আসিফ মোক্তাদির

০১ এপ্রিল, ২০২০ ২০:৩৩

ব্যয়বহুল, তবু চিকিৎসাসেবায় পিছিয়ে আমেরিকা

আমেরিকা নাম শুনলেই প্রথমে সবার মাথায় আসবে উন্নত জীবনব্যবস্থার কথা। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী এই দেশ নাগরিকদের জন্য উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সব সময়ই সচেষ্ট। এক্সিওস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, আমেরিকায় ২০১৮ সালে চিকিৎসা খাতে ব্যয় করা হয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি মার্কিন ডলার, যা ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, স্পেন, কানাডার মতো দেশগুলোর জিডিপি থেকেও বেশি।

ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামে একটি সংগঠন বলছে, পৃথিবীর আর কোন দেশে চিকিৎসা খাতে আমেরিকার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয় না। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালে এই খাতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে ব্যয় করা সাড়ে তিন লাখ কোটি ডলারের মধ্যে প্রায় ৫৯ শতাংশ ব্যয় করা হয় বিভিন্ন হাসপাতাল, চিকিৎসক এবং ক্লিনিক্যাল সেবা খাতে।

ন্যাশনাল হেলথ এক্সপেনডিচার থেকে প্রকাশিত ২০১৮ সালের এক তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রত্যেক নাগরিকের পেছনে চিকিৎসার জন্য গড়ে প্রায় ১০ হাজার ২২৪ ডলার ব্যয় করা হয়। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে যা অনেক বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সুইজারল্যান্ডে ব্যয় করা হয় প্রায় ৮ হাজার ৯ ডলার। এরপর যথাক্রমে জার্মানিতে ৫ হাজার ৭২৮ ডলার, সুইডেনে ৫ হাজার ৫১১ ডলার, অস্ট্রিয়াতে ৫ হাজার ৫৪০ ডলার ব্যয় করা হয়। একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে হয়তো বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করা হয়ে থাকে। তবে আমেরিকায় চিকিৎসা খাতে একজন নাগরিকের পেছনে এই ব্যয় করা অর্থ অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে অনেক বেশিই বলা যায়।

চিকিৎসা খাতে ব্যয়ের এ রকম পরিসংখ্যান দেখে হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন, চিকিৎসার জন্য আমেরিকা বিশ্বে সমাদৃত। কিন্তু এ ধারণা আপাতদৃষ্টিতে ভুল। এ ধারণা কেন ভুল, বিভিন্ন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে এবার তা দেখে নেওয়া যাক। ২০১৯ সালে আমেরিকায় শিশু মৃত্যুর হার প্রায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমেরিকায় শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। সুইজারল্যান্ডে ৩ দশমিক ২, জার্মানিতে ২ দশমিক ৯, স্পেনে ২ দশমিক ২ শতাংশ।

ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকানদের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ৭৮ দশমিক ৭ বছর, যা অন্যান্য উন্নত দেশ থেকে কম। গবেষকেরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হলো, মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ এবং অ্যালকোহল জাতীয় নেশাদ্রব্য গ্রহণ। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১১৫ জন আমেরিকান মাত্রাতিরিক্ত আফিম জাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণের কারণে মারা যাচ্ছে।

আমেরিকায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে পরিসংখ্যান দেখলে অনেকেই আঁতকে উঠবেন সেটি হচ্ছে, ভুল চিকিৎসা। জন হপকিন্স কলেজের একদল গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখের বেশি মানুষ ভুল চিকিৎসায় মারা যায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটিই সত্যি। অন্যান্য প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। হৃদযন্ত্রের ব্যাধি ও ক্যানসারে ভুল চিকিৎসার জন্য মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকার পরেও ভুল চিকিৎসার সংখ্যা এত বেশি হওয়ার পেছনে গবেষকেরা ভুল রোগ নির্ণয়, কম্পিউটার সিস্টেমে ভুল, যন্ত্রপাতির ত্রুটি, সঠিক নিয়মে ওষুধ গ্রহণ না করা, চিকিৎসকদের ভুলকেই দায়ী করছেন।

বিভিন্ন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে তুলনা করার জন্য হেলথ কেয়ার ইনডেক্স নামে অনলাইনে একটি জরিপ করা হয়। এতে কোন দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা যেমন চিকিৎসার মান, হাসপাতাল, ডাক্তার, যন্ত্রপাতির পেছনে খরচাদি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা ব্যবস্থার তুলনা করা হয়। এই জরিপ অনুযায়ী, চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমেরিকার অবস্থান বিশ্বে ৩০তম। প্রথম স্থানে রয়েছে তাইওয়ান। এরপর যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রিয়া ও ডেনমার্ক। শুধু হেলথ কেয়ার ইনডেক্স নয়, এ রকম আরও অনেক প্রতিবেদন ও জরিপ রয়েছে যেখানে চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমেরিকার অবস্থান অনেক পেছনে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, চিকিৎসা খাতে এত অর্থ ব্যয় করার পরও আমেরিকা পিছিয়ে আছে কেন? চিকিৎসা খাতে ব্যয় করা অর্থ শুধু যে জনসাধারণের চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে এমন নয়। জনসাধারণের চিকিৎসা নয়, বরং চিকিৎসার পেছনে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক জিনিসেই বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। ব্যয় করা এই অর্থের অর্ধেকেরও বেশি ব্যয় করা হয় হাসপাতাল নির্মাণ, হাসপাতাল উন্নয়ন, ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে। তা ছাড়া বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ার কারণেও এ খাতে খরচ বাড়ছে।

২০১৯ সালে বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এত অর্থ ব্যয় করার পরেও আমেরিকার মতো দেশ চিকিৎসার ক্ষেত্রে এখনো জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত