জাহাঙ্গীর জয়েস

০৮ মে, ২০২০ ১৯:৪৬

মুক্ত হোক আমার স্বদেশ

আজ ফেসবুকে ঢুকেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমার এক সহকর্মী প্রথম আলো পত্রিকার একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন। যদিও ভিডিওটি ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর প্রকাশিত। এতে দেখা যাচ্ছে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বিচারের নামে হাত পা বেঁধে বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে এক যুবককে নির্মমভাবে পেটাচ্ছেন। বিশেষ করে তার দু'পায়ের তালুতে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারছেন। আর যুবকটি 'ও মাই, ও মাই' অর্থাৎ ও মা, ও মা বলে আর্তনাদ করছে। জানি না এর জন্যে ওই ইউপি সদস্যকে আইনের আওতায় আসতে হয়েছে কিনা, শাস্তি পেতে হয়েছে কিনা।

বিজ্ঞাপন

আর প্রায় সাথে সাথে মনে পড়ে গেলো এই কিছু দিন আগেই নাটোরের লালপুর উপজেলার বৃদ্ধ কৃষক শহিদুল ইসলামকে ৩৩৩ এ ফোন করে ত্রাণ-সাহায্য চাওয়ার কারণে বরমহাটি ইউপি চেয়ারম্যানের নির্যাতনের কথা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার উনার সঙ্গে কথা বলতে চান এই খবর দিয়ে তাকে ইউপি কার্যালয়ে ডেকে এনে লাঠি দিয়ে মেরে রক্তাক্ত করা হয়। তারপর এ কথা কাউকে বললে পরিণতি আরও খারাপ হবে বলে শাসানো হয়!

এ যেন বইপত্রে পড়া সেই জমিদারি আমলের চিত্র। জমিদার এবং তার লোকজন যেভাবে কারণে অকারণে প্রজাদের নিষ্ঠুর, নির্মমভাবে নির্যাতন করতো। সেই কবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা জমিদারি প্রথার অবসান হয়েছে কিন্তু আজ এতো বছর পরও তাদের প্রেতাত্মারা এসব মানুষের রূপে ঠিকই রয়ে গেছে।

একটু ধাতস্থ হয়ে চিন্তা করলেই দেখা যায়, সমাজ বা রাষ্ট্রে এরকম প্রেতাত্মার সংখ্যা একেবারে কম না এবং সঙ্গত কারণেই এরকম নির্যাতনের শিকার মানুষেরও সংখ্যা কম না। স্থান-কাল-পাত্রভেদে শুধু রকমফের আছে।

এই প্রেতাত্মা ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য থেকে শুরু করে কোথাও সংসদ সদস্য, কোথাও প্রশাসনের লোক, কোথাও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী কেউ। মাঝেমধ্যে দু'চারটা গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের সামনে চলে আসে। কিন্তু নিশ্চয়ই অদেখা রয়ে যায় আরও বহু।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সেই হৃদয় বিদারক নির্যাতনের চিত্র নিশ্চয়ই ভুলে যাননি? তারপর পাওয়া গেলো বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক টর্চার সেলের খোঁজ। একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের টর্চার সেলের খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যেখান থেকে রক্তমাখা জামাকাপড়ও উদ্ধার হয়েছে। এরকম প্রভাবশালীদের খবর বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু তাদের পক্ষেই সেকালের জমিদার বা তাদের লোকজনের প্রেতাত্মা হয়ে বর্তমানে বিচরণ সম্ভব যাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক লাইন ঘাট খুবই শক্তিশালী এবং সেই আমলের মানসিকতা আজও লালন করে অস্থিমজ্জায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অন্যদিকে উন্নয়নের ডামাডোলে আমরা ভুলতে বসেছি যে, কারো সমালোচনা করলেই সেটা অপরাধ না। সরকারের বিরুদ্ধে বললেই, সমালোচনা করলেই সেটা কারো অপরাধ না। এটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের সংবিধানস্বীকৃত অধিকার। দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে বিভিন্ন লেখক, সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যদিও গুজব বা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কথা বলা হয় কিন্তু সামান্য কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যে কেউই বুঝতে পারে কেনো তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। প্রায় দেড় মাস পর ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে বেনাপোল এলাকায় বিজিবি তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করে। তিনি নাকি ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো তিনি বাংলাদেশেও অনুপ্রবেশকারী। দেশের নাগরিক দেশে অনুপ্রবেশকারী! কিন্তু কীভাবে তিনি ভারত গেলেন আর এখন কেনোইবা তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার এসব স্পষ্ট করবে কে?

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ৩ মে থেকে ৭ মে পর্যন্ত গ্রেপ্তার ও মামলার শিকার হলেন কার্টুনিস্ট আহম্মেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তা ঢাকা ইউনিটের সদস্য দিদারুল ভূঁইয়া, মোস্তাক আহম্মেদসহ কয়েকজন। ৫ মে দুপুরে টাঙ্গাইল-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) তানভীর হাসান মনির কাঁচা ধান কাটার ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করার পর মোমেন প্রধান (৩২) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ।

এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে পুরান ঢাকার নয়াবাজারে বন্ড চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফুটেজ সংগ্রহকালে বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোর রিপোর্টিং টিমের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এসময় নিউজটোয়েন্টিফোরের রিপোর্টার ফখরুল ইসলাম ও ক্যামেরাপারসন শেখ জালাল গুরুতর আহত হন। এ সময় তাদের ক্যামেরা ও ব্যাকপ্যাক ছিনতাই করে নেয় সন্ত্রাসীরা এবং প্রতিষ্ঠানটির গাড়িও ভাঙচুর করে।

মার্চের ২ সপ্তাহে সংবাদ প্রকাশের কারণে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে নির্যাতন এবং বেআইনিভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তি প্রদান করা হয়।

তাছাড়াও আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম, সাংবাদিক প্রবীর শিকদার, ব্যারিস্টার-লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদ, কবি হেনরী স্বপন প্রমুখকে বিভিন্ন সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এসব যেন রাষ্ট্রের জমিদারি প্রেতাত্মার কর্মকাণ্ড।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয় তখন শিক্ষক সাংবাদিক লেখক অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের আশংকা ছিলো এ আইন সাংবাদিকতা, শিল্প-সংস্কৃতি, মুক্ত জ্ঞানচর্চা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। সম্পাদক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার এ আইন পাস করে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহ এ আইনের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন সে সময়। তার লেখা থেকে সামান্য অংশ তুলে ধরলাম, 'একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যখন ‘নিরাপত্তা’ বা ‘সুরক্ষা’ এ জাতীয় বিষয়ে আইন করে, তখন ধারণাটি হচ্ছে—সেই আইনের প্রধান বিবেচনা হবে, জনগণের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ। অর্থাৎ ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামে কোনও আইন তৈরি হলে তার লক্ষ্য হওয়ার কথা, সাধারণ মানুষ যেসব ডিজিটাল অনিরাপত্তার কবলে পড়তে পারে তা থেকে তাদের সুরক্ষা করা।

জাহাঙ্গীর জয়েস: কবি ও রাজনীতিবিদ

আপনার মন্তব্য

আলোচিত