সুজাত মনসুর

০৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ১২:৩১

ভাল থাকুন পরপারে দাদা ‘দুখু সেন’

খবরটা আকস্মিক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। তিনি দীর্ঘদিন যাবত দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন। হৃদযন্ত্রের সমস্যাতো ছিলই প্রায় তিনদশক থেকে। অসীম মানসিক শক্তির অধিকারী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হৃদরোগ তিন দশকেও কাবু করতে না পারলেও সাম্প্রতিক দুরারোগ্য ব্যাধি কাবু করে ফেলেছিল। তাই সমগ্র জাতিই জানতো তাঁদের প্রিয় পার্লামেন্টারিয়ান, বক্তৃতার যাদুকর সেনদার জীবন প্রদীপ ধীরে ধীরে নিভে আসছে। কিন্তু তিনি তাঁর কার্যকলাপে সবাইকে বুঝতে দিতেন না, তোমরা যা ভাবছো তা নয়। আমি আছি আরো অনেকদিন।

সর্বশেষ তিনি তা প্রমাণের জন্য নিজ এলাকাও ঘুরে এসেছেন। যদিও যেতে হয়েছে হেলিকপ্টারে। তাই সংবাদটি যখন এল তখন আকস্মিকই মনে হয়েছে। ভেবেছিলাম হয়তো এই গ্রীষ্মে দেশে গেলে দেখা হতে পারে। কিন্তু সে সৌভাগ্য আর হলো না।

দিরাই-শাল্লাবাসীকে কাঁদিয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সুরঞ্জিতদার মৃত্যু সংবাদটি আমাকে আনঅফিসিয়ালী দেশ থেকে ফোন করে জানায় বন্ধু নাজমুল হোসেন চৌধুরী চান মিয়া। তখন বাংলাদেশ সময় বিকেল পৌনে তিনটে (৪ জানুয়ারি)। আমি বিশ্বাস করিনি, সেও নিশ্চিত ছিল না। আমাকে খবর নিতে বলেছিল। দেশে ফোন করে জেনেছিলাম, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ল্যাব এইডে ভর্তি করা হয়েছে। আমার ধারণা তিনি ঐ সময়ই তাঁর মৃত্যু হয়, তবে ডাক্তাররা শেষ রাতে তা নিশ্চিত করেন।

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আর নৌকার বাঁধভাঙা জোয়ারের বিপরীতে কুঁড়েঘর প্রতীক নিয়ে প্রাদেশিক পরিষদে দিরাই-শাল্লা থেকে নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি এলাকার বয়স্কদের কাছে ছিলেন শুধুই দুখু সেন। বন্ধুদের কাছে সুরঞ্জিত, আমাদের কাছে সেনদা কিংবা সেন কাকা। তাঁদের পূর্ব পুরুষের বসতি শুনেছি ঢাকার বিক্রমপুরে। পেশাগত কারণে তাঁর বাবা দিরাইতে বসতি স্থাপন করেন। সেনগুপ্তের আর কোন ভাই-বোন জীবিত আছেন কিনা জানা নেই। শুধু এটুকু শুনেছি, তাঁর বাবা-মার অবর্তমানে দিরাইয়ের কয়েকজন মানুষের স্নেহ-ভালোবাসায় বেড়ে উঠেন দুরন্ত বালক সুরঞ্জিত।

মেধাবী ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তির অধিকারী হওয়া সত্বেও বালক দুখু সেনের লেখাপড়ার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না, যতটা না ছিল নাটক আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি। সেই নাটক পাগল লোকটির একরকম হেসে-খেলেই রাজনীতিতে পথচলা সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি। মাঝে-মধ্যে হয়তো হোঁচট খেয়েছেন। বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচিত হয়েছেন। অন্যের কালিমা নিজের গাঁয়ে মেখেছেন ইচ্ছে না থাকা সত্বেও। স্থানীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে নিরঙ্কুশ করার জন্যে চলতি রাজনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গাঁ না ভাসিয়ে পারেননি। তাঁকে ব্যবহার করে কিছু মানুষ হয়তো আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। তাঁর কিছু কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারিনি বলে নিজেই অনেক সময় কড়া ভাষায় কলম ধরেছি তাঁর বিরুদ্ধে, এসবই বাস্তবতা। কিন্তু একটি কথা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, সেনগুপ্তরা ক্ষণজন্মা। তাঁদের জন্ম যুগে যুগে হয় না, হয় শত বছরান্তে।

যে দুজন জননেতা আমাদেরকে বিশেষ করে ভাটি বাংলাকে বহির্বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আরেকজন হলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। রাজনীতিতে দুজনের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। কিন্তু সামাদ আজাদ সব সময়ই সেনগুপ্ত সম্পর্কে সমীহ করে কথা বলতেন। সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর সেনগুপ্ত এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, এখন আর রাজনীতি করে শান্তি পাব না। কেননা, সামাদ সাহেব রাজনীতির অংকটা অত্যন্ত ভাল বুঝতেন, তাঁর বিপরীতে রাজনীতি করে মজা পাওয়া যেত।

ঐ যে বললাম সামাদ আজাদ ও সেনগুপ্ত আমাদের ভাটি বাংলা বিশেষ করে দিরাই-শাল্লাকে বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছেন তা একটু সংক্ষেপে বর্ণনা করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কেননা, ঐ সময়টিই হল সেনগুপ্ত নামক পুষ্পটির পূর্ণ বিকশিত হবার সময়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের গণপরিষদের একমাত্র বিরোধীদলীয় সাংসদ ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যও ছিলেন। একে তো একমাত্র বিরোধীদলীয় নেতা, তেজদীপ্ত, বক্তৃতার যাদুকর সুতরাং তিনি একাই মাতিয়ে রাখতেন সংসদ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে সরকারের সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলা, সর্বোপরি, নতুন সংবিধানে স্বাক্ষর না করা প্রভৃতি কারণে তিনি বিশ্ব মিডিয়ার নজর কাড়তে সক্ষম হন। তাই তিনি যখন তেয়াত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্টমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের বিরুদ্ধে দিরাই-শাল্লা আসন থেকে প্রার্থী হন এবং তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতা গড়ে তুলেন, তখন সারাবিশ্বের মিডিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল ভাটি-বাংলার এ নির্বাচন কাভার করার জন্য। নির্বাচন চলাকালীন সময় প্রায় প্রতিদিনই দিরাই-শাল্লা বিষয়ক খবর অন্তত: বিবিসির সংবাদের অংশ হত। সে নির্বাচনে তিনি হেরে যান। সত্তর থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি প্রতিদ্বন্ধিতা করেছেন, আটাশির নির্বাচন ব্যতিত। দুবার হেরেছেন সরাসরি আরেকবার আদালতের মাধ্যমে।

উনসত্তর-সত্তর সাল থেকে খুব কাছ থেকে দেখার-জানার সুযোগ হয়েছে। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে দুবার। একবার ছিয়াশি অথবা সাতাশি সালে তিনি তখন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরেরবার চুরানব্বই সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেবার পর যখন দিরাইতে সিরিজ জনসভা করেন। সে সময় আমিও বছর খানেক দিরাইতে ছিলাম বিলেত প্রবাসী হবার আগে। সেই সময় প্রতিটি জনসভাতেই উনার সাথে যোগদান এবং বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিল। আর আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি যখন সোহরাওয়ার্দীতে চিকিৎসাধীন ছিলেন তখন আমিও সে সময় হাসপাতালে ছিলাম আমার বড় ভাগ্নির চিকিৎসার জন্য। রাতে দাদার কেবিনেই আমি থাকতাম। কেননা, জয়া বৌদির পক্ষে রাতে তাঁর সাথে অবস্থান করা সম্ভব ছিল না।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা যে উনাকে কতটুকু পছন্দ ও শ্রদ্ধা করতেন তার একটি প্রমাণ সেদিন আমি পেয়েছিলাম হাসপাতালে। দিরাইতে সবেমাত্র ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সম্ভবত: দাদার সমর্থিত কোন প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন কিংবা এমন কোন ঘটনা ঘটেছে দাদা রাগ করে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। বাইরে বৌদি মুখ কালো করে বসে আছেন আর নীরবে চোখের জল ফেলছেন। আমি ঘুমুতে এসে এ দৃশ্য দেখে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, দাদা কারো অনুরোধেই দরজা খুলছেন না, সুতরাং বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ের, হার্টের রোগি। ডাক্তাররাও ভরসা পাচ্ছেন না। আমার মাথায় তাৎক্ষণিক একটা কথা খেলে গেল। বৌদিকে বললাম, উনি যদি সরাসরি বত্রিশ নম্বরে গিয়ে আপাকে (শেখ হাসিনা) বিষয়টি বলেন, তাহলে তিনি চলে আসতে পারেন। দাদা আওয়ামী লীগে যোগদান না করলেও আট দলীয় জোটের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে আপার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। বৌদি তাই করলেন এবং আধা ঘণ্টা পরে দেখি সত্যিই সত্যিই জননেত্রী শেখ হাসিনা এসে হাজির, দেখে মনে হচ্ছিল তিনি হয়তো ঘুমুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আপা এসেই দরজায় নক করে ডাক দিতেই ভিতর থেকে দরজা খোলে গেল আর বৌদির মুখের কালো দুশ্চিন্তাময় ভাব দুর হয়ে একটা প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠলো। সেই সময় দাদা রাতের বেলা আমাকে তাঁর জীবনের অনেক কথাই বলতেন। দিরাই-শাল্লা নিয়ে অনেক পরিকল্পনা তাঁর ছিল। কতটুকু করতে পেরেছেন জানিনা।

শেষবার দেখা হয়েছিল প্রায় এগারো বছর পরে ২০১৫ সালের নভেম্বরে। শুধু তাঁর সাথে দেখা করার জন্যই আমি সাড়ে তিনশ মাইল দুরের শহর থেকে লন্ডন ছুটে গিয়েছিলাম। সেদিন অনেক কথাই হয়েছিল। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, দেশের রাজনীতি দূষিত হয়ে গেছে। তিনিও সেই দূষণ থেকে দুরে থাকতে পারেননি। বাস্তবতার কারণেই তাঁকে এমন কিছু মানুষের উপর নির্ভর করতে হয়েছে, যারা কিছুদিন আগেও পোষ্টারে বঙ্গবন্ধু ও আর তাঁর ছবি দিয়ে খুনের মামলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধু ও তাঁকে অপমান করেছে। তাঁর সাথে রাজনৈতিক বিরোধের ইতিহাস যত দীর্ঘ, মেলবন্ধনের ইতিহাস তেমন নয়। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাঁর অবস্থান ও সিদ্ধান্ত আমাদের মধ্যে দূরত্বের পরিধি এতো বাড়িয়ে দিয়েছিল যে, তিনি যখন অতি সম্প্রতি লন্ডন ঘুরে গেলেন, অনেকটা লজ্জায় দেখা করতে যাইনি। কিন্তু তিনি যে অতি দ্রুতই চলে যাবেন তা যদি জানতাম, তাহলে হয়তো সকল দ্বিধা পরিত্যাগ করে দেখা করতে যেতাম। বলতাম, দাদা গড্ডালিকা প্রবাহে গাঁ না ভাসিয়ে বিপরীত স্রোতে নৌকা বেয়ে হলেও যদি দিরাই-শাল্লার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারতেন তাহলে আপনি অমর হয়ে থাকতেন কোন ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়েও। কিন্তু বাস্তব বড় রূঢ়।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা পৃথিবীতে ভুল-শুদ্ধ মিলিয়েই অমর হয়ে থাকবেন। পরপারে ভাল থাকুন দাদা দুখু সেন। আপনার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।

  • সুজাত মনসুর: ব্রিটেন প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত