জাহাঙ্গীর জয়েস

১১ জুন, ২০২০ ১৪:১০

বীভৎসতার চাষবাস: মুক্তি কত দূর?

কার্টুনিস্ট আহম্মেদ কবির কিশোরের একটা কার্টুন আছে এরকম- মা বিড়াল তার বাচ্চাকে 'আমি বৃদ্ধ হলে তুই কি আমায় বনে ফেলে আসবে?' জিজ্ঞেস করলে বাচ্চা বিড়ালের উত্তর: আমি কি মানুষের বাচ্চা?'

মানুষ তো এক সময় বন-জঙ্গলে থাকতো। জীবজন্তু যেমন থাকে। পুরো পলীয় যুগে বা পুরাতন পাথরের যুগ পর্যন্ত তারা ফলমূল আহরণ করে খেতো। জীবজন্তু শিকার করে খেতো। কারণ ততদিন পর্যন্ত মানুষ কৃষি কাজ করতে শেখেনি। পাথরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো। গাছের ডালপালাও। নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল কাজে লাগিয়ে তারা সবার চেয়ে এগিয়ে যায়। চিন্তার শক্তি দিয়ে একে একে ধরাশায়ী করে সব জীবজন্তুকে। নতুন সৃষ্টির সক্ষমতায় গড়ে তুলে বসতি। কাপড় চোপড় পরে শাসন করতে থাকে পৃথিবী। ইচ্ছে মতো প্রকৃতি আর প্রাণিকে খতম করে করে নিজেদের হিংস্রতার ইতিহাস জানান দেয়।

প্রকৃতিতে এক প্রাণি অন্য প্রাণিকে খায়। এটা চলে আসছে প্রাণির সৃষ্টি থেকে। মানুষও খাচ্ছে প্রায় সব প্রাণিকে। বিজ্ঞান যাকে খাদ্যশৃঙ্খল বলে। তাহলে প্রাণি হত্যায় হৈচৈ কেন?

বিজ্ঞাপন

আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে বেড়ে ওঠেছি তাদের অনেকেরই বিভিন্ন ধরনের সাপের সামনে পরার অভিজ্ঞতা আছে। একেবারে সাপের উপর পরে গেলে হয়তো কামড়ে দিয়েছে নতুবা সাপ তো সব সময় পালিয়েই গিয়েছে। বেহুলা লখিন্দরের বাসর ঘরে ঢুকে দংশন করা সাপ ছাড়া আর কোনো সাপ কাউকে কি কখনো খোঁজে গিয়ে দংশন করেছে? করেনি। কিন্তু আমরা হরহামেশাই তাকে দেখা মাত্র দলবেঁধে বেরিয়েছি তার শেষ দেখে নিতে।

দু'চারটা হাঁস মোরগ খেয়ে ফেলে বলে শিয়াল মারার জন্যে আশপাশের ঝোপঝাড় শেষ করে ফেলি। বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বন্য হাতি মানুষের ঘরবাড়িতে হানা দেয়ার খবর, ধানসহ নানা ধরনের ফসলের ক্ষতি করার খবর। বানরসহ কিছু প্রাণি লোকালয়ে চলে আসে খাবারের জন্যে। এখন কথা হলো এই প্রাণিরা লোকালয়ে আসে কেন? তারা কি আমাদের দেখতে আসে- আমাদের প্রেম আর মহত্ত্বে দেওয়ানা হয়ে? মোটেই না। আমরা দখলদারির মাধ্যমে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস করছি।

আমাদের লোভী জিহ্বা বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে শুধু দীর্ঘই হচ্ছে। আমরা গ্রামের ঝোপঝাড় থেকে শুরু করে গহীন পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত গিলে ফেলছি। ডোবা, জলাশয়, খাল, বিল, হাওর, নদী সব গিলে নিচ্ছি। তাই এই প্রাণিরা আমাদের মতো জল্লাদের এলাকায় চলে আসে। তারা তো জানে না, আমরা কোন সুদূর অতীতেই আমাদের বন জঙ্গলে থাকার ইতিহাসের কবর দিয়ে হজম করে ফেলেছি। তারা তো জানে না যে, সেই কবে থেকে আমরা আমাদের জাতির কাউকেই এখন আর ছাড়ি না। এখানে আবার প্রশ্ন তুলি আগে যে প্রশ্নটা তুলেছিলাম, তাহলে প্রাণি হত্যায় হৈচৈ কেন? এক কথায় উত্তর- যখন সেটা বীভৎসতার মাত্রা ছাড়ায়। প্রতিদিন কতো লক্ষ, কোটি প্রাণি শেষ হয় আমাদের উদর পূর্তিতে। কই আমরা তো চিৎকার করি না। আবার দিনকে দিন মানুষের কিন্তু মানবেতর প্রাণির প্রতি সমবেদনা বাড়ছে নিঃসন্দেহে। নিজের প্রাণের ওপর নিয়ে চিন্তা করতে পারলে বিচলিত না হওয়ার কারণ নেই।

এমতাবস্থায় কী করণীয়? আশু মুক্তির কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। তবে চাইলে ধীরে ধীরে সেটা হয়তো সহনীয় করা সম্ভব। এই সহনীয় মাত্রায় রাখতে সাপ মারা, পাখি মারা, চোর মারা, নারী নির্যাতন, সিনেমার ভয়ংকর দৃশ্য দেখে দেখে বেড়ে ওটা আমাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়।

অনেকে বীভৎস ছবি শেয়ার করেন। সেটা মানুষ হোক কিংবা অন্য কোনো প্রাণির। যারা মানুষের হিংস্রতার শিকার। তারা ভালো উদ্দেশ্যে হয়তো শেয়ার করেন কিন্তু এসব দেখতে দেখতে এক সময় মানুষের অনুভূতি সহনশীল হয়ে যায়। তাই বিষয় তুলে ধরেন, সোচ্চার হন কিন্তু এসব বীভৎস ছবি না দিলেই ভালো। আমরা মোরগ লড়াই থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পশুর লড়াই দেখি। এসব বন্ধ করা উচিৎ। এমনকি মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তিও বন্ধ হওয়া উচিত। প্রাণিকে বন্দি করে রাখার চিড়িয়াখানা ব্যবস্থা তুলে দেয়া দরকার। আমরা ছোট শিশুদের স্নেহের নামে শূন্যে তুলে ধরাসহ বিভিন্নভাবে আনন্দ উপভোগ করি অথচ সে ভয়ে বা যন্ত্রণায় কেঁদে উঠে। এসব যে ক্ষতির কারণ তা আমরা বুঝতে চাই না।

অনেক পরিবারে তুচ্ছ কারণে শিশুদের নির্যাতন করা হয়। মোরগ জবাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণি হত্যায় আমরা প্রফুল্লচিত্তে শিশুদের নিয়ে আসি দেখাতে। এভাবে তারা ওই বয়স থেকে শেখে ওঠে এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘাত তো আছেই। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন নিষ্ঠুরতা ও রক্তপাতের ধারাও আছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যত্নশীল হওয়া উচিত। তাহলে অন্তত এসব বন্ধ না হোক কিন্তু নির্মম বীভৎসতার চিত্র আস্তে আস্তে কমে আসবে। তখন কোনো জীবছানার মুখেই আর সংলাপ দিতে হবে না, আমি কি মানুষের বাচ্চা?

জাহাঙ্গীর জয়েস, কবি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত