরও একটি খুনের ঘটনা। পুত্রবধূর পরকীয়ার জেরে ব্রিটিশ নারী, আওয়ামীলীগ নেতা, জমিজমা নিয়ে পূর্ব বিরোধের জেরে আপন ভাতিজার হাতে চাচা, হাওরে বিল প্রহরীসহ ৬টি লোমহর্ষক খুনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ৫দিনের মধ্যে তরুণী ধর্ষণ ও ৮ বছরের কন্যা শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিনিয়ত এরকম অসংখ্য ঘটনার জন্ম হচ্ছে এই উপজেলায়। আবার অনেক ঘটনাই প্রতিপক্ষের হুমকি কিংবা সমাজপতিদের চাপে আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। যার ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে পুনরায় অপরাধ করতে উৎসাহিত হচ্ছে।

দু’মাসের অপরাধ চিত্র : শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) উপজেলার শাহবাজপুর চা-বাগানে শিশু কন্যা (৮) ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। শিশুটির পিতার অভিযোগে জাহাঙ্গীর মিয়া (২০) নামে এক তরুণকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।  


বুধবার (২৬ অক্টোবর) রাতে উপজেলার কেছরিগুলের দোকানটিলা এলাকায় বিদেশ পাঠানোর নামে এক তরুণীকে (১৯) ধর্ষণ করেছে দুই দালাল। তরুণীর ধর্ষণ মামলায় বৃহস্পতিবার পুলিশ ধর্ষক জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছে।
শনিবার (২২ অক্টোবর) উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের চৌ-ঢালু বিলে খুন হন আহসান উদ্দিন (৩৩) নামের এক বিল প্রহরী। তিনি ইউনিয়নের বড় ময়দান গ্রামের মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে। পুলিশ তাঁর লাশটি চৌ-ঢালু বিলের শীতলিবাড়ি সংলগ্ন ডোবা থেকে উদ্ধার করে। লাশের শরীরের ২টি স্থানে জখম রয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়। পুলিশ ২জনকে গ্রেপ্তার করে।


শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) সদর ইউনিয়নের কেছরীগুল গ্রামে দুপুর সাড়ে ১২টায় জমি-জমা সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জেরে আপন ভাতিজার দা’র কোপে চাচা আসুক আহমদ (৩৮) নির্মমভাবে খুন হন। ঘটনার পর পরই ভাতিজা সুমন আহমদ (২৮) পালিয়ে যায়। এখনও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

বৃহস্পতিবার (০৬ অক্টোবর) সকাল ১০টায় উপজেলার দাসেরবাজার ইউপি’র পশ্চিম গুলুয়া গ্রামের মৃত ললিত মোহন দাসের স্ত্রী মায়া রাণী দাসকে (৫৫) নিজ কক্ষে ঢুকে কাঁচি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে ভাসুরপুত্র নৃপেশ দাস সুনাই (২৫)। ঘটনার পর পরই এলাকাবাসী অভিযুক্ত নৃপেশকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় ওই ঘাতক।

বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল পৌনে ১১টায় প্রকাশ্য দিবালোকে উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ইউপি আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন আলমকে (৩৮) দা দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় সন্ত্রাসী কাজল মিয়া (৪৭)। ঘটনার পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর ভোরে খুনি কাজল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের হাতে আটক হয়। পরে তাকে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। কাজল আদালতে এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। তবে নিহতদের পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, রাজনৈতিক জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজলকে দিয়ে দু’বারের মেম্বার আলমকে খুন করানো হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ভোররাতে উপজেলার চান্দগ্রামে নিজ বাড়িতে খুন হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ফাতির আলীর স্ত্রী মায়ারুন নেছা (৬৬)। পুত্রবধূর পরকীয়ার জেরেই খুন হন তিনি। এ ঘটনায় নিহতের দেবর হারিছ আলী বাদী হয়ে দু’জনের নামে থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় জড়িত পুত্রবধূ ফাহিমা (২৮) ও ফাহাদ আহমদ সবুজ (২২) নামের এক যুবককে গ্রেফতার করেছে থানা পুলিশ। ফাহিমা ও সবুজ পৃথকভাবে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।


একই দিন মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) কোরবানির মাংস বণ্টন নিয়ে প্রতিপক্ষের দা’র কোপে উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপির বাসিন্দা কুতুব আলী নামের এক ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনার পর পরই এলাকাবাসী হত্যাকারী আব্দুল জলিলকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন।

এসব ঘটনায় মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধগুলো একে একে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি। সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি পারিবারিক অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ক্ষয়িষ্ণু এই সামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তার জন্য আইনি প্রচেষ্টার পাশাপাশি মানবিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজে শুভ দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হলে এসব অনাচার বন্ধ হবে না। সবচেয়ে বড় কথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কিছুতেই সম্ভব হবে না।

অপরাধীরা যেন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে না যায়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অপরাধী যেই হোক, আইনের মাধ্যমে তার শাস্তি নিশ্চিত করা হলে হত্যাকাণ্ড সহ অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে।

 

লেখক: সাংবাদিক, বড়লেখা প্রতিনিধি, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম

আপনার মন্তব্য

আলোচিত