গিয়াস উদ্দিন বাবলু

১৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০২:৫৪

স্মরণ : এক রঙা প্রার্থনা

চয়ন-কি সুন্দর তুলতুলে নাম, শীতের সকালের রোদের মতোন। কোন বালু চরে ভরা পূর্ণিমায় জোছনা গলে পড়ার মতোন। ভুল না হলে জন্ম- ১৯৮১। আমরা তখন মাসুদ রানার ক্লাস টেনে পড়ি। আমি, ইকবাল, তপন, ফখরুল (যুগ্ম সচিব, যাকে নিয়ে অহংকার করি), পাইলট স্বপন (যে এখনো আমাকে নিয়ে ভাবে), হারিয়ে যাওয়া শ্যামল, বাহার, নিখোঁজ ডাবলু, আবছার, মলয়, টিপু। রেলের ধারে তপনদের বাসা-ঘড়ি ধরে ট্রেনের হুইসেল, কয়লার ইঞ্জিনের ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ কলোনির প্রান্ত-ঘেঁষা আমাদের বাসায় গিয়ে শেষ হতো। তাই বোধ হয় চলাচলের একটা টান ছিলো আমাদের মাঝে। সময়ও ছিলো অনেক অবুঝ।

জন্মের সময় থেকেই চয়ন হৃদয়ের অসুখে ভুগছিলো। খালাম্মার অকারণ উৎকণ্ঠা আমার এখনো মনে আছে। মনে আছে ছোট বেলার চয়নের জল-দিঘী চোখ আর তাঁর জন্য তপন, শোভাদের অতল ¯েœহ। ওদের আগ্রহের সবখানি জুড়েই দেখতাম চয়নের বাস।

স্কুল পাশের পর ইকবাল তখনকার দিনে হাজার ক্রোশ দূরে যাত্রা করে। সম্পর্কের নূতন বলয় তৈরি হতে থাকে। অনেকের কাছাকাছি হতে যেয়ে তপন আমার কাছ থেকে  দূরে সরে যায়। ওর অনেক গুণ ছিলো- অর্থ, বিত্ত, মেধায় অগ্রসর ছিলো তাই সে না আগালেও পিছিয়ে পড়ি আমি; বন্ধুত্ব টিকে থাকলেও দূরত্বের একটা গল্প তৈরি হয়। ওদের বাসায় যাতায়াত কমে, সহসা আর চয়নকে দেখা হয়ে ওঠে না।

তার অনেক বছর পর সঞ্জয়ের পত্রিকায় একটা ফরমায়েশি লেখা ছাপতে দিই। ওর সযত্ন আগ্রহে লেখাটা সাপ্তাহিক সীমান্তের ডাকে ছাপা হয়। সে সংখ্যায় চয়নেরও একটা লেখা যায়।  শিরোনাম: আমরা পৃথক হলেও পৃথক সমাজের নই। শিরোনামটা খুউব দাগ কাটে- পরম আগ্রহে পড়ে দেখি কী কঠিন কথাগুলো সচেতন শব্দ আর সরল বাক্য-বিন্যাসে গেঁথেছে চয়ন! ভালো, সাবলীল লেখা চিন্তার একটা মেলবন্ধন তৈরি করে। আমার মতোন দুর্বল পাঠকের চৈতন্যেও নাড়া দেয়।

উৎসাহের মাত্রা বাড়ায় চয়নকে ফেসবুকে খুঁজে নেই। দেখি পাতা ভর্তি তার সমৃদ্ধ লেখায়। অনুভব আর অনুভূতির ছড়াছড়ি। অধিক পাঠেই কেবল এতো শ্রেয়তর লেখা সম্ভব। পড়ার অভ্যাস কম হলেও আমার আগ্রহের কমতি নেই। ভেবেছিলাম তার ফেসবুকে সংযুক্ত হতে চাইবো, সময় হলো কই? মাঝে মাঝে অভিমানী হতে ইচ্ছে করে। অবশ্য এর জন্যও একরকম সক্ষমতার প্রয়োজন রয়েছে। আমি দেখেছি আমার ফেসবুক বন্ধু তালিকার প্রায় শতভাগ আমার অনুরোধে বন্ধু তারমানে সবাই আমার বন্ধু কিন্তু আমি কারো নই। সে কারণে অনেকদিন থেকেই একপেশে তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে না। চয়ন অপেক্ষা করলেও পারতো। এতো তাড়া ওর? মাত্র ছত্রিশে তাঁরাদের দলে নাম লেখালো আরো কত কিছু করার ছিলো ওর, কত দেখার......

এতো পথ মানুষ যায় কী করে, তখনো কী গ্রাস করে ফিরে দেখার ক্লান্তি? হৃৎপিণ্ডের জল-সুনামি আমিও টের পাই। গন্তব্যহীন সময়ের শস্য এখন গোলার পোকা, নিউরনে পাথরের পাহাড়; তখন যদি কোন অনুজকে যেতে দেখি মন ভালো থাকে কী করে?

আর সে অনুজ যদি হয় চয়ন তাহলে..? চয়নদের বাসা এখন আর রেল লাইনের পাশে না। এখনো কুয়াশার দরোজা ভেঙে ট্রেনের আলো কুলাউড়া স্টেশন আলোকিত করে। আলোর আকালে পড়েছে এখন আমার কালের কেউ। চয়ন কালেই আকালের ছায়াবন্দি হলো। খর্বকায় জীবন ছিলো অনেকেরই, অনেক ক্ষণজন্মার- যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মন-খোয়ানো সিম্ফনির যাদুকর মোসার্ট, কবিদের কবি র‌্যাঁবো, সড়ক-শিল্পী বব মার্লি, জল-চোখ দিনলিপির এ্যান ফ্রাঙ্ক, স্বপ্নময় স্বপ্নের বক্তা লুথার কিং।

তাদের জীবন ছিলো বিস্তৃত, বিশাল। দীর্ঘকায় শীর্ণ জীবন উপভোগের, উপলব্ধির নয়, জীবন যাপনেই শেষ। আমাদের সময়ের ক্যাবল টিভির হিন্দি ছবি আনন্দের একটা ডায়ালগ ছিলো- ‘জিন্দেগী লাম্বি নেহি, বড়াহ হোনা চাহিয়ে’।

চয়ন জামানের জীবন দীর্ঘ না হলেও পাশে বড় ছিলো, অনেক বড়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত