আশিক শাওন

২১ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ২২:১৫

‘ভাষা সৈনিক গোলাম আযম’ : একটি সাধারণ পাঠ

১.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্বকালীন সময়ে, ১৯৪৭ থেকে ৬০ এর দশক পর্যন্ত ডাকসুর ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) এবং জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলির ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) এবং জেনারেল সেক্রেটারীরা (জিএস) এই দায়িত্ব পর্যায়ক্রমিকভাবে পালন করতেন। এর ধারাবাহিকতায়, ১৯৪৭-৪৮ সালে মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক ডাকসুর জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) পদে মনোনয়ন লাভ করেন ফজলুল হক মুসলিম হলের জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) গোলাম আজম।

২.
১৯৪৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত আন্দোলন পুনরায় দানা বেঁধে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি সমাবেশ আয়োজন করা হয়; যাতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি বাংলা ভাষা সম্পর্কিত দাবি ও East Bengal Legislative Assembly (EBLA)-তে গৃহীত প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন করার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত রেখে একটি দাবিনামা প্রস্তুত করা হয়। এই দাবিনামাটি তৈরি করেন আব্দুর রহমান চৌধুরী; যেটি চূড়ান্ত করার কাজে জড়িত ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুবসহ ‘স্টুডেন্টস একশন কমিটি’র নেতৃবৃন্দ। নিয়মানুসারে দাবিনামাটি পাঠ করার কথা ছিলো ডাকসুর তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) অরবিন্দ বোস এর; কিন্তু তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত ভাষা আন্দোলনের দাবি সংবলিত মানপত্রটি একজন হিন্দু ছাত্রকে দ্বারা পাঠ করালে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এবং মুসলিম লীগ সরকার এ নিয়ে নানা প্রকার প্রচারণা শুরু করবে– এই আশংকায় দাবিনামাটি পাঠের দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) গোলাম আজমকে।

৩.
২৭ নভেম্বর ডাকসুর পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বরাবর এই স্মারকলিপি পাঠ করেন গোলাম আযম; যেখানে ভাষা সম্পর্কিত বিষয়ে লেখা ছিলো কেবল একটি লাইন- 'We have accepted Urdu as our Lingua Franca but we also feel very strongly that, Bengali by virtue of its being the official language of the premier province and also the language of the 62% of the population of the state should be given its rightful place as one of the state languages together with Urdu.'

৪.
১৯৭০ সালের ১৯ জুন প্রকাশিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার সংবাদে বলা হয়- 'পশ্চিম পাকিস্তানের শুক্কুরে ১৮ই জুন (১৯৭০) এক সংবর্ধনা সভায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন, উর্দু পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা। তিনি বলেন, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনিও তাতে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তা ভুল হয়েছিল।'

১৯৭০ সালের ২০ জুন ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়- 'বাংলা ভাষার আন্দোলন করা ভুল হইয়াছে' শিরোনামে একটি সংবাদ, যেখানে গোলাম আযম এর বক্তব্য প্রকাশিত হয়। সেখানে তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়- ‘মুসলমানদের অধিকাংশ তমদ্দুন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত আছে। বাংলা ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই সঠিক কাজ হয়নি।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দিকেই শহীদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং সেই ঘটনাটিকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন গোলাম আযম। তার বরাত দিয়ে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকার ১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে লেখা হয়- 'আইয়ুব খানের গভর্নর আজম খান ছাত্রদের খুশি করার জন্য যে শহিদ মিনার তৈরি করলেন তাকে পূজামণ্ডপ বলা যেতে পারে, কিন্তু মিনার কিছুতেই না। যাই হোক, সেনাবাহিনী সেই কুখ্যাত মিনারটি ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ গড়ে শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন জেনে দেশবাসী খুশী হয়েছে।'

৫.
গোলাম আযমের ভাষা সংগ্রাম সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর বলেন, 'মানপত্র পাঠ- ভাষাসৈনিক হিসাবে গোলাম আযমের দৌড় কিন্তু এ পর্যন্তই। আর ভাষা সৈনিক কামাল লোহানী বলেন, 'গোলাম আযম ভাষা সৈনিক ছিলেন না। কখনই ছিলেন না। স্বাধীনতা বিরোধীরা তাকে ওটা বানাতে চেয়েছে। এই অপপ্রচারের একটি লাগসই জবাব ভাষা সৈনিক মতিন ভাই দিয়েছেন এভাবে- ‘গোলাম আযমের পিঠে চড়ে আমরা তখন ভাষার দাবির পোষ্টার দেয়ালে লাগিয়েছি। ...'

তথ্যসূত্রঃ
 - ভাষার প্রশ্নে গোলাম আযমের ভেলকিবাজি। মামুনুর রশীদ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ১৫ জুলাই ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত।
 - বদরুদ্দিন ওমর। ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি।
 - গোলাম আযম। জীবনে যা দেখলাম। ১ম খন্ড।
 - ড. মোহাম্মদ হান্নান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। পৃষ্ঠা নং: ৩৯৯।
 - দৈনিক আজাদ। ২০ জুন ১৯৭০ তারিখে প্রকাশিত।
 - সম্পাদকীয়ঃ ‘ইতিহাস কথা বলে’। দৈনিক সংগ্রাম। ১৬ জুলাই ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত।

 

আশিক শাওন : লেখক 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত