আবু নাসের আব্দুল হাই ছিদ্দেকী

০৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১০:৪৯

ধর্ষণ ঘটনায় শূন্য সহিষ্ণু নীতি জরুরি

দেশের এক মারাত্মক ব্যাধির নাম ‘ধর্ষণ’। পুরো জাতি ধর্ষণের যন্ত্রণায় শিহরিত। পত্রিকার পাতায় আর টিভির পর্দায় চোখ দিলেই দেখা যায় একের পর এক অমানবিক ধর্ষণ। সারাদেশে ধর্ষণের ছোবলে যেন ক্ষতবিক্ষত পুরো অভিভাবক মহল। দেশের আনাচে কানাচে সর্বত্র যেন ধর্ষণের ভয়াল থাবায় জর্জরিত। সম্প্রতি ডা. প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি জীবন দিতে হলো। গতকাল পশ্চিমবঙ্গের মালদায় এরকমই আরেকটি ঘটনা ঘটে গেল। এরকম প্রতি বছর হাজারো মেয়েকে অকালে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। হাজারো মায়ের অশ্রুতে ভারী হয়ে উঠছে সারাদেশে।

প্রিয়াঙ্কাকে ধর্ষণ-গণধর্ষণ করেই ধর্ষকেরা ক্ষান্ত হয়নি। ধর্ষিতা প্রিয়াঙ্কাকে তারা আরও বেশি ভয় করেছিলো। এতটাই যে ঐ ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তারা অকল্পনীয় নির্মম পন্থায় মেরে ফেললো। আমরা, আমাদের দেশ, প্রিয়াঙ্কার মা, বাবা, বোন, ভাই, আত্মীয়-স্বজন তার সহকারীরা কেউই আর তার জীবন্ত মূর্তি দেখার সুযোগ পাবে না। প্রিয়াঙ্কা তার সাহসিকা মূর্তি নিয়ে আজ পরপারে। নীরবে, নিভৃতে, এবং হয়তো বা সমাজের প্রতি ঘৃণার বোধ নিয়ে সেই অজানা অচেনা বিশ্বে বাস করতেও শুরু করেছে। হ্যাঁ, আমরা ঘৃণার পাত্র। আমরা আমাদের কাজে প্রতিনিয়ত তার পরিচয় দিচ্ছি। একজন প্রিয়াঙ্কা না কি? কত শত সহস্র প্রিয়াঙ্কা সারাদেশে ধর্ষিতা হচ্ছে প্রতিদিন-নিত্যদিন। আর ধর্ষিতার সংখ্যা যেন প্রতি মাসে বেড়েই চলেছে। আপনারই বিচার করেন এটা কতটা নির্মমতা। ধর্ষণ করার পর আবার জ্বালিয়ে ‘হত্যা’! এ যেন আরেক দহন যন্ত্রণা। এসকল নরপশুদের মৃত্যুদণ্ড কবে প্রকাশ্য হবে?

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে বিভিন্নভাবে নানা সময়ে ধর্ষণের জন্য ঘুরে ফিরে কেবলমাত্র মেয়েদেরকেই দায়ী করা হয়। এই ক্ষেত্রে মূল যে কারণটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বলে প্রতীয়মান তা হচ্ছে মেয়েদের শালীন পোশাক পরা। অনেকেই এই কারণটি দৃঢ় ভাবে সমর্থন করেন। যারা এই কারণটি মানেন, তারা মনে করেন, মেয়েরা হচ্ছে আগুনের মত এবং ছেলেদের যৌনসংযম অনেকটা মোমের মত। মোম যেমন আগুনের সংস্পর্শে আসলেই গলে যায় তেমনি অশালীন পোশাক পরা একজন নারীর সামনে একজন পুরুষ আসলে তারও ভদ্রবেশী মুখোশ গলে গিয়ে কামনাময় চেহারা বের হয়ে আসে। ফলে এই কামনাবৃত্তি মেটাতে গিয়েই ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটে। তারা কিন্তু আবার নীতিগত ভাবে ধর্ষণ সমর্থন করেন না। আবার আর একপক্ষ আছেন যারা মনে করে থাকেন, নারী ধর্ষণের জন্য কেবল মাত্র পুরুষদের অতি কামনাময় চরিত্র এবং অতি সংবেদশীল একটি শারীরিক অঙ্গই দায়ী। একজন নারীর অধিকার আছে তার ইচ্ছামাফিক পোশাক পরার। কিন্তু এই ক্ষেত্রে পুরুষরা একজন যৌনাবেদনময়ী নারীর দিকে চোখ নামিয়ে বা কামহীন দৃষ্টিতে তাকানো বন্ধ করতে পারে না দেখে তাদের দু পায়ের মাঝখানে একপায়া বিশিষ্ট তাঁবু সংক্রান্ত একটি সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং এই থেকে মুক্তি লক্ষ্যে পুরুষরা ধর্ষণ করে থাকেন।

প্রিয় পাঠক (পড়ুন সচেতন পাঠক), ধর্ষণের এই সামগ্রিক বিশ্লেষণ গত বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন ব্লগে ফেসবুকে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে আলোচিত হতে দেখেছি। আর প্রতিবারই আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছি কিছু গুণী মানুষের এহেন ব্লগীয় বিশ্লেষণে। সত্যি বলতে যে সমাজের এক অংশে এই ধরনের ধারনা প্রচলিত থাকে সেখানে নতুন করে ধর্ষণের কারণ খোঁজাটা সত্যি খুবই দুরূহ এবং কঠিন একটি ব্যাপার। কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত ধারনা ভেঙে নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ধর্ষণের মূল কারণ হচ্ছে কোন ব্যক্তির মানসিক বিকৃতি, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সামাজিক সচেতনতা, নারীপুরুষের সম অধিকারের অপব্যবহার এবং সর্বোপরি আইনের শাসনের প্রয়োগ না হওয়া।

দেখুন একজন মানুষ হিসেবে একজন নারী বা পুরুষ অবশ্যই তার ইচ্ছেমাফিক পোশাক পরতে পারে। এটা তার অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার। তবে তিনি কিভাবে এই অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রয়োগ কিভাবে করছেন সেটা বিবেচনার বিষয়। যেমন ধরুন, আপনি প্রকাশ্যে কোন মূল্যবান জিনিস প্রদর্শন করে নিয়ে যেতেই পারেন। এটা আপনার নাগরিক অধিকার। সেই সাথে আপনার সেই মূল্যবান জিনিসকে সঠিক নিরাপত্তার মাধ্যমে আপনার গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনার সচেতনতা এবং দায়িত্ব। এখন কোন কারণে নিরাপত্তাজনিত কোন সমস্যায় আপনি যদি আপনার মূল্যবান জিনিসটি হারিয়ে ফেলেন, তাহলে রাষ্ট্র যেমন দায়ী হবে তেমনি সচেতনতার অভাবে আপনিও কম দায়ী হবেন না। তখন যদি আপনি একতরফা ভাবে রাষ্ট্রকে দায়ী করেন তাহলে সেটা খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হবে না। আমি মনে করি পোশাক, আচরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে শালীনতার যে বিষয়টি বার বার বলা হচ্ছে তা মূলত শুধু কোন এক পক্ষের জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং শালীনতা একটি সর্বজনীন ব্যাপার। নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি সমান ভাবে প্রযোজ্য। যারা শুধু মাত্র নারীর পোশাককে ধর্ষণের জন্য দায়ী করেন তারা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। শুধুমাত্র অশালীন পোশাকের কারণে ধর্ষণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আর আমরা বিপুল সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা কখনও আলোর মুখ দেখার সুযোগ পায় না। লোকলজ্জার ভয়ে অথবা ছেলেপক্ষের দেনাপাওনার ভয়ে বা পুলিশের টাকার দাবি মেটানোর শক্তির অভাবে সেগুলি গোপনে চাপা পড়ে যায়। এভাবেই আমাদের সমাজে নারীরা অহরহ নিগৃহীত নির্যাতিত হচ্ছেন। আর আমরা দিব্যি উন্নয়নের বয়ান গাইছি। উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে তা ধিন তা ধিন করে নেচে দুনিয়া মাতাচ্ছি ঘরে ঘরে কান্নার বোলকে উপেক্ষা করে। যদি আমরা বিগত পাঁচ বা দশ বছরে কত হাজার মামলা পুলিশের খাতায় রেকর্ড হয়েছে চাইলেনই সে তথ্য সবিস্তারে হয়তো পেতে পারি। কতগুলি মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার পর বিচার কার্য শেষ হয়েছে সে তথ্য কিন্তু কেউ খোঁজ করি না। এ পর্যায়ে আদালতে দুই ধরণের ঘটনা ঘটে থাকে। এক বিচার শেষে আসামিদের কঠোর শাস্তি এবং দুই আসামিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তারা বেকসুর খালাস। তাই এই দুটি তথ্য পেলে হয়তো আমরা আরও আঁতকে উঠবো কারণ দেখা যেতে পারে হয়তো যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা খালাস পেয়ে গেছে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায়। সে ক্ষেত্রে ধর্ষিতাদের অবস্থা কেমন দাঁড়ায়? নতুন করে তাদের জীবনের ঝুঁকি বেড়েই যায় মাত্র। এটা বলছি এ কারণে যে ধর্ষণের ক্ষেত্রে, গণ-ধর্ষণ ব্যতিরেকে, আদৌ কোন সাক্ষী তো থাকে না-বিশেষ করে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। দ্বিতীয়ত: আমাদের সাক্ষ্য আইনটাও কিন্তু ধর্ষিতা নারীর অনুকূলে কি না তারও নতুন করে ভাবাটা অত্যন্ত জরুরি।

আমরা যদি ভারতে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের চিত্র দেখি তাহলে দেখব, ভারতে প্রতি ১৫৫ মিনিটে ১৬ বছরের কম বয়সী একটি শিশু ধর্ষিত হয়, প্রতি ১৩ ঘণ্টায় ধর্ষিত হয় দশ বছরের কম বয়সী একটি শিশু। ২০১৫ সালে ভারতে ধর্ষিত হয় দশ হাজারের বেশি শিশু ভারতে ২৪ কোটি নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে ভারত সরকারের এক জরিপে অংশ নেয়া ৫৩.২২ শতাংশ শিশু বলেছে তারা কোন না কোন ধরণের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুদের পূর্বপরিচিত বা এমন কেউ যাদের তারা বিশ্বাস করে।

নারী শিশুদের দৈহিক ও যৌন নিরাপত্তাহীনতা দেশে আজ এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কি রাস্তায় কি নদীর তীরে, কি স্কুলে, কি কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কি বাসে, ট্রেনে এবং এমন কি নৌকা যাত্রায়ও মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তা নেই এমন কি নিজ বাড়িতেও। পাশের ঘরের ছেলে যদি ধর্ষক হয় তবে আর কাকে দোষ দেওয়া যাবে? এ যেন এক ঘন ঘোর অন্ধকারের পাল্লায় পড়েছে আমাদের নিবু নিবু করে জ্বলতে থাকা সভ্যতার সলতেটুকু। কারণ এখন এমন অবস্থা হয়েছে, ‘নারী তুমি যেখানেই থাকো কিছু সংখ্যক মানুষরূপী পশুর বাঁকা দৃষ্টি তোমাকে আচ্ছন্ন করবেই।’ তুমি দুধের শিশু হও, আর স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ো কি না সেটা বড় কথা নয়। তুমি শাড়ি কিংবা টিশার্ট পরো কি না সেটাও বড় কথা নয়। বড় বিষয় হচ্ছে তুমি নারী। তোমাকে আমার নেতিবাচক দৃষ্টির কাছে ধরা দিতে হবে। তা না হলে তোমাকে পুড়িয়ে দেবো। কখনো আগুনে, কখনো অ্যাসিডে আবার কখনো বা বাস থেকে ফেলে। পুরুষতান্ত্রিক এই চিন্তা আমাদের সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে ফেরাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।

আমরা ধর্ষণের ঘটনায় শূন্য সহিষ্ণু নীতি চাই। বিচার ব্যবস্থা এবং আইন পেশায় যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদেরও এব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা দরকার। সামাজিক ব্যাধি ধর্ষণের অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি চাই। এই কাজ কেবল সরকার কিংবা প্রশাসনের নয়, আমাদের সকলের দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ আমাদের এই আতঙ্ক দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

পরিশেষে আমি বলতে চাই আমাদের জীবন যাপন এবং আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার মাপ কাঠি হওয়া উচিত আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি ধারক ও বাহক। আমরা চাই না কেউ তার ব্যক্তি স্বাধীনতার বা ব্যক্তি অধিকারের অপব্যবহার করুক। আমরা চাই না আমাদের দেশের আর কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হোক। আমরা চাই না আমাদের দেশের কোন নারী মাথা নিচু করে চলুক। রাস্তায় আতংক নিয়ে চলুক। আমরা চাই নারী পুরুষের সহ অবস্থান এবং তা প্রচলিত সুষ্ঠু ধারার ভিত্তিতে।

  • আবু নাসের আব্দুল হাই ছিদ্দেকী : বছলা, করিমগঞ্জ, আসাম

আপনার মন্তব্য

আলোচিত