উজ্জ্বল রায়

০৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ১৯:৫০

স্মরণ : এডভোকেট নিখিল কুমার অর্জ্জুন

এডভোকেট শ্রী নিখিল কুমার অর্জ্জুন আমাদের মাঝে নেই। চার বছর আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি তাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। তিনি ৬ জানুয়ারি ২০১৩ ইংরেজি রবিবার সকাল ৭.০০ ঘটিকায় (২১শে পৌষ ১৪১৯ বাংলা) মৃত্যুবরণ করেন।

শ্রী নিখিল কুমার অর্জ্জুন ১৯৪৪ সনের ২৫ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার নন্দীউড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা স্বর্গীয় নর্ম্মদা কুমার অর্জ্জুন এবং মাতা স্বর্গীয় বীণাপাণি অর্জ্জুন। তিনি ১৯৬১ সনে রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিক, ১৯৬৩ সনে সিলেট মদন মোহন কলেজ হতে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬৬ সনে একই কলেজ হতে বি.কম পাশ করার পর ১৯৭৩ ইংরেজি সনে সিলেট ল কলেজ হতে এল.এল.বি ডিক্রী লাভ করেন। অতঃপর ১ নভেম্বর ১৯৭৪ ইং তারিখ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত হয়ে ১৮ নভেম্বর ১৯৭৪ সনে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে আইনপেশা শুরু করেন আমৃত্যু আইন পেশায়ই নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ ইং সনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে তালিকাভুক্ত হন।

ব্যক্তিগত জীবনে ৭ ভাই ২ বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় ছিলেন। বিবাহিত জীবনে প্রয়াত শ্রী নিখিল কুমার অর্জ্জুন ১ পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। প্রয়াতের স্ত্রী পূরবী অর্জ্জুন ১৯৯৬ ইং সনে পরলোকগমন করেন। তাঁর ছেলে নিলোৎজ্যোতি অর্জ্জুন শুভ একজন ব্যবসায়ী। কাকাত ভাই দেবাশীষ অর্জ্জুন (নূপুর দা) সিলেটের সবুজ বিপণী মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী।

সিলেট জেলা বারে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমি তাঁর শিক্ষানবিশ হই। তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার শিক্ষা ও উপদেশ আমার আইনজীবী জীবনের পাথেয় হয়ে রয়েছে। যোগদানের পর থেকেই তিনি আমাকে সর্বোতভাবে যে কাজ আছে সে কাজ দেখাবার এবং শেখাবার চেষ্টা করতেন। সব জুনিয়রের প্রতি একই রকম ব্যবহার করতেন। যখনই কোনো জুনিয়র তার কাছে কোনো বিষয়ে সাহায্য চাইতো, যতক্ষণ না বিষয়টা জুনিয়রের কাছে পরিষ্কার হতো বা বুঝতে পারতো ততক্ষণ তিনি সময় দিতেন।

এডভোকেট শ্রী নিখিল কুমার অর্জ্জুন-এর ব্যক্তিত্ব ছিল অতি আকর্ষণীয়। তাঁর ব্যক্তিত্বে এমন একটা মোহনীয় আকর্ষণ ছিল যে, আইনজীবী মহল এবং বিচারকদের নিকট তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল। তাঁর আইনের জ্ঞান ছিল অসাধারণ। ভাষা ছিল তীক্ষ্ম ও সাবলীল। তাঁর মুসাবিদা সে আর্জি হোক, জবাবই হোক বা হোক আপিলের হেতুবাদ সবই তার লেখনিতে স্বচ্ছ, স্পষ্ট হয়ে উঠতো। তাঁর রচনায় কোন বাহুল্য ছিল না। তেমনি ছিল কোর্টে তার উপস্থাপনা। তিনি কখনো উচ্চ কণ্ঠে কথা বলতেন না। তার ভাষা ছিল বিনম্র। আদালতে তিনি কখনও অযাচিত কথা বলে সময় নষ্ট করতেন না। তিনি অল্প কথায় জটিল বিষয়বস্তুকে সহজ বোধ্য করে তুলতে পারতেন। আদালতের সামনে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ।

তিনি ছিলেন খুবই মর্যাদাবান ও আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন ব্যক্তি। তাঁর মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সবাইকে আকৃষ্ট করতো তিনি পেশার প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আজীবন স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়েই কাজ করে গেছেন। কোনদিন কোন দল বা গোষ্ঠীর কাছ থেকে কোন প্রকার সুবিধা নেননি। দানশীল এই ব্যক্তি জীবনের শেষ সময়কাল পর্যন্ত পরিশ্রম করেছেন। কখনও কারও অনুগ্রহ কামনা করেননি।

তিনি সিলেট রাম কৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি আশ্রমের পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি প্রায় প্রতিদিন সিলেট রাম কৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমে যেতেন এবং আমি, তার দাদা শ্রী বীনয়েন্দ্র নাথ অর্জ্জুন (বিনু দা), ভ্রাতুষ্পুত্র নীলাঞ্জন অর্জ্জুন কানুনঞ্জ (নীলম), ক্লার্ক জ্যোতির্ময় চৌধুরী তার সঙ্গী হতাম। তাঁর সাথে রাম কৃষ্ণ মিশন ও আশ্রম, সিলেট এর অধ্যক্ষ স্বামী চন্দ্র নাথ নন্দ, মাহারাজ এর বিশেষ সুসম্পর্ক ছিল। তিনি চৌহাট্টা ভোলানন্দগিরি আশ্রমের ট্রাষ্টি বোর্ডের সদস্য এবং মীরাবাজার ভাগবদ সংঘের উপদেষ্টা ছিলেন।

তিনি রবি ঠাকুরের কবিতা ভালো আবৃত্তি করতে পারতেন। তাঁর চণ্ডীপাঠ এবং ভাগবদ পাঠ বিশেষ শ্রুতিমধুর ছিল। তার জুনিয়রদের মধ্যে অন্যতম শ্রী কল্যাণ চৌধুরী এডভোকেট সিলেট আইন পেশায় স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী প্রয়াত শ্রী নিখিল কুমার অর্জ্জুন এডভোকেট-কে সিলেটের আইন জগতে একজন বলিষ্ঠ দিকপাল হিসেবে সবাই তাকে সারাজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

  • উজ্জ্বল রায় : আইনজীবী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত