গোলাম সাদত জুয়েল

২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ১৬:২৫

যীশু: হে পিতা, তুমি ওদের ক্ষমা করো

বড় দিন কি আসলেই বড় দিন। এটা কে বড় দিন কেন বলা হয় আজও জানা হল না। এটা খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় উৎসব তাই কি বড় দিন। আমেরিকায় বড় দিনকে যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে এটাকে হলিডে বা ছুটির দিন হিসাব পালন করা হয়। আসলে পুরো ডিসেম্বরে আমেরিকানরা হলিডে ক্রিসমাসের আমেজে কাটায়।

২৫ ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন, খ্রিস্টানদের ঘরে ঘরে আনন্দ। দু হাজার বছর আগে ফিলিস্তিনের জেরুজালেম এর বেথেলহেম নামক গ্রামে কুমারী মাতা মেরীর গর্ভে এক গোশালায় যীশু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আগে জানতাম খ্রিস্টানরা হয়তো একটি গোত্রের আমেরিকায় আসার পর দেখতে পেলাম খ্রিস্টানরা ৭-৮ জাতে বিভক্ত, তাদের বাইবেল এক নয়। নানা রংয়ের মিশ্রণে তারা বিভক্ত, রাস্তার ডানে বামে চার্চ আর চার্চ। সবাই বাইবেল অনুসরণ করে বলে কিন্তু তারা এক নয়। তারা বড় দিন পালন করে তবে তারা এক চার্চে যায় না। পেন্টাকোস্টাল, ক্যাথলিক, বাপটিস্ট, জাহোভা, সেভনস এনিভারস নানা নামে খ্রিস্টীয় ধর্ম পালন করছে।

যীশু যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন ইহুদিরা পরাধীন। ইহুদি রাজা হেরদ জ্যোতিষীর মাধ্যমে জানতে পারেন আশ্চর্য সংবাদ। এক সদ্যজাত শিশু ভবিষ্যতে হবে ফিলিস্তিনির রাজা। কিন্তু কোথায় জন্ম গ্রহণ করেছে নবজাতক তা জানতে না পেরে হেরেদ সকল নবজাতককে হত্যা করেন। হায়েনাদের হাত থেকে নবজাতককে বাচাতে মেরী নবজাতক যীশুকে গোপনে কোলে করে পালিয়ে যান মিশরে। হেরদের মৃত্যুর পর অবশেষে মা মেরী যীশুকে নিয়ে ফেরেন যিশুর জন্মস্থানে। পাপের পথ ত্যাগ করে আর্তমানবতার ও শান্তির কাফেলায় শামিল হওয়ার আহবান যীশু ধারণ করেন।

৩০ বছর বয়সে যিশু প্রকাশ্যে শুরু করেন শান্তির বানী প্রচার। অসত্য, অন্যায়, অন্ধকারের পথ পরিহার করে সত্য সুন্দরের পথে এগিয়ে আসার জন্য আহবান জানান সকলকে। শত্রুকে ভালবাসতে বলেন যীশু, তার আহবানে দলে দলে মানুষ সমবেত হতে থাকেন। বাড়তে থাকে তার অনুসারীরা, ইহুদি পুরোহিতরা তার শত্রুতে পরিণত হন। সে সময় জেরুজালেমে ইহুদিরা খুব জমজমাটভাবে পালন করত ধর্মীয় উৎসব। মন্দিরে মন্দিরে বলি দেয়া হত পশু। অকাতরে পশু বলি যীশুকে ব্যথিত করে তুলে। পরের বছর পূজার আগে পশু বিক্রেতারা পশু বিক্রি করতে জড়ো হলে জীব হত্যার কষ্ট অনুধাবন করে যীশু তাদের বাধা দেন পশু বিক্রিতে। পরে পশু বিক্রেতারা পশু বিক্রিতে বাধা প্রাপ্ত হয়ে নালিশ করে পুরোহিতদের কাছে। পুরোহিতরা ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল যিশুর নানা আচরণে।

পশু বিক্রেতারা ও পুরোহিতরা ইশ্বরদ্রোহী হিসাবে তাকে আখ্যায়িত করে তার বিচার দাবি করে রোমান সম্রাট পাইলটের কাছে। যীশুর বিশেষ আস্থাভাজন ১২ জন শিষ্যের মধ্যে জুডাসকে শত্রুরা হাত করে অর্থের লোভে রোমানদের হাতে ধরিয়ে দেয় যীশুকে। বিচারের নামে চলে প্রহসন, যীশুকে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। ক্যালভারী পাহাড়ে ক্রুশ কাঠে ঝুলিয়ে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে পেরেক মেরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় যীশুকে। মৃত্যুর আগ যীশু ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন-হে পিতা, তুমি ওদের ক্ষমা কর। এরা জানে না তারা কি করছে।

শান্তি-সম্প্রীতি ও ভালবাসা শান্তি দূত যীশু শান্তির ধর্ম প্রচার করেছেন। সারা বিশ্বের জনসংখ্যা সাত শত কোটি তার এক তৃতীয়াংশ মানুষ আজো যীশুকে ধারণ করে আছে। তার হত্যার ক্রুশ কাঠকে তারা সিম্বোলিক হিসাবে বহন করে থাকে। নানা শাখা-উপশাখায় বিভক্ত খ্রিস্টান ধর্ম আজও যীশুর ব্যাপারে এক ও অভিন্ন। শান্তির বানী, সম্প্রীতির বানী প্রচারক যীশু বিশ্বব্যাপী অসম্ভব জনপ্রিয়।

আমি যখন ছোট তখন মালনীছড়া চা বাগানে ৬টি মুসলিম পরিবার, ১টি খ্রিস্টান পরিবার ও কয়েকশত হিন্দু পরিবার। আমাদের মাসিমা (ধাত্রি) তিনি খ্রিস্টান। তিনি বড় দিনে আমাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতেনে। উনার বাসায় গিয়ে পাটিসাপটা পিঠা খেতাম। বড় দিন বলতে ওই মাসিমার বাসায় যাওয়া ও খাওয়া বুঝতাম। মাসিমার হাতে সারা বাগানের শত শত শিশু ভূমিষ্ঠ হত। নানা ধর্মের শিশুরা খ্রিস্টান মাসিমার হাতে পৃথিবীর আলো দেখতো। মাসিমা ছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর প্রতিকৃতি। একজন আদর্শবান খ্রিস্টান মহিলা। সারা বাগানের প্রসূতি মহিলাদের অবলম্বন ছিলেন মাসিমা। তিনি যেমন লেবারের ঘরে যেতেন ঠিক তেমনি বাবুদের ঘরে যেতেন ঠিক তেমনি সাহেবের বাংলোয় যেতেন। তিনটি শ্রেণীর কাছেই তিনি ছিলেন এক অনন্য মাদার তেরেসা।

আমেরিকায় ক্রিসমাস হচ্ছে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পাশাপাশি হলিডে। আমরা যারা মুসলিম তারা এ হলিডেকে উপভোগ করি। আমেরিকানরা পুরো ডিসেম্বর মাসটা তাদের বাসা বাড়ী আলো দিয়ে আলোক উজ্জ্বল করে রাখে। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের উপহার দেই। আমার প্রতিবেশী ব্রাজিলিয়ান এভেলিন আমাদের ঈদের সময় নানান ‍উপহার দেন, আমার বাচ্চারা এভেলিনকে ক্রিসমাসে অনেক গিফট দেয়। প্রত্যেকের কাজের জায়গায় ক্রিসমাস পার্টি হয়, নানান ডেকোরেশনে কাজের জায়গায় হলিডেকে সেলিব্রেট করা হয়। চলে ভেকেশনের নানা আয়োজন। আমাদের দেশে ঈদে নানা উৎসবে চলে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা আর আমেরিকায় হচ্ছে ঠিক তার বিপরীত। আমেরিকায় হলিডে শপিং এ চলে নানান সেল, নাগরিকদের উৎসব পালনের বাজেটের কথা মাথায় রেখে চলে দাম কমানোর প্রতিযোগিতা। ক্রিসমাসে যাতে সবাই সবাইকে উপহার দিতে পারে তাই সবগুলো দোকানে কম মূল্যে জিনিস বিক্রি করা হয়।

নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাতে থ্যানক্স গিভিং ডে থেকে শুরু করে ক্রিসমাস ডে ও তারপর নিউ ইয়ার সব মিলিয়ে পুরো দেড় মাস চলে আমেরিকার হলিডের আমেজ। স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধাবেলার ক্রিসমাসে ইভ ও ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস ডে হল আমেরিকানদের জন্য বছরের সবচেয়ে আনন্দের দিন। ক্রিসমাসের দিন যারা কাজ করে তাদেরকে হলিডে বোনাস দেয়া হয়। অনেকে বোনাস পাবার আশায় কাজ করতে চায়, আবার অনেকে ভাল ভাবে উৎসব পালনের জন্য মাস দুয়েক আগে থেকে ছুটির আবেদন করে।

প্রবাসী বাংলাদেশীরাও ক্রিসমাসের ছুটিতে বাচ্চাদের স্কুলের লম্বা ছুটিতে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। অনেকে বাংলাদেশ বা সৌদি আরব চলে যান। বাংলাদেশী পিতা মাতারা বাচ্চাদের আনন্দ দেবার জন্য নানা পার্কে ঘুরতে নিয়ে যান। দু সপ্তাহের স্কুল ছুটিতে হলিডের আমেজে অনেক প্লান করে থাকেন তারা। বড় দিন হলেও আমেরিকায় দিনটা খুব একটা বড় নয়, রাত বড়। আমার এ সময়টায় নিউইয়র্ক, মিশিগান, বাফেলো, শিকাগো, নিউজার্সি অনেক শহরে বরফে ঢাকা। সেখানকার আমেরিকানদের ক্রিসমাস অন্যরকম। ক্রিসমাসের এ আনন্দঘন মুহূর্তে প্রবাসী বাংলাদেশীরা আনন্দ খোজার চেষ্টা করেন নানান আঙ্গিকে।

গোলাম সাদত জুয়েল, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত