শিবতোষ ভট্টাচার্য

০৫ আগস্ট, ২০২১ ২০:৪৭

বাংলাদেশের ক্রিকেটে তারুণ্যের জয়গান

এই যেন নতুন রূপে উজ্জীবিত এক বাংলাদেশ টিম যারা প্রতিপক্ষের চোখ রাঙ্গানোকে তোয়াক্কা করেনা। তরুণ তুর্কিরা মিচেল স্টার্কের অভেদ্য ইয়র্কার কিংবা জশ হেজেলহুডের নিয়ন্ত্রিত বোলিংকে দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করছে। একটা সময় ছিল যেই সময় বাংলাদেশ ম্যাচ জেতার জন্য সিনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকত।

কিন্তু দিন বদলেছে আফিফ, শামিম হোসেনের মতন তরুণরা দলের বিপর্যয়ে হাল ধরে প্রতিপক্ষের বাঘা বাঘা বোলারদের সাথে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে। অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে আসার আগে অনেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশ এই সিরিজে ভালো করতে পারবে কিনা এই নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কারণটা খুব অজানা না টি-টুয়েন্টিতে বাংলাদেশের আগের রেকর্ডই এই রকম ভাবনার জায়গা করে দেয়।

উপরন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের ব্যাটিং অর্ডারের তিন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান লিটন দাস, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম তাদের স্ব স্ব কারণে এই সিরিজে অনুপস্থিত। তাই আসলেই বাংলাদেশ ভালো করতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার অবকাশ ছিল।

এই দুশ্চিন্তাটা আরও বেড়ে গেল যখন বাংলাদেশ প্রথম টি-টুয়েন্টিতে মাত্র ১৩১ রানের টার্গেট দিল। ইনিংসের শেষ দিকে আফিফ হোসেনের ক্যামিও ও সাকিব আল হাসানের ৩৬ রান মূলত স্লো উইকেটে বাংলাদেশকে লড়াই করার মত একটি পুঁজি এনে দিয়েছিল।

টিমটা যখন অস্ট্রেলিয়া তখন আপনি হয়ত ভাবতেই পারেন এই স্কোর তারা অনায়াসে টপকে যাবে। কিন্তু তারুণ্যের বাংলাদেশ হারার আগে হার মানে না। মেহেদি হাসান ইনিংসের শুরু করলেন এলেক্স ক্যারিকে ধরাশায়ী করলেন আম বল দিয়ে। যেহেতু ম্যাচের প্রথম বল ছিল তাই সাতপাঁচ বুঝার আগেই মেহেদি ক্যারির ইনসাইড এজ হয়ে লেগস্টাম্পে আঘাত হানে। ১৩১ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে প্রথমেই হোঁচট খেল অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে আর ওঠে দাড়াতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। পরের ওভারে আরেক তরুণ সিলেটের ছেলে নাসুম অফ স্ট্যাম্পের বাইরে টার্ন করে  জশ ফিলিপেকে বোকা বানিয়ে সাজ ঘরে ফেরান। তরুণদের মিছিলে পরীক্ষিত সৈনিক সাকিব আল হাসান কি জন্য নীরব দর্শক হয়ে থাকবেন। সাকিব পরের ওভারেই ফাঁদে ফেললেন অল-রাউন্ডার হেনরিক্সকে। স্লো উইকেটে সুইপ খেলার মাসুল তাকে দিতে হল উইকেট দিয়ে।

নাসুমের স্পিন ভেল্কিতে কুপোকাত অস্ট্রেলিয়া
১১ রানে তিন উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া যখন ধুকছে তখন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ম্যাথু ওয়েড ক্রিজে আসেন মিচেল মার্শকে সংগ দিতে। যদিও ম্যাথু ওয়েড মিরপুরের বাইশ গজে মোটেও সাচ্ছন্দবোধ করছিলেন না তাও উইকেটে টিকে থাকার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ অধিনায়ক ম্যাথু ওয়েডের  হয়তবা অকস্মাৎ মনে হল বাংলাদেশের আতিথেয়তার কথা। যেহেতু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সব আবদার মেনে নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড জামাই আদরে স্টার্ক,মার্শদের বরন করে নিয়ে এসেছে। তাই হয়ত নাসুমের করা ম্যাচের সবচেয়ে বাজে বলটায় সুইপ করতে গিয়ে নিজের উইকেট বাংলাদেশকে উপহার দেন। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের বিদায়ের পর মিচেল মার্শ একা লড়াই চালিয়ে গেলেও যোগ্য সঙ্গীর অভাবে অস্ট্রেলিয়ার ইংনিস মাত্র ১০৮ রানে আটকে যায়। তরুণ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি নাসুম আহমেদের চার উইকেটের ভিত্তি করে বাংলাদেশ ২৩ রানে ব্যবধানে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে।যদিও টি-টুয়েন্টিতে অল-রাউন্ডার নৈপুণ্যকে বেশি মূল্যায়ন করা হয় কিন্তু নাসুমের দুর্দান্ত স্প্যালের জন্য প্রতিদানরূপ তাকে অনুনেয়ভাবে ম্যান অব দা ম্যাচ ঘোষণা করা হয়।

অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র মিচেল মার্শই বাংলাদেশের স্পিনারদের বিপক্ষে কিছুটা সাবলীল মনে হয়েছে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ ছিল না।

যাহোক প্রথম টি-টুয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়াকে মাটিতে নামানোর পর অনেকে হয়তবা মনে করেছেন দ্বিতীয় ম্যাচে তারা ঘোরে দাঁড়াবে। আর সেই গুড়ে বালি দিতেই দাতে দাঁত চেপে বাংলাদেশ দলই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল প্রের ম্যাচে ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য। প্রথম ম্যাচের মত এই ম্যাচেও টস অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল। টসে জিতে অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিল।

মুস্তাফিজের দুর্বোধ্য বোলিং ও আফিফের ফিনিশিং
ম্যাচের প্রথম ১৪ ওভারের চিত্র অস্ট্রেলিয়ার পক্ষেই কথা বলছিল। মিচেল মার্শ ও হেনরিক্সের জুটির উপর নির্ভর করে মিরপুরের লো উইকেতে বেশ ভালো একটি স্কোর করার আভাস দিচ্ছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন বাংলাদেশের প্রাণ সাকিব আল হাসান প্রথম ম্যাচের মত আবারও হ্যানরিক্সকে সাজ ঘরে ফেরান। মিচেল মার্শও এরপর বেশি সময় স্থায়ী হতে পারেননি, তরুণ বাংলাদেশের আরেক অগ্রজ শরিফুল ইসলামের অফ স্ট্যাম্পের স্লোয়ার বলে কুপোকাত হোন তিনি। আর মূলত তখনই অস্ট্রেলিয়ান মিডিল অর্ডারের কোমর ভেঙ্গে যায়। কাটার মাস্টার মুস্তাফিজ ১৭তম ওভারে দুটি মূল্যবান উইকেট নিয়ে যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দেয়ার মত কাজ করলেন। বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১২২ রান, যা আপাত দৃষ্টিতে টি-টুয়েন্টিতে খুব তুচ্ছ মনে হলেও মিরপুরে স্লো এবং লো উইকেট ছিল মাথা ব্যথার প্রধান কারণ।

১২২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে মিচেল স্টার্কের ইয়র্কারকে পাত্তা না দিতে গিয়ে উচ্চাভিলাষী শর্ট খেলতে গিয়ে শূন্য রানে বোল্ড হয়ে ফেরেন সোম্য সরকার। আরেক ওপেনার নাইম শেখ অস্ট্রেলিয়ান পেস আক্রমণের নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হেজেলউডের আন ইভেন বাউন্স বুঝতে না পেরে বোল্ড হয়ে সাজ ঘরের দিকে পাড়ি জমান।

প্রথম ম্যাচের মত এই ম্যাচেও সাকিব আল হাসান দলের বিপদে সামনে এগিয়ে আসেন। তবে এবার শুরু করেন মিচেল স্টার্ককে পর পর তিন বলে চার মেরে। তরুণ মেহেদি হাসানকে এইদিন ভাগ্য দেবী ধরা দিয়েছিল। তিনি একের পর এক বল আকাশে তুলছিলেন কিন্তু কেউ আবার ক্যাচ ধরতে পারছিলেন না। তার ভূমিকাটা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিল, দ্রুত রান তুলে অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়ার জন্যই রাসেল ডোমিংগ তাকে ব্যাটিং অর্ডারে পোমোশন দিয়েছিলেন । আউট হওয়ার আগে তিনি একটা ছক্কার সাহায্যে ২৪ বলে ২৩ করেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে তখন যখন বাংলাদেশ ১১ রানের ব্যবধানে সাকিব, মেহেদি ও অধিনায়ক মাহামুদল্লাহ উইকেট হারিয়ে ফেলে। অনেকেই হয়ত তখনই বাংলাদেশের আশা শেষ মনে করেছিলেন।

আগের ম্যাচের মত এই ম্যাচেও দলের বিপদে সামনে থেকে লড়াই করেন তরুণ আফিফ হাসান। আর তাকে খুব ভালো ভাবে সাহায্য করেছেন নুরুল হাসান, যিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার পর তার উইকেট কিপিং স্কিল দিয়ে মুগ্ধ করেছেন। তাদের পার্টনারশিপের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে তাদেরকে স্টার্ক, জাম্পা বা টাইদের বিরুদ্ধে একটুখানি বিচলিত মনে হয়নি। বরং বলের মেরিট বুঝে বাংলাদেশকে তরিকে ভিড়িয়েছেন জয়ের বন্দরে। আফিফের কথা বলতে বিশেষভাবে, তিনি কেলকুলেটিভ রিস্কে নেওয়ার মাধ্যমে দর্শনীয় কিছু ক্রিকেট শর্টের উপহার দিয়েছেন। যা অজিদেরকে জয় থেকে আস্তে আস্তে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। আফিফ হোসেন ম্যাচের শেষ করেন থার্ড ম্যানের উপর দিয়ে একটি দারুণ র‍্যাম্প শর্ট খেলে।

শেষ পর্যন্ত আফিফ ৩১ বলে ৩৭ রান করে দলকে জিতিয়ে বীরের মত মাঠ ছাড়েন। আগের ম্যাচে ম্যান অব দা ম্যাচ না পেলেও তার সময়োপযোগী ব্যাটিংয়ের জন্য এই ম্যাচে কাঙ্ক্ষিত পুরষ্কারটি পান।

যার ফলে বাংলাদেশ শুক্রবারে সিরিজের তিন নম্বর টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নামবে ২-০ লিড নিয়ে। বাংলাদেশ যদি ঠিকঠাক ক্রিকেট খেলতে পারে তাহলে পরের ম্যাচেই সিরিজ নিজেদের করে নিতে পারবে। কিন্তু দলটা যেহেতু অস্ট্রেলিয়া তাই তিন নম্বর ম্যাচে মরণ কামড় দিতে চাইবে। আর সেজন্যই তারুণ্যের এই বাংলাদেশকে সাবধান থাকতে হবে।

শেষ কথা
বাংলাদেশ এই সিরিজে দেখিয়েছে তরুণদের পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে কিভাবে অস্ট্রেলিয়ার মত বিশ্বজয়ী দলকেও মাটিতে নামিয়ে আনা যায়। যা অবশ্যই অক্টোবরে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপকে ভালো করার জন্য রশদ যোগাবে। টি-টুয়েন্টি নতুনদের খেলা, আর এই ফরম্যাটে এতদিন বাংলাদেশের ভালো না করার পেছনে প্রধান কারণ ছিল পর্যাপ্ত ভালো মানের নতুন ক্রিকেটার না থাকা। কিন্তু আফিফ, নাসুম, ও শামীম পাটোয়ারীর মত তরুণদের উত্থান বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদেরকে মেলে ধরার। শুভকামনা রইল বাংলাদেশের জন্য, আশা করি তারা অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম বারের মতন দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হারের স্বাদ দিতে পারবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত