সঙ্গীতা ইমাম

০৫ মার্চ, ২০১৯ ১৯:৩৬

বিচারের বাণী আজও নিভৃতে কাঁদে

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল যশোর টাউন হল মাঠে- ১৯৯৯ সালের ৫ ও ৬ মার্চ। দু'দিনের এই সম্মেলনে সেজে উঠেছিল পুরো যশোর শহর। দেশের সকল জেলা শাখার প্রতিনিধি, কেন্দ্রীয়  প্রতিনিধিসহ ভারত থেকে আগত সংস্কৃতিজন, শিল্পীদের উচ্ছ্বল উপস্থিতিতে মুখর ছিল সম্মেলন প্রাঙ্গণ। এতো আনন্দ,  দেশীয় সংস্কৃতির এই মিলন মেলাই যেন চক্ষুশূল হয়েছিল মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর।

সম্মেলনের শেষদিন রাত একটা নাগাদ যখন হাসি-গান আর বর্ণিল ভবিষ্যতের স্বপ্নভরা নিদ্রাহীন চোখে খুশির ঝিলিক, যখন একটি সার্থক সফল সম্মেলন পূর্ণতা পাওয়ার মুহূর্ত, যখন লোকে লোকারণ্য টাউন হল মাঠে দর্শক বিমোহিত বাউল গানে; তখনই মঞ্চের ঠিক পিছনে অল্প সময়ের ব্যবধানে বিস্ফোরিত হয় আগে থেকে পুঁতে রাখা দুটি শক্তিশালী বোমা। হায় ৬ মার্চ! কেড়ে নিল দশটি তাজা প্রাণ। আহত হলো সহস্রাধিক সংস্কৃতিকর্মী।

অতর্কিত এই বিস্ফোরণে টাউন হল মাঠ পরিণত হয় রক্তাক্ত এক প্রান্তরে। আহত মানুষের আহাজারিতে বিদীর্ণ হয় রাতের নিস্তব্ধতা। প্রাণ হারান নূর ইসলাম, নাজমুল হুদা তপন, সন্ধ্যা রাণী ঘোষ, ইলিয়াস মুন্সী, শাহ আলম বাবুল, বাবুল সূত্রধর, শাহ আলম, বুলু, রতন রায় ও রামকৃষ্ণ। সহস্রাধিক  ছিন্নভিন্ন দেহ উৎসব মাঠকে করে তোলে গহীন মৃত্যুকূপ। যশোর শহর সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল স্বজন হারানোর শোকে। ফুল ব্যবসায়ীরা সব ফুলের দোকান বন্ধ করে দেন। তাঁরা বলেছিলেন, "এ নৃশংসতার পর এ শহরে ফুল বেমানান"। হাসপাতালের সামনে আহতদের রক্ত দিতে আসা মানুষের লম্বা লাইন হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে যায় বহুদূর। সুকান্ত, নাহিদ, হরেন গোসাইসহ আহতদের চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় যশোর হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয় ঢাকাস্থ পঙ্গু হাসপাতালে। চিকিৎসা চলে গণ-মানুষ ও সরকারী সহায়তায়। মাসের পর মাস চলে চিকিৎসা সংগঠনের কর্মীদের নিরলস শ্রম ও সেবায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক সহযোগিতায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে জার্মানি থেকে আমদানিকৃত কৃত্রিম পা প্রতিস্থাপিত হয় পা হারানো শিল্পীকর্মীদের।

এই মধ্যযুগীয় বর্বর নৃশংসতার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উদীচীর পাশে দাঁড়ায় দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ। "সংস্কৃতি দিবস" ঘোষণা করা হয় দিনটিকে।

উদীচীর দ্বাদশ সম্মেলনে বোমা হামলাকারীদের খুঁজে বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে উদীচীর সকল জেলা শাখার কর্মীরা দাবি জানান। মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলা আজও নিস্পত্তি হয়নি। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ঘুরে যায় মামলার কর্মকাণ্ড।

উদীচী হত্যাকান্ডের পর মামলা হলে ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামসহ ২৪ জনের নামে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। পরে তরিকুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দিয়ে দেয়। পরে ২০০৬ সালের ৩০মে যশোরের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল আদালত এ মামলার রায়ে ২৩ আসামির সবাইকে বেকসুর খালাস দেন। উদীচী ন্যায়বিচার হয়নি বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুনর্তদন্তের আবেদন করলে মামলাটির বর্ধিত তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হলে উদীচীর বোমা হামলা মামলা নতুন মোড় নেয়। এ বছরের ১৯ নভেম্বর আদালতে হরকাতুল জিহাদের নেতা হান্নান তার দেওয়া জবানবন্দিতে উদীচী বোমা হামলায় নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। তার স্বীকারোক্তিতে পুলিশ হরকাতুল জিহাদের সদস্য বরিশালের আবুল হোসেন ও মাদারীপুরের মাওলানা আবদুর রউফকে আটক করে।

এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর উদীচী মামলার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। ২০১১ সালের ৪ মে সরকারের দায়ের করা আপিলটি গ্রহণ করেন বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। এর ফলে, মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। এ মামলার খালাসপ্রাপ্তদের আবার আত্মসমর্পণের জন্য সমন জারির নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। এ সংক্রান্ত একটি পত্র ২০১১ সালের ২০ জুন যশোর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এসে পৌঁছায়। এরপর ২১ জুন খালাসপ্রাপ্ত ২৩ আসামির বিরুদ্ধে সমন জারি করেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। কিন্তু এর আগেই খালাসপ্রাপ্ত ২৩ জনের মধ্যে মহিউদ্দিন আলমগীর, আহসান কবীর হাসান ও মিজানুর রহমান মিজান নামে ৩ জনের মৃত্যু হয়। আদালতের কাছে তাদের মৃত্যুর কাগজপত্র দাখিল হওয়ায় বাকি ২০ জনের বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়। এক মাসের মধ্যে সবাইকে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে হবে। এরপর ১৭ জন বিভিন্ন সময়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেয়। কিন্তু, শফিকুল ইসলাম মিন্টা, শরিফুল ইসলাম লিটু ও সোহরাব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করায় তাদের বিরুদ্ধে ২৪ জুলাই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন আদালত। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি আটক হন এ মামলার অন্যতম আসামি শফিকুল ইসলাম মিন্টা। পরবর্তী সময় তাকেও এ মামলায় জামিন দেন আদালত। এ পর্যন্তই। এরপরে আর এ মামলার কার্যক্রম এগোয়নি।

দীর্ঘ ২০ বছরেও বিচার হয়নি দেশের প্রথম নৃশংস বোমা হামলার ঘটনাটির। যার পরিপ্রেক্ষিতে লাগাম ছাড়া সাহসী হয়ে ওঠে এই মৌলবাদী অপগোষ্ঠী।  এরপর তাদের দৌরাত্ম্য দেখা যায় রমনার বটমূলের নববর্ষের অনুষ্ঠানে,  পল্টনে সিপিবি'র জন সমাবেশে, একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের জন সমাবেশে, ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা করে। প্রথম হামলাটির যথাযথ বিচার ও সমুচিত শাস্তি হলে পরবর্তী ঘটনাসমূহ ঘটতো না বলেই বিশ্বাস করেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক মানুষ।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সারাদেশে এবং দেশের বাইরে প্রায় তিন শতাধিক শাখা সংগঠন রয়েছে। গণ-মানুষের সকল ন্যায্য দাবির পক্ষে সোচ্চার এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটি নিজের স্বজন হারানোর বিচার পায়নি দীর্ঘ ২০ বছরেও। আজও এই বোমা হামলায় আহতদের পাশে নিজের সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

আজ এই ২০১৯ সালের ৬ মার্চের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে উদীচীর দাবি, ১৯৯৯ সালের যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলাসহ সকল বোমা হামলার সুষ্ঠু বিচার হোক, প্রত্যেক নির্যাতিত বিচার পাক এবং এ ভূখন্ড থেকে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী নির্মূল হোক। নির্মূল হোক স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। বাহাত্তরের সেই অনন্য সংবিধানে ফিরে আসতেই হবে বাংলাদেশকে। অামাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ যেমন ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক সাহসী স্তম্ভ, আজও আমাদের সংস্কৃতিকে ঘিরেই প্রতিরোধ গড়তে হবে সকল স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী অপগোষ্ঠীকে। এই অবিনাশী লড়াইয়ে উদীচী তার সর্বস্ব নিয়ে সামিল।

জয় হোক মানবতার। জয় বাংলা। জয় উদীচী।

লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত