মো. আব্দুল মতিন

০৭ এপ্রিল, ২০১৭ ১০:১৫

প্রধানমন্ত্রীই পারেন হাওরে কৃষকের কান্নাজলের ‘নিদানের’ ঢেউ থামাতে

সুনামগঞ্জ সহ ৭টি জেলার কোটি মানুষের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন এক-ফসলি রবি শস্য বোরো ধান। এবারের চৈত্রে অপ্রত্যাশিত অবিরাম আগাম বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢলের তাণ্ডবে কাঁচা থাকতেই তলিয়ে গেছে। গত বছরে কৃষকরা আশানুরূপ ফসল তুলতে না পারার কষ্ট তো আছেই। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলার। এখানে প্রায় সব কৃষকরা হয়েছেন সর্বস্বান্ত।

প্রাপ্ত তথ্যে এখানে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির প্রায় সব ফসল তলিয়ে গেছে।

শরীরের ঘামে-শ্রমে, ঋণ করে, সুদ করে নিজের ও দেশের মানুষের পেটে অন্ন যোগানোর মহান ব্রতে এই কৃষকরা  সৎভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত থেকে অর্ধাহারে, অনাহারে, শত গ্রামীণ-হাওরি প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বপ্ন দেখে এবারের বাম্পার ফলন হয়তো তাঁদের পুরাতন ও নতুন দু:খ ঘুচাবে। প্রকৃতির খামখেয়ালি, বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন, তাদের জীবন নিয়ে কিছু মানুষের ব্যবসা এগুলো তাঁরা চিন্তা করার সময়েই। দুমুঠো পেটের ভাত, সসম্মানে জীবন যাপনের ব্যবস্থা যে সরকার করতে পারে তাঁকে তাঁরা কৃতজ্ঞচিত্তে সমীহ করার দারুণ ক্ষমতা তাঁদের আছে।
বোরো ধান তাঁদের সন্তান; ফসলের সোনালী হাসিই জীবনের হাসি আনন্দ। সেই ফসল ডুবে যাওয়া ;সন্তান পানিতে ডুবে যাওয়ার কষ্টের মতো। বৈশাখ মাস তাঁদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়; সারাবছরের অন্নের সংস্থান,আনন্দ হাসি, স্বপ্ন পূরণের উৎস। এই মাসে অসুখ হলে ও তা দেখার সময় হাতে নেই। প্রিয় জনের মৃত্যুর সংবাদও তাঁদের কাছে শোকের বার্তা নিয়ে আসেনা; ' মা মরা কুলা আওর' (মা মারা গেলেও কুলা দিয়ে লুকিয়ে রাখতে হয় যাতে বৈশাখের কাজে বিপত্তি না ঘটে)। সেই হাওর পারের কৃষকরা আজ সন্তান-সম ফসল হারিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে হাওরে, কৃষাণীরা গৃহে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সন্তানের অনাহারের কষ্টে, জ্যৈষ্ঠ মাসে বিয়ের তারিখ ঠিক করে রাখা মেয়েটি নিজেকে অলক্ষ্মী-হতভাগী ভেবে লুকিয়ে কান্নার কষ্টে আহত কৃষাণ-কৃষাণীর আর্তনাদ বলে শেষ করার মতো নয়। হাওরের ভাসান পানি আজ কৃষকের কান্নার জল; যে জলে  'নিদান' (হাভাত)-এর ঢেউ জেগেছে। সেই সর্বনাশা নিদানের ঢেউকে থামানোই এখন সময়ের দাবি।

নিজের চোখে দেখা কৃষকের আহাজারি ভুলা কঠিন। ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও সহস্র কৃষকরা বিক্ষুব্ধ হতে শুরু করেছেন, প্রশাসনকে স্মারকলিপি দিচ্ছেন, পাউবো আর পিআইসি সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের লুটপাটের জন্য বিচার দাবী করছেন কৃষকরা, কোথাও আবার তাঁদের ধরে মারপিটও করছেন কৃষকরা বিচ্ছিন্নভাবে। কৃষকের এন্টিথেসিস হচ্ছে  লুটেরা কর্মকর্তা, দলীয় কর্মী, কৃষক না হয়েও সাজা ভণ্ড কৃষক-নেতা/ নেত্রী ও তাদের দোসররা (যাদেরকে বঙ্গবন্ধুও মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন)।

প্রশাসন সক্রিয়ভাবে খেয়াল রাখছে কৃষকের এই সাময়িক শ্রেণী সচেতনতা যেন শ্রেণী সংগ্রামে রূপ না নেয়। কারণ এই সাধারণ কৃষকরা তেভাগা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ করার মতো অসাধারণ সংগ্রামের অতীত ইতিহাস আছে। আপাতত সেদিকে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।

আবেগে ব্যস্ত থাকা, ব্যস্ত রাখা কৃষকদের পেটের ক্ষুধা নিবারণে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়া এই মুহূর্তে বাস্তবিক অর্থে অন্য কোন পথ নাই। 

আর চরম দুর্যোগকালে জীবনের প্রতিকূলতা মোকাবিলায় পথ দেখানো নায়ক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন দর্শনই আমাদের একমাত্র শেষ ঠিকানা। তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'-তে বর্ণিত দু:খ দুর্দশা এদেশে আর দ্বিতীয় কেউ ভোগ করেছেন বলে জানা নেই। শত কান্নার ভিড়েও আমি এই গ্রন্থটি পড়তে পড়তে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শান্তি পাই। যার ভূমিকায় তাঁর সুযোগ্যা তনয়া, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণটি হাওরের কৃষকের দু:খ নিয়ে লিখতে ভেসে উঠল, "তাঁর জীবনে জনগণই ছিল অন্ত: প্রাণ। মানুষের দু:খে তাঁর মন কাঁদত। বাংলার দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন- এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর মনে। যে কারণে তিনি নিজের জীবনের সব সুখ আরাম আয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা"।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যে রক্তের উত্তরসূরি, যার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আপনি দিনরাত জীবনবাজি রেখে কাজ করছেন; আপনিই পারেন দেশের মোট জনসংখ্যার ১/৮ ভাগ হাওরপারের কৃষকের কান্নার জলের নিদানের ঢেউ থামাতে।

আপনি সারা দেশেরই খবর রাখেন এবং আপনি কিছু একটা করবেন নিশ্চয়ই। 'ভাত দে, কাপড় দে' মিছিল কিংবা মঙ্গায় পেটের দায়ে 'ভুখা মিছিল' সেটা ছোট পরিসরে ও হোক  আপনি ক্ষমতায় থাকতে সেটা আমরা দেখতে চাইনা।

  • মো. আব্দুল মতিন: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, শাহজালাল মহাবিদ্যালয়, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত