শ্রদ্ধা প্রাবন্ধিক ও গবেষক মাহফুজুর রহমান

 প্রকাশিত: ২০২০-০৮-২৩ ১৭:৪৯:৩৫

 আপডেট: ২০২০-০৮-২৩ ১৭:৫০:১৩

জাহাঙ্গীর জয়েস:

কবে, কোথায় মাহফুজ ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা ঠিক মনে নেই। হবে হয়তো কোনো গানের অনুষ্ঠান, কবিতার আসর, প্রতিবাদী সমাবেশ বা কোনো মুগ্ধ আড্ডায়। অথবা এমনও হতে পারে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায়। সুন্দর পোশাক, লম্বা চুল, স্মিত হাসির কবিমানুষ মাহফুজুর রহমান কোথায় ছিলেন না। গবেষণা আর প্রবন্ধ মূল জায়গা হলেও তিনি শুধু বইপত্র আর পাঠাগার থেকে পাঠাগারের চার দেয়ালে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি। গবেষণা আর লেখালেখির সাথে সমানতালে ছিলেন মানুষের অধিকার আদায়ের যেকোনো আন্দোলনে। সেটা হোক পরিবেশ রক্ষার, চা শ্রমিকের, কৃষকের, মজুরের। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সব সময়ই পাওয়া গেছে তাকে। সাহিত্য- সংস্কৃতির বিষয়ে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মাহফুজ ভাই ছিলেন মিতবাক। যা বলার তাই বলতেন, অল্প কথায়, গুছিয়ে, ধীরে ধীরে।

মিতবাক মাহফুজুর রহমান ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার বাদে সোনাপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। উনার বাবা মো. আখলাকুর রহমান, মা সৈয়দা জহুরুন্নেছা খাতুন। পল্লীর মনোরম পরিবেশে কেটেছে শৈশব। তিনি ১৯৬৩ সালে ভর্তি হন রামচন্দ্রপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সালে শমসেরনগর হাইস্কুলে ১৯৭১ সালে সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করেন। তিনি ১৯৭২ সালে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করে কিছু দিন চাকরি করে সার্বক্ষণিক লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। এরমধ্যে মাহফুজ ভাই সংসার জীবনে প্রবেশ করেন ১৯৯৩ সালে। উনার জীবনসঙ্গীর নাম নুরুন্নাহার বেগম। পেশায় শিক্ষক। তাদের একমাত্র সন্তান মুফলেহ রহমান পৃথু। সময়ের সাথে সাথে তিনি তাঁর আসল বসত গড়েন প্রবন্ধ ও গবেষণায়। বিভিন্ন বিষয়ে বিচরণ করলেও তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ মুক্তিযুদ্ধ, লোকজ ধারা এবং সিলেট অঞ্চলের নৃ-তাত্ত্বিক ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে।

কবি জয়নাল আবেদীন শিবুর নেয়া একটা সাক্ষাৎকার থেকে মাহফুজ ভাইয়ের ভাবনার গতিধারা সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করছি। 'সমাজের শোষিত মানুষের প্রতি ছিলো তাঁর পক্ষপাত। উদার সমাজ সংস্কৃতি, বিজ্ঞান মনষ্কতার পক্ষে, শোষণ নির্যাতনের বিপক্ষে ছিলো তাঁর অবস্থান। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকা, তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর চালচিত্র ছিলো তাঁর চিন্তার অনেক জায়গাজুড়ে। গণসংগীত তো আগে থেকেই তাঁকে দুলিয়েছে শেষ দিকে যোগ হয়েছিলো বাউল সংগীত। এক কথায় অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শোষণমুক্ত বাংলাদেশ ছিলো তাঁর আরাধ্য।'

উনার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে আছে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থ 'বিপিন চন্দ্র পাল' (১৯৯৯), 'মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন' (২০০২)। এছাড়া 'লোকজ সংস্কৃতি, মৌলভীবাজার জেলা'(২০১৩)। তাছাড়া আছে 'সৈয়দ মুজতবা আলী'(জীবনী), বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ২০০২; 'হাওর করাইয়ার কৃষক আন্দোলন'(ইতিহাস) পাঠক সমাবেশ(২০০৩), 'নানা প্রসঙ্গ নানা ভাবনা'(প্রবন্ধ), মুক্তধারা, ২০০৭; 'মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ'(ইতিহাস), গতিধারা, ২০০৯; 'সিলেট অঞ্চলে নৃ-তাত্ত্বিক ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী'(আদিবাসী), ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ২০০৯; 'সুরমা উপত্যকায় লোকসংগীত অন্বেষণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ'(প্রবন্ধ), গতিধারা, ২০১০; 'গণ-সংস্কৃতির শঙ্খচিল হেমাঙ্গ বিশ্বাস'(স্মারকগ্রন্থ), সম্পাদনা, ২০১২; 'রবীন্দ্রনাথ'(স্মারকগ্রন্থ), যৌথ সম্পাদনা, গীতাঞ্জলী শতবর্ষ উদযাপন পরিষদ, মৌলভীবাজার, ২০১২; 'বাউল গান'(সংগ্রহ ও সংকলন), জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ২০১৫; 'মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস মৌলভীবাজার জেলা', তাম্রলিপি প্রকাশন, ২০১৫; 'নির্বাচিত গণসংগীত', নাগরী প্রকাশন, ২০১৭।

বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য মাহফুজ ভাই একটি মফস্বল জেলায় অবস্থান করলেও উনার সময়ের জাতীয় পর্যায়ের অধিকাংশ লেখক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ছিলো ভালো যোগাযোগ। এবং তাদের কাছে তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ আশাকরি অসংগত হবে না। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক কামাল লোহানী, কথাসাহিত্যিক, কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, অধ্যাপক, লেখক ড. সলিমুল্লাহ খান, কবি অসীম সাহা, কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর প্রমুখ।

গুণীজন প্রয়াত কামাল লোহানীর কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করবো। তিনি লিখেছেন, 'যিনি আমার চেয়ে বয়সে কুড়ি বছরেরও বেশি ছোট হবেন, তিনি মেধা-মননের ভাণ্ডার নিয়ে চলে গেলেন; আমরা জানলাম অনেকেই। কিন্তু 'ওহ', 'তাই নাকি', 'কি হয়ে মারা গেলেন', ইত্যাদি বাক্য ব্যয় করে তাৎক্ষণিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন অনেকেই, কিন্তু কী যে ক্ষতি হলো সংস্কৃতির, সেকথা স্থানীয় সহ-যোদ্ধারা ছাড়া আর কেউ কি বুঝতে পারবেন? মানুষটি বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভা হলে লেখক-সাহিত্যিক, জনারণ্যে ঘুরে বেড়াতেন, প্রাঙ্গণময় মানুষের সাথে যোগাযোগ করতেন পরম হৃদ্যতায়, কাঁধে থাকতো বাংলা একাডেমির উপহার ঝোলানো ব্যাগ। লম্বা চুলে ঢাকা- মাথায় ছিল বন্ধুত্বের সাহচর্য লাভ ও দানের প্রবল প্রত্যাশা। নিজেই পরিচিত হতেন আর পরিচিতজনদের সান্নিধ্যে আপ্লূত হতেন। এইতো ক'মাস বাদেই বাংলা একাডেমির সাধারণ সভায় এই চেনা মানুষটিকে আর দেখা যাবে না। এমন করে অনেকেই ঘুরে বেড়াবেন সারাদিন, কিন্তু মৌলভীবাজারের ঋদ্ধপুরুষ মাহফুজুর রহমান আর থাকবেন না। সেই সবার ভালোবাসার মানুষটি আর এগিয়ে এসে শুধোবেন না,'ভাই কেমন আছেন? কি খবর দেশের'? মৃত্যু শীতল, মৃত্যু অনতিক্রম্য।'

হ্যাঁ, মৃত্যুকে অতিক্রম করার কোনো পথ এখনো তৈরি হয়নি। তাই ২০১৮ সালের এইদিনে তিনি চলে গেলেন অজানা গন্তব্যে। আজ ২৩ আগস্ট ২০২০, মাহফুজ ভাইয়ের দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। মিতবাক মাহফুজ ভাই আপনার কীর্তি ও চেতনার প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

জাহাঙ্গীর জয়েস: কবি।

আপনার মন্তব্য