করোনাজয়ের উৎসব

 প্রকাশিত: ২০২০-০৫-১২ ২১:৪৭:৩৪

 আপডেট: ২০২০-০৫-১২ ২১:৪৮:৪৬

আসিফ মোক্তাদির:

তারপর। অনেক দিন আগের কথা। এ কয়েকদিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠলেও আজকে জয়নালের কী যেন তাড়া আছে। অনেকদিন সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠা হয় না। ভেন্টিলেটর দিয়ে হালকা রোদের আভা আসছে। অনেকদিন বাইরে বের হওয়া হয় না। তাই এ রোদের ঝাঁঝ কেমন তাও বুঝবার উপায় নেই। উদাস হয়ে রোদ মিষ্টি নাকি ঝাঁঝালো তা বুঝার চেষ্টা করছে সে। তখনই একটা প্রশ্ন মাথায় আসল, নরওয়েতে যখন বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সূর্য ওঠে না তখন সবার ভিটামিন-ডি'র আসল উৎস কী? চাইলেই গুগল ঘেঁটে দেখে নেওয়া যায়৷ তবে এ প্রশ্নের সুরাহা এখন না করলেও হবে।

বিজ্ঞাপন

সকাল ৭ টা ৪২ মিনিট। দেরি না করে এক লাফে বিছানা থেকে ওঠল সে।

আজকে একটা বিশেষ দিন। প্রায় ১৮১ দিন করোনার তাণ্ডবের জন্য ঘরে বন্দি থাকার পর গতকাল ঘোষণা করা হয়েছে আজ থেকে পৃথিবীতে আর কোন করোনা রোগী নেই। পৃথিবীর সর্বশেষ করোনা রোগী সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন। বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া সবজায়গায় ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে। সব জায়গায় মানুষজনের সে কি আনন্দ! করোনাকে পরাজিত করে শেষ পর্যন্ত জয় হল মানব সভ্যতার। আজ থেকে সবাই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে। এ যেন নতুন এক পৃথিবী৷ আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত সবাই মারামারি করছে কার আবিষ্কৃত ভ্যাক্সিন বেশি কার্যকরী।

আনন্দ মিছিল বের হবে আজকে। সারাদিনব্যাপী উৎসব লেগেই থাকবে। আজকে আর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কোন দাঙ্গা হবে না। সব ধর্মের, সব বর্ণের লোক করোনা বিজয়োৎসব করতে একসাথে রাস্তায় নেমে আসবে। সেলফি হবে, ভূরিভোজন হবে, করোনাজয়ের গল্প হবে৷ দেরি না করে জয়নাল বাইরে বের হওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে গেল। অনেকদিন পর আজ বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। প্রেমিকার সাথে প্রথম দিন দেখা করার সময় যেরকম অনুভূতি হয় জয়নালের ঠিক সেরকমটাই মনে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

জয়নালের প্রতিদিনকার রুটিন ছিল সকালে বাইরে বের হওয়ার সময় পাড়ার করিম চাচার দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে নেওয়া৷ এতদিন পরেও এই অভ্যাস বদলায় নি। জীবনে কখনও সে করিম চাচা ছাড়া অন্য কাউকে দোকানে বসতে দেখে নি। কিন্তু আজ চাচার ছোট ছেলেকে অনেক দূর থেকে চায়ের কাপে ড্যানিশ ঢালতে দেখছে। কাছে যাওয়ার পর জানতে পারে, করোনার ভয়াল থাবায় করিম চাচা আর বেঁচে নেই৷ পরিবার চালাতে তাই আজ থেকে দায়িত্ব পড়েছে ছোট ছেলের উপর। হয়ত চাচা বাঁচতে চেয়েছিলেন, আজ আমাদের মত উৎসব করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জীবনের নিষ্ঠুরতার কাছে হার মেনে নিতে হয়েছে। জয়নালের মনটা খারাপ হয়ে যেতে লাগল। যে আমাদের মাঝে আছে সে হয়ত কালকে নাও থাকতে পারে। কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু মেনে নেওয়া খুব কষ্টের। মন খারাপ করেই সে বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য বাস কাউন্টারে ছুটল। বাসের জন্য দীর্ঘ লাইন। সবাই হৈ-হুল্লোড় করছে। আহ! সে কি আনন্দ। হঠাত করেই তার চোখ পড়ল কাউন্টারের উপর। এ কি? রনি ভাইকে ত দেখা যাচ্ছে না। উনি ত একদিনের জন্যও ছুটি নেওয়ার পাত্র না৷ এ পথে কত যাত্রী আসে যায়, সবার খুবই ভাল বন্ধু রনি ভাই। জয়নালের বুক ধড়ফড় করে উঠে৷ তবে কি? হ্যাঁ, জয়নালের ধারণাই সত্যি হয়েছে৷

অনেকদিন পর পৃথিবীতে সবাই আনন্দোৎসব করতে বের হলেও প্রকৃতিতে কোথায় যেন বিষাদের সুর৷ হারমোনিয়ামে ঠিক যেন সুর ওঠছে না, বাঁশির আওয়াজ বিকট শোনাচ্ছে৷ আনন্দোৎসবের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অনেক পরিচিত মুখকেই। করোনার আগে যারা আমাদের মাঝে ছিলেন। আজকের আনন্দোৎসবে যাদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু হঠাত করেই এক ঝাপটায় অনেকে যেন উধাও। কেউবা হারিয়েছেন বাবা, কেউ মা, কেউ স্ত্রী, কেউ স্বামী কেউবা স্বজন। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে কতজন যে আজকের আনন্দোৎসব থেকে নিজেকে লুকিয়ে গুমরে কাঁদছেন তা হয়ত কেউ দেখছে না। কতজনই বা নিজেকে আড়াল করে নিয়েছেন। জয়নাল ভাবে, "আচ্ছা আমাদের আজকে করোনাজয়ের উৎসব কি এসব স্বজন হারাদের গায়ে কাঁটার মত বিঁধছে।"

হয়ত একদিন আমরা এই অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়লাভ করব। তখন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসব কি অনেককে.....অনেক হয়ত'র উত্তর খুঁজতে নেই।

আপনার মন্তব্য