ডা. সাঈদ এনাম

২৬ অক্টোবর, ২০১৮ ১১:৪৪

মসজিদ ভাঙি, মন্দির ভাঙি

বিশ্ব মনোবিজ্ঞানী সম্মেলনের স্পিকার হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে যোগ দিতে যাই জাপানে। লোকাল ট্রেনে নারিতা ট্রেনস্টেশন থেকে ফোনাবাসী স্টেশনে নামলাম। উদ্দেশ্য সেখানে এক বাংলাদেশি ছেলে থাকে তার সাথে দেখা করা ও আমাদের ঢাকা মেডিকেলের এক ব্যাচমেটের সাথে দেখা করা।

মানসিক রোগ বিষয়ে কনফারেন্সে যোগ দিতে সুদূর বাংলাদেশ থেকে জাপান এসেছি, আর যদি নিজ দেশের পরিচিতজনদের সাথে দেখা করে না যাই তাহলে কেমন হবে? তাই দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম সেশন ও প্রেজেন্টেশন শেষে যত দ্রুত পারি বের হয়ে প্রথমে তাদের সাথে দেখা করবো পরে টোকিও শহরটাকে এক নজর একটু দেখবো।

গত দুদিন জাপান ঘুরতে আমরা কোন গাইড নেইনি। আমি ও যুবায়ের ভাই একাই ঘুরছি। এখানে চলতে ফিরতে সবাই গুগল ম্যাপ বা যে শহরে ঘুরবেন তার একটা ছাপানো ম্যাপ ব্যবহার করে। কারো কাছে যদি মোবাইল থাকে তাহলে সে গুগল ম্যাপে দেখে নেবে নাহলে রাস্তার মোড়ে বাস স্ট্যান্ড, পুলিশ বা শপগুলোতে ছাপানো ম্যাপ থাকে। ওটা দেখেই আপনি চলতে পারবেন। ম্যাপে প্রতিটি স্থাপনা, অলিগলি নির্দেশিত এবং কোন পথে, কোন বাহনে যাবেন, যেতে কত সময় লাগবে তাও বলা আছে।

স্টেশনে নেমে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। দুজনের একটু পানির তৃষ্ণা পেলে একটা শপে ঢুকলাম। পানি আর কোক নিলাম, সাথে নিলাম বাদাম ভাজা। ভদ্র মহিলা পানি, ড্রিংকস আর বাদাম দিয়ে জিগ্যেস করলেন আপনারা কি এখানেই খাবেন, নাকি হাঁটতে হাঁটতে খাবেন?

আমি বললাম, "ইচ্ছে ছিলো হাঁটতে হাঁটতে খাব, কিন্তু শহরের রাস্তাঘাট এতো পরিচ্ছন্ন, খাবার শেষে এই কোকের ক্যান আর বাদামের প্যাকেট কী করবো?"।

তিনি হেসে বিনীতভাবে বললেন, "অহ..! এই কথা? আমি আপনাকে ব্যাগ দিচ্ছি। খাবার শেষে ক্যান আর বাদাম প্যাকেট এই ব্যাগে রেখে দেবেন আর হাঁটতে গেলে কিছুক্ষণ পরপরই দেখবেন ডাস্টবিন রাখা, ওতে আলাদা আলাদা করে ফেলে দিবেন। কোথায় কোকের বোতল আর কোথায় বাদামের প্যাকেট ফেলবেন, সেটা লিখা আছে। যান যান মজা করে খান,..... আরিকাতু গুজাইমাসু"।

আমিও বললাম, "আরিকাতু... আরিকাতু"। দু দিনে বহুল ব্যবহৃত এ শব্দের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গিয়েছে।

জাপানে পরিচিত অপরিচিত প্রথম দর্শনে সবাই সবার মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে হালকা ঝুঁকে বাও করে। বাও করা মানে হলো সম্মান করা বা শান্তি কামনা করা। অত:পর বলবে "আরিকাতু গুজাইমাসু" বা "আরিকাতু"। মানে, "তোমাকে অশেষ অশেষ ধন্যবাদ, বা তোমাকে ধন্যবাদ"।

জাপানেই দেখলাম স্টল বা রেস্টুরেন্টে পুরুষ কর্মীর চেয়ে নারী কর্মী বেশি। ৮০ ভাগই কর্মকর্তা কর্মচারী তরুণী। যেমন স্টলে তেমন রেস্টুরেন্টে। অর্থাৎ এদের বেশিরভাগ কলেজ ভার্সিটি স্টুডেন্ট। তাদের এটা পার্ট টাইমজব।

এখানে শিশু কিশোর ব্যতিত সবাই কাজ করে। যে ক'দিন ছিলাম কোন শিশু কিশোরকে কাজে পাইনি। আমাদের দেশে সবখানেই শিশু-কিশোরকে কাজে পাওয়া যায়। ঢাকা শহরের বাড়িঘরে প্রচুর শিশুকর্মী আছে গৃহস্থালির কাজকর্মে।

জাপানে একেবারে আশি বছরের বুড়ো তারাও কাজ করেন। কাজ আলাদা ভাগ করা। রেডিসন হোটেল থেকে প্রতিদিন বের হয়ে আমরা নারিতা এয়ারপোর্টে যেতাম সেটাতে শিফট ওয়াইজ যারা ডিউটি করতেন তারা বেশ বয়স্ক ছিলেন।

একটু শক্ত কাজ তরুণ তরুণীরা করেন, আর হালকা কাজ যেমন শপিংমল বা রাস্তাঘাট থেকে টুকটাক ময়লা কাগজ সংগ্রহ করে জায়গা মতো ডাস্টবিনে ফেলা, পরিচ্ছন্ন রাখা, ড্রাইভিং করা, এ কাজগুলো অপেক্ষাকৃত বয়স্করা করেন।

এক সন্ধ্যায় আমি আর যুবায়ের ভাই হোটেল লনে বসি কফি খাচ্ছিলাম তখন দেখলাম অতিকায় এক বৃদ্ধা মহিলা এসে আমাদের সামনে রাখা ফুলের টবটি একটু মুছে দিয়ে গেলেন, যদিও সেটা মুছা ছিলো।

জাপানে ড্রাইভিং মানে কেবল সুইচ, বাটন টিপাটিপি। গাড়িগুলো সবই নতুন আর অটো। রাস্তা, লোকেশন, স্টপেজ গাড়ির সাথে প্রোগ্রামিং করা। কোথায় যাবেন, কোথায় থামবেন, কোন স্টপেজ সামনে এগুলো সব সেটিং করা থাকে। একটু পরপর মাইক্রোফোনে অটো বেজে উঠছে। ড্রাইভার সাহেবের কাজ কেবল খেয়াল রাখা আর সময় মতো বাটন চাপা। অনেক বয়স্কা মহিলারা ও ড্রাইভিং পেশায় আছেন। আর এখানের পাবলিক বাসগুলোতে প্রিপেইড কার্ড আছে অথবা বক্স আছে নামার সময় হয় কার্ড টাচ করাবেন বা বক্সে টাকা দিয়ে দিবেন। ভাঙতি প্রয়োজন হলে বক্স থেকেই নিবেন, বা এটেন্ডেন্ট আছেন তাকে বললেই হবে। কিছুক্ষণ পর পর তিনি এমাথা টু ওমাথা হেঁটে যান। তার কাছে ছোট মাইক্রোফোন আছে।

জাপানে কাজের ছোট বড় নেই। সবই সমান। তাছাড়া সবাই সবাইকে অতি সম্মানের চোখে দেখেন। প্রথম দর্শনেই বাও করেন। সেটা প্রধানমন্ত্রী হন বা সাধারণ নাগরিক হন কিংবা হন না কেনো একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। কে কাকে আগে সম্মান দেবে, শুভেচ্ছা জানাবে, এটাই তাদের কাছে মুখ্য, এটাই নিয়ম। এটাই তাদের ছোটবেলা থেকে শিখিয়ে দেওয়া হয়।

জাপান বেড়াতে গেলে আপনি যে একজন মানুষ সেটা বোধহয় জীবনে প্রথম মনে হবে। আমাদের দেশে বা আশেপাশের দেশগুলোতে কারো কাছে টাকা থাকলেই কেবল তাকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়, সেটা একটা জন্তু জানোয়ারেরও যদি থাকে কিংবা একটা চোরের। সেই চোর সম্মান পাবে, বা সে আপনার কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নেবে। আর টাকা না থাকলে আপনি যত ভালো মানুষই হন, যত বিদ্বান হন, আপনার কানাকড়ি কোন দাম নেই।

জাপানিজরা মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা শেখে ছোটবেলা থেকেই। সবাই খুব পরোপকারী। মনে হয় একজনকে উপকার করতে পারলেই তার দিনটা সার্থক হলো। এটা যেমন জাপানের সাধারণ মানুষের বেলায় তেমনি জাপানের পুলিশের বেলায়।

ভিজিটর বা ফরেইনার সামনে পড়লে যেচে এসে বাও করবে জিগ্যেস করবে, "তোমাদের কোন কিছু লাগবে কি?", "পথ দেখিয়ে দেবো?" অথবা "তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে গন্তব্য চিনতে?"। বাস বা ট্রেনের লাইনে দাঁড়ালে আপনাকে সামনে জায়গা করে দেবে বা অফার করবে।

যে ক'দিন ঘুরেছি মসজিদ মন্দির প্যাগোডা কোথাও চোখে লাগেনি। মাঝেমধ্যে মনে হতো, এরা ধর্মকর্ম করেনা তাহলে এতো মনুষ্যত্ব এতো মানবিকতা তারা শিখলো কোত্থেকে?

আমাদের দেশে গলিতেগলিতে, পাড়ায়-পাড়ায় ধর্মীয় স্থাপনা, প্রতিষ্ঠান। ধর্মীয় উৎসব পালনেও আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। তবুও তাদের তুলনায় আমরা এক অসভ্য আর নোংরা জাতি। আমরা এক ধর্মের লোক আরেক ধর্মের লোকদের দিকে হিংসার দৃষ্টিতে তাকাই। মসজিদ ভাঙি, মন্দির ভাঙি। আমাদের ধর্ম আমাদেরকে মানুষ করতে পারেনি। আমাদের ধর্মীয় দীক্ষা কেবল মসজিদ মন্দির গির্জা আর প্যাগোডা ভিত্তিক। ধর্মীয় কাজ শেষে বাইরে বের হলেই আমরা নেমে পড়ি অন্যায় অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। কাজে তাইতো আমাদের মাঝে অসভ্যতা আর নোংরামির ছড়াছড়ি। আর আমাদের মধ্যে যারা ধর্ম পালন করেনা, তারা অবস্থা আরও খারাপ।

বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন বা যারা নিজেকে সবসময় দেশপ্রেমিক ভাবেন, তাদের উচিৎ ভাবনায় দিনরাত নির্ঘুম না কাটিয়ে, চোখের নীচে কালো রেখা না টেনে, হামেশা দেশপ্রেমের চোংগা না ফুঁকে, গলাবাজি না করে, ফেইসবুকে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস না দিয়ে পারলে একবার জাপান ঘুরে আসা। কোন ডিগ্রি-টিগ্রি বা পিএইচডি করার জন্যে জাপান না। ডিগ্রি ডক্টরেট গত বিশ পঁচিশ বছর বাংলাদেশে বহু এসেছে।

এটা ব্যবহার হয়েছে কেবল নিজের আখের গুছাতে। আদার ব্যাপারীরা যায় জাহাজ বিক্রির উপর ডিগ্রি নিতে। এতে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। এসবে দেশের মঙ্গল সম্ভব হয়। ডিগ্রি বা ডক্টরেট না কেবল একটু শিখার উদ্দেশ্যে যদি কেউ জাপান যায় তবেই দেশের জন্যে মঙ্গল হবে বেশি। আমার জাপান যেতে হবে স্রেফ ঘুরতে, অল্প কিছুদিনের জন্যে। আর এ ঘুরার উদ্দেশ্য হবে আমি কিছু শিখতে চাই। আমি শিখতে চাই জাপানী সাধারণ নাগরিকের কাছ থেকে মানুষকে মূল্যায়ন করা, শিখতে চাই জাপানের একজন বাদাম বিক্রেতা বা একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাছ থেকে, কিভাবে তারা নিজের আবাসকে পরিচ্ছন্ন রাখে।

শিখতে চাই সব তরুণ তরুণীদের কাছ থেকে, কিভাবে তারা শ্রম দিয়ে ধ্বংসস্তূপ একটা দেশ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে। তাতেই বেসিক কিছু বিষয় শিখা হয়ে যাবে আমাদের । কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো, আমরা বিদেশ ভ্রমণ করি শপিং করতে, নাচ গান করতে কিংবা পারলে পালিয়ে গিয়ে দেশের বারোটা বাজিয়ে নিজের আখের গুছাতে। আমাদের বেসিক কিছু বিষয়ে এখনো বড় রকমের গলদ রয়েছে। আমরা মানুষকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করিনা।

আমরা স্বেচ্ছাচারী, ক্ষমতালিপ্সু একটা অলস প্রকৃতির মানুষ। মানুষকে আমরা মূল্যায়ন করি ক্ষমতা আর টাকা দিয়ে।

  • ডা. সাঈদ এনাম: লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত