রাজু আহমেদ

০১ ফেব্রুয়ারি , ২০১৮ ১২:১৬

কোটা কাঠামোতে সংস্কার জরুরি

সরকারি চাকুরি সন্ধানীদের নিত্যদিনের স্বপ্ন কোটার কুঠুরিতে আটকা পড়ছে। বিশ্বে বোধহয় একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে চাকুরি সন্ধানীদের শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা থেকে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

কোটার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আপত্তি ছিল কিন্তু বর্তমানে কোটার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া প্রায় বিদ্রোহাত্মক। আশার কথা, দেশের শিক্ষাবিদ, সচেতন মহল ও বুদ্ধিজীবীদের বৃহদাংশ কোটা প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। দেশের সর্বত্র কোটার বিরুদ্ধে স্লোগান উঠতে শুরু করেছে। মূলত রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ছাড়া কোটার যাতনা থেকে জাতির মুক্তি সহজ হবে না। তবে রাজনীতিবিদরা যদি কোটা সংরক্ষণকে ভোট ব্যাংকের হিসেবের সাথে গুলিয়ে ফেলেন কিংবা কোটা পদ্ধতির সংস্কারের কথা বললে ভোটের ক্ষতি হওয়ার ভয় করেন তবে তাদের সে ভাবনা বুমেরাং হতে পারে। কেননা মেধা কোটার চেয়ে বর্ধিত কোটার যন্ত্রণায় ছাত্রছাত্রীদের বৃহদাংশের যে প্রতিক্রিয়া তাতে যে কোন সময় রাষ্ট্রে স্বাভাবিক চলা বিঘ্নিত হতে পারে।

নানাবিধ কারণে কোটার কাঠামোয় সংস্কার জরুরি। সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে যে ৫৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে তা আদৌ ব্যত্যয় ঘটছে। প্রথমত: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন তথা সংবিধান, দ্বিতীয়ত: যোগ্যদের সেবা থেকে রাষ্ট্র কাঠামোর বঞ্চিত হওয়া।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ এবং ২৯নং অনুচ্ছেদে সুযোগ ও সরকারি নিয়োগ লাভে নাগরিকদের সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি স্পষ্টীকরণের স্বার্থে এ পর্যায়ে সংবিধান থেকে এ দু’অনুচ্ছেদকে উদ্ধৃত করবো। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ নং অনুচ্ছেদের (১) দফায় বলা হয়েছে, সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র চেষ্টা করবে। (৩) দফায় বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদে (১) দফায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ থাকবে। ৩ (ক) উপদফায় বলা হয়েছে, নাগরিকদের মধ্যে যে-কোন অনগ্রসর অংশ যেন রাষ্ট্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে এই উদ্দেশ্যে তাদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা যাবে।

২৯ (৩) (ক) অনুচ্ছেদ বলেই সরকারী নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির অবতারণা করা হয়েছে। যে ৫৫ ভাগ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরি কোটা সর্বোচ্চ এবং তা শতকরা ৩০ ভাগ যা সমগ্র কোটার অর্ধেকেরও বেশি। নিঃসন্দেহে মুক্তিযোদ্ধা তথা যারা প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়েছেন তারা এ মাটির শ্রেষ্ঠ ও সোনার সন্তান। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে তাদের অগ্রাধিকার ন্যায্য পাওনা। তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটা সংবেদনাত্মক হওয়ায় খুব বেশি খোলাখুলি কথা বলার সুযোগ নাই। তবে দু’টো কারণে এখানেও কিঞ্চিৎ সংস্কারের দাবী যৌক্তিক।

প্রথমত: স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ৪৭ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রকাশ করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। গণমাধ্যমে সংবাদ এসেছে, সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধাদের যে বাছাই হয়েছে তাতে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যারা বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থানে ছিল তাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছে আবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ বাদ পড়েছে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, স্থানীয় সরকারপন্থী নেতাদের প্রভাবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় বেশ প্রভাব পড়েছে। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশ তার সামর্থ্যানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারকে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করছে। প্রয়োজনে এটা আরও বর্ধিত কলেবরে মুক্তিযোদ্ধাদের আমৃত্যু সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস রাষ্ট্র গ্রহণ করুক। কিন্তু কোটার ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আনুপাতিক হার দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের কোটা তাদের সন্তান পর্যন্ত বর্ধিত রাখলে সেটা বোধহয় রাষ্ট্রের সবার জন্য মঙ্গল আনত। চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে যে আপত্তি উঠছে তা বোধহয় মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদের পর্যন্ত বর্ধিত না হলে উত্থাপিত হওয়ার যৌক্তিকতা থাকত না।

চাকুরিতে জেলা কোটা বর্তমান সময়ে বেশি হাস্যকর শোনায়। বাংলাদেশের ৬৪/৬৫ জেলার মানুষের মধ্যে কেউ কারো চেয়ে বেশি সুবিধা পাবে-এটা বোধহয় এখন আর কাম্য নয়। জেলা কোটা প্রবর্তনের শুরুর সময়ে এটা প্রাসঙ্গিক থাকলেও বর্তমান সময়ে এ রীতির বহাল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করার সাধ্য নাই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এবং পঙ্গু-বিকলাঙ্গদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা যৌক্তিক। কেননা বাংলাদেশের অন্যান্য মানুষ এবং গোষ্ঠীর তুলনায় এরা এখনো সত্যিকারেই পিছিয়ে। বাংলাদেশে প্রায় ৪৭টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাস করছে তবে কোটা প্রাপ্তির প্রশ্নে চাকমা সম্প্রদায় এককভাবে অগ্রবর্তী। এ রীতিতে কিছুটা সংস্কার জরুরি। জনসংখ্যার অনুপাত করে সকল নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কোটা সমানুপাতিক হারে বরাদ্দ করা উচিত।

নারী কোটার ক্ষেত্রে এখনও কিছু উচ্চারণ করার সময় আসেনি। কেননা আমাদের মা-বোনদের যারা উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পায় তাদের নানাবিধ প্রতিকূলতা উৎরে তারপরে পথ চলতে হয়। রাষ্ট্র যতদিন নারীদের পুরুষের সমানতালে মসৃণ পথ চলার নিশ্চয়তা দিতে পারবে ততদিন নারী কোটা সংরক্ষণ করে যাওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে। এই সমাজের কেউ কেউ উপহাস করে বলেন, নারীদের জন্য চাকুরিতে সুন্দরী কোটাও আছে! হোক উপহাস কিন্তু আমাদের মানসিকতায় এটা এখন ব্যাধিতে। সুন্দরীরা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এ মানসিকতা থেকে দায়িত্বশীলদের বের হয়ে আসতে হবে। সভ্যতার এ আলোতে যেন বর্ণ কোনরূপ বৈষম্য সৃষ্টি করতে না পারে। মানুষের যোগ্যতা বিচার করতে হবে কেবল তার দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে; চর্মের আকর্ষণ নয়। আশার কথা, নারীরা এগুচ্ছে। তাদের এ উন্নতি রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধির পথে হাতছানি দিয়ে ডাকবে।

দ্বিতীয়ত: কোটা পদ্ধতি বহাল রাখায় রাষ্ট্র যোগ্য ও মেধাবীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একজন কোটাধারীর চেয়ে একজন নন-কোটাধারী প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় স্বাস্থ্যবান নম্বর অর্জন করেও নিয়োগ না পাওয়ার কিংবা যোগ্যতর স্থানে অধিষ্ঠিত না হওয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে কম নয়। শুধু কোটার জোরে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এমন অনেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়তার এমন গুরুদায়িত্ব পাচ্ছেন যা পালনের প্রশ্নে ব্যর্থতায় রাষ্ট্রের উন্নতি থমকে থাকছে। রাষ্ট্রের উচিত, যোগ্যদের দ্বারা তার সেবা নিশ্চিত করা। এমন লাগামহীন কোটা পদ্ধতি বহাল রেখে রাষ্ট্র তার ইস্পিত গন্তব্যে খুব সহজে উপবিষ্ট হতে পারবে না বলেই অনুমিত। চাকুরিতে নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির প্রাচীর ছেদ করে যখন স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির কবলে পড়তে হয় তখন প্রকৃত যোগ্যদের আর রাষ্ট্রের সেবা করার ঠাঁই হয় না বরং রাষ্ট্রের নিয়ম-নীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ মানসিকতার সৃষ্টি হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রে যে সকল অপরাধের সাথে শিক্ষিত সমাজের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তারা কোথাও না কোথাও কোন অনিয়মের যাঁতাকলে পড়ে বঞ্চিত হওয়াদের একদল। কোটা প্রাচীরের সাথে বঞ্চিত হওয়াদের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দু’ভাবেই।

কিভাবে হতে পারে কোটা পদ্ধতির সংস্কার ? শুরুতেই মানতে হবে, কোটা পদ্ধতি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আলোর মুখ দেখাতে। কোটা পদ্ধতির বর্তমান যে কাঠামো তা সত্যিকারেই মেধাবীদের বঞ্চিত করছে। যে জন্য কোটা পদ্ধতির সংস্কার আশু আবশ্যক। কোন পরিবারের বাবা যদি কোটার কল্যাণে চাকুরি পান তবে সে পরিবারে আর তো কারো জন্য কোটা বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন থাকার কথা নয়। সরকারি চাকুরিতে যে সুযোগ-সুবিধা তাতে একজন চাকুরে অনায়াসে তার সন্তানদেরকে যোগ্য করে মানুষ করতে পারেন। চাকুরীজীবী সন্তান, তাদের সন্তানদের সন্তান-এদের জন্য চলন্ত নিয়মে কোটা সংরক্ষণ করা মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাথে উপহাস তুল্য। যারা রাষ্ট্র থেকে আর্থিক অনুদান পায় তাদের জন্য কোটার সংরক্ষণ একপ্রজন্ম পর্যন্ত বহাল রাখাই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবে। বংশানুক্রমিক ভাবে কোটা বহাল রেখে সাধারণদের অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত করা রাষ্ট্রের যৌক্তিক কাজ হবে না। কোটা পদ্ধতি বাতিল নয় বরং সন্তোষজনক সমাধানের জন্য কিঞ্চিৎ সংশোধনের মাধ্যমে এবং শূন্য কোটায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উন্মুক্ত সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্র যাতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের স্বান্তনা দিতে চেষ্টা করে, তেমন উদ্যোগ আলোয় আসুক। কোটা পদ্ধতিতে সংস্কারের মাধ্যমে শতকরা ৫৫ ভাগ থেকে যদি ৩০ ভাগে অবনমিত করা যায় তবে সেটা সব পক্ষের জন্যই মঙ্গলের হবে বলে ধারনা করছি।

রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টগণকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার অনুরোধ রইল।

  • রাজু আহমেদ: কলাম লেখক। ইমেইল: [email protected]
  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত