ইনামুল আসিফ লতিফী

২১ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ ১০:২৩

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এবং আমরা

বাংলার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য দুটি গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে ‘বাংলা ভাষাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে আন্দোলন করার জন্য রাজপথে নেমে আসে। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাষায় প্রতিষ্ঠা করার এই আন্দোলনের দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের কাঁপিয়ে তোলে এবং তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ অমানবিকভাবে ও নির্বিচারে গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এবং আহত হন আরও অনেকে। বলা হয়ে থাকে যে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ভাগ এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়ে থাকে।

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি, এক্ষেত্রে সারা বিশ্বের সব জাতির জন্য আমরা রোলমডেল। কিন্তু সেই মহান শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষার কতটুকু শ্রদ্ধা ও সম্মান আমরা পুরোপুরিভাবে করতে পারছি তার প্রতি লক্ষ্য রাখাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

কথায় বলে স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। আদালতের আদেশের তিন মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো এক অজানা কারণে এখনও রাস্তাঘাটে ইংরেজি বর্ণের সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ও গাড়ির নম্বর প্লেট দেখা যায়। ব্যাপারটা আমাদের ভাষা শহীদদের ও ভাষা আন্দোলনের অর্জনকে অনেকটা ছোট করে ফেলে, ব্যাপারটা যেন নিজ ঘরেই বাংলা ভাষার পর হওয়ার মত একটা ব্যাপার। সত্য ঘটনা হচ্ছে যারা এরকম করেন তাদের মধ্যে বড় একটা অংশ হয়তো এব্যাপারে অবগতই নন। এখনও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অফিসের যাবতীয় কাজ ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে করা হয়। এর জন্য সরকার, প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর উচিত মহান ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ সবার নিকট ঢালাওভাবে প্রচার করা। এছাড়াও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার মাধ্যমেও এই সমস্যা অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে।

উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ (আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি ইত্যাদি) তাদের নিজস্ব ভাষায় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য যে বিপুল পরিমাণ শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে থাকে তা আমাদের অবশ্যই চোখ এড়ায় না, অথচ আমরা আমাদের দেশে এখনও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় ইংরেজিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি, নিজ মাতৃভাষাই হয়ে যায় তখন পর। এখনও সময় আছে, সম্মানিত গবেষকগণ মাতৃভাষা বাংলায় গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ভাল একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবেন।

সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাংলা ভাষায় গবেষণা কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য আলাদাভাবে শিক্ষাবৃত্তি ঘোষণা করতে পারেন। আমাদের নিজস্ব ভাষায় বিভিন্ন ধরণের গবেষণা কার্যক্রম যত বেশি হবে, ততবেশি আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনা বাড়বে। বাংলা সাহিত্যের মহাকবি হিসেবে খ্যাত মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারেন আমাদের জন্য, বিদেশি ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যখন বারবার ধাক্কা খেয়েছেন, ঠিক তখন নিজ মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য চর্চা করে তিনি আজও বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন।

ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে আমাদের দেশের শহুরে তরুণ সমাজের একটা অংশ এখন এখানে-সেখানে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারটাকেই এক ধরণের ওস্তাদি মনে করে। এ ধরণের একটা ভয়ংকর ব্যাপার আস্তে আস্তে আমাদের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেওয়ার আগেই আমাদের এগিয়ে আসা উচিত, এক্ষেত্রে বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত বাংলা অলিম্পিয়াড অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এরকম আরও ছোট-বড় উদ্যোগের মাধ্যমেই আমাদের নিজস্ব ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির চাপে পিষ্ট নতুন প্রজন্মের নিকট। শ্রদ্ধা জানাই সেসব প্রবাসীদের যারা কয়েকযুগ ধরে প্রবাসে জীবনযাপন করলেও তাদের উত্তরাধিকারদের বাংলা ভাষা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন পরিবারের মধ্যে ছোট পরিসরেই।

একুশে ফেব্রুয়ারি শোকাবহ হলেও এর যে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা পৃথিবীর বুকে অনন্য। বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতির ইতিহাস যতদিন এই পৃথিবীতে সমুন্নত থাকবে ততদিন বাঙালি জাতি এই মহান ভাষা সৈনিকদের বিনম্র চিত্তে স্মরণ করবে- ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’’। শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রইল আমাদের মহান ভাষা শহীদদের প্রতি, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা আমাদের মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার পেয়েছি।

  • ইনামুল আসিফ লতিফী: শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত