আশিক শাওন

২৬ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ১৭:৪৯

অভিজিৎ রায় : আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী

সভ্যতার বিকাশ একদিনের ফলাফল নয়; প্রচলিত মতবাদ আর ধর্মবিশ্বাসের বিপরীতে শত শত মুক্তচিন্তক ও সত্যের সাধকের মৃত্যুর সোপান বেয়েই আজকের এই পৃথিবী। যদি পৃথিবীতে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতবাদ বা ধর্মবিশ্বাসই বহাল থাকতো তবে পৃথিবী আজও সূর্যের চারদিকে ঘুরতো! অথচ, প্রচলিত এধরনের ধ্যান ধারণার সমালোচনা করায় হত্যা, আত্মহত্যা আর নির্যাতনের মধ্য দিয়েই আজকের এই সত্যগুলোর প্রকাশ। বিগত ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিও ডঃ অভিজিৎ রায় নামক এমনই এক সাধকের মৃত্যু ঘটে ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের নিকট রাজপথের ধূলিতে ঘাতকের চাপাতির আঘাতে! বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার বিকাশের আন্দোলনের সাথে জড়িত ডঃ অভিজিৎ রায় বাংলাদেশ সরকারের সেন্সরশিপ এবং ব্লগারদের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের সমন্বয়ক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করতেন।

২.
২০১২ সালে শিক্ষায় ‘একুশে পদক’ জয়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ড. অজয় রায় আর শেফালী রায়ের প্রথম সন্তান অভিজিৎ’এর জন্ম ঢাকাতে ১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তারিখ। অসাধারণ মেধার অধিকারী ১৯৮৮ সালে এসএসসি ও ১৯৯০ সালে এইচএসসি পাশ করে ঐ বছরই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)’এ যন্ত্র প্রকৌশলে ভর্তি হন। লেখাপড়ার পর কর্মজীবন শুরু করেন অটবিতে। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)’এ যোগ দেন প্রভাষক হিসাবে; চাকরিরত অবস্থায় বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে সিঙ্গাপুরে যান অভিজিৎ। তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর (NUS) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স এবং বায়োমেডিক্যালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে চলে যান জর্জিয়ার আটলান্টায় এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করতেন।

৩.
ডঃ অভিজিৎ রায় ২০০১ সালে কয়েকজন প্রগতিশীল লেখককে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেন “মুক্তমনা” ব্লগটি। এই ব্লগে তার ১০৮টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তমনা ব্লগটি ২০০৪ সালে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্লগ হিসেবে জার্মান ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস থেকে The BOBs (Best of the Blogs) পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। ২০০৭ সালে মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার আর মানবাধিকার ও সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্যক অবদান রাখার জন্যে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই ব্লগটিকে “শহীদ জননী জাহানারা ইমাম” স্মৃতি পদক দিয়ে ভূষিত করে। এই পদকে লেখা রয়েছে – “বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুক্তচিন্তার আন্দোলনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে “মুক্তমনা” ওয়েব সাইট। ... ২০০১ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, “মুক্তমনা” তখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনের পাশাপাশি আর্ত মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এবং ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত নির্বিশেষে মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য “মুক্তমনা” ওয়েব সাইটকে “জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক ২০০৭” প্রদান করা হল।”

৪.
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অভিজিৎ রায়ের লেখা ১০টি বই প্রকাশিত হয়েছিলো। বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে অকপটে লিখেছেন, যেগুলোতে তিনি প্রচলিত কুসংস্কার, সামাজিক অনাচার ও নিপীড়নকে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। পেশায় প্রকৌশলী হওয়ায় তিনি ছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখিতে সিদ্ধ-হস্ত। তার প্রকাশিত বইগুলো হলো: ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫), ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ (২০০৭), ‘স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’ (২০০৮), ‘সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ (২০১০), ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (২০১১), ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ (২০১২), ‘ভালবাসা কারে কয়’ (২০১২), ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ (২০১৪), ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ (২০১৪) এবং ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’ (২০১৫)।

২০০৫ সালে প্রকাশিত তার প্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’তে তিনি মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও সেগুলোর বিশ্লেষণ করেছেন। ২০০৭ সালে ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ শিরোনামে তার ২য় বইটি প্রকাশিত হয় সহলেখক ফরিদ আহমেদ’এর সাথে যৌথভাবে, যাতে তারা পৃথিবীতে প্রাণের উৎস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন। ২০০৮ সালে অভিজিৎ লিখেন ‘স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’, যেখানে মুক্তচিন্তা সম্পর্কিত তার ভাবনাগুলিকে তিনি যুক্তির নিরিখে উপস্থাপন করেছেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ শীর্ষক বইয়ে তিনি সমকামিতার জীব-বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট এবং এর আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। ২০১১ সালে রায়হান আবীর’এর সাথে সম্মিলিতভাবে লিখেন ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি, যেখানে ধর্মবিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে প্রচলিত কুসংস্কার এবং বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের বিস্তারিত বিবরণ। ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘ভালোবাসা কারে কয়’ বইটিতে তিনি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা ইত্যাদি মানবিক অনুভূতির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে, যেটিতে তিনি তুলনামূলক আলোচনার দ্বারা বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের মধ্যকার পার্থক্যগুলো নির্দেশ করেছেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় তার অষ্টম গ্রন্থ ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’; এতে তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে, যেটিতে তিনি বিশ্বাসের দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয়ে কিভাবে অমানবিক আচরণ ও কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে তার বর্ণনা দিয়েছেন। আর, ২০১৫ সালে ঠিক মৃত্যুর দিন প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’, যেটিতে রবীন্দ্রনাথের পত্রমিতা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে চমৎকার আলোচনা করার পাশাপাশি তাদের মধ্যকার সম্পর্ক তুলে ধরেছেন।

৫.
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮:৪৫-এর দিকে ঢাকায় চলমান একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের উল্টো দিকের সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ফুটপাথের নিকটের রাস্তায় তিনি হামলার শিকার হন। কয়েকজন আততায়ী তার মাথা ও গলায় চাপাতি দিয়ে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান; বাধা দিতে গিয়ে তার স্ত্রী বন্যাও হামলার শিকার হন। সেখান থেকে উদ্ধার করে অভিজিৎ ও বন্যাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান অভিজিৎ রায়। চিকিৎসকরা জানান, চাপাতির জোরালো আঘাতে ঘাড় থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার মাথা; অস্ত্রোপচারের পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শেষ ইচ্ছানুসারে তার মরদেহ দান করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আর আর্ত মানবতার সেবায়।

এই বর্বর আক্রমণের ঘটনায় সারা বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষ ভীষণভাবে মর্মাহত হয়। জাতিসংঘ থেকে প্রেরিত এক বার্তায় এই ঘটনাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে তুলনা করে নিন্দা করা হয়ে। এই হামলার প্রতিবাদ আর নিন্দা জানায় দেশ-বিদেশের মানবাধিকার আর প্রগতিশীল সংগঠনগুলো।

৬.
ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থানের ‘অপরাধ’এ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চক্ষুশূলে পরিণত হওয়া অভিজিৎ রায়ের বই ২০১৪ সালে অনলাইনে বই কেনার ওয়েবসাইট ‘রকমারি’ থেকে হুমকির মুখে সরিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৬ সালে তার বই প্রকাশের অপরাধে একই কায়দায় চাপাতির আঘাতে আক্রান্ত হন প্রকাশক আহমেদ টুটুল; ২০১৭ সালের ঢাকায় অনুষ্ঠিত একুশে বইমেলায় অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে কোন স্টলে বিক্রি করা হয়নি তার বইগুলো। বিপরীতে ২৪ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে 'দি হেগ ফ্রিডম বুক ফেয়ার-২০১৭' (The Hague Freedom Book Fair- 2017) শীর্ষক চারদিন ব্যাপী একটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

পূর্বসূরিদের অনুসরণে অভিজিৎ রায়রা যে মুক্তচিন্তার প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করে গেছেন, তা বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এক অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্তস্বরূপ। যুগে যুগে এসকল মুক্তচিন্তকগণের রক্তে রঞ্জিত পথ বেয়েই এগিয়ে চলে মানবতা আর বুদ্ধির বিকাশ। মুক্তচিন্তা আর মানবতার জয় হোক!

আশিক শাওন : লেখক 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত