অরণ্য রণি

২৬ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ১৬:০১

মাহাথির মোহাম্মদের দেশে

সকাল সোয়া ৭টায় বিমান অবতরণ করলো। এরপর আমরা তিনজন (আমি, মেহজাবীন, এলিট) মিলে এয়ারপোর্টের জি-৩ কাউন্টারের সামনের আসনে বসলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর ওরা বালির (ইন্দোনেশিয়া) ফ্লাইট ধরতে চলে গেল।

বলছিলাম কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কথা। বিমানবন্দরটি আকারে বিশাল। এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যেতে হয় ট্রেন দিয়ে। এশিয়ায় মালয়েশিয়া অন্যতম উন্নত দেশ। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার তো বটেই, কুয়ালালামপুরে এমন আরও অনেক ঝাঁ চকচকে দালান আছে, যা জেনেছি অন্তর্জালের বদৌলতে। ভিসা না থাকায় বিমানবন্দর থেকে আর বের হতে পারিনি।

ইন্দোনেশিয়ার বালি ভ্রমণে যাওয়া ও আসার সময় আমার ট্রানজিট পড়ে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। যাওয়ার সময় ১৪ ঘণ্টা আর আসার সময় ফ্লাইট ডিলে করায় দশ ঘণ্টা। সর্বমোট ২৪ ঘণ্টা বা একদিন ও রাত। ট্রানজিটের ফাঁকেই অন্তর্জালে মালয়েশিয়া সম্পর্কে তাদের দেশের ওয়েবসাইট, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র, বিমানবন্দরের কোথায় কী আছে তা খুঁটিনাটি জেনে নেই।

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমান্তরাল তিনটি রানওয়ে আছে। এই রানওয়েগুলোর বিমান চলাচল দুটি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। পশ্চিম পাশের টাওয়ারের উচ্চতা ১৩৩ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ৪৩৯ ফুট উঁচু যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়।

ছোটবেলায় বাবার কাছে মালয়েশিয়ার অনেক গল্প শুনেছি। শুনেছি আধুনিক মালয়েশিয়ার উন্নয়নের রূপকার ড. মাহাথির মোহাম্মদের কথা। ১৯৮১ সালে তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল পর পর পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই। মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি তিনি। ২০০৩ সালের ৩০শে অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। অবসর গ্রহণের দীর্ঘ ১৫ বছর পর ৯২ বছর বয়েসে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের ব্যাপক দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতার কারণে মাহাথির মোহাম্মদ আবারও আসেন রাজনীতিতে। ২০১৮ সালের ৯ মে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে জয়ের পরদিন ১০ মে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি।

মালয়েশিয়ায় ৩টি ফেডারেল টেরিটরি ও ১৩টি রাজ্য রয়েছে। সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে মালয়েশিয়ায় প্রাচীন ঐতিহ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অভিভাবক হিসেবে রাজা থাকেন। বর্তমান রাজার নাম পঞ্চম মোহাম্মদ। মালয় ভাষা মালয়েশিয়ার সরকারি ভাষা।

ওরা দুজন বালির ফ্লাইট ধরার পরে মাঝে ভারতীয় এক পরিবারের সাক্ষাৎ। কিছুটা গল্প করে সময় কাটানো হলো তাদের সাথে। দুই ঘন্টা পরে তারাও চলে গেল। এরপরেই সাক্ষাৎ আরেক বাঙালির সাথে। ঢাকার জিন্নাত ভাই, কম্বোডিয়া বেড়াতে যাচ্ছেন। উনার সাথে স্যাটেলাইট ভবনে ঘুরতে ঘুরতে বেলা ১টা বেজে যায়। গল্প করতে করতে আমরা টার্মিনালের একপাশ থেকে আরেক পাশে চলে যাই। এর মধ্যে তিনবার ইলেকট্রিক ট্রেনে ঘুরে বেড়াই। এরই মধ্যে ট্রেনে সাক্ষাৎ এক শ্রীলঙ্কান নাগরিকের সাথে। নুওয়ান তার নাম। তিনি কাজ করেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। ছুটিতে শ্রীলঙ্কায় বাড়ি যাচ্ছেন।

স্থানীয় সময় দেড়টার দিকে জিন্নাত ভাই কম্বোডিয়ার ফ্লাইট ধরতে চলে গেলেন। এরপর এদিক সেদিক একা একা ঘুরছিলাম। হঠাতই এক ভারতীয় অদ্ভুত এক মানুষের সাথে দেখা। তার নাম নিকি। পাঁচ ঘণ্টা তার সাথে যে কীভাবে কেটে গেলো তা টেরই পেলাম না। অনেক গল্প হলো, কথা হলো, তর্ক-বিতর্ক হলো। তার জীবনের গল্পটাই বেশি শোনা হলো, এমনকি শোনার মতোও ছিল। ক্যাথায় প্যাসিফিক এয়ারলাইনসের বিমানবালা থেকে একজন পুরোদস্তুর পর্যটক-পরিব্রাজক হয়ে ওঠার কাহিনী।

পৃথিবীর ১৮তম দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে এই নারী হারিয়েছেন তার পাসপোর্ট, মোবাইল ও ক্রেডিট কার্ড। ভারতীয় দূতাবাসের বিশেষ সহযোগিতায় তিনি ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে ফিরছেন নিজ দেশে। ভারতে তার এক বন্ধুকে ফোন দেওয়ার জন্য আমার সাহায্য চাইলেন প্রথমে। সেই থেকে শুরু আলাপচারিতা। অনেক হাই-প্রোফাইলের জব করা এই নারীকে অনেকটা খামখেয়ালিই বলা যায়। কয়েক মাসের মধ্যে কানাডার এক কোম্পানিতে আবার কর্মজীবন শুরু করার ইচ্ছে তার, যদি না এর আগে তার কোনো মতিভ্রম ঘটে। কথাটা অকপটেই বললেন নিকি।

কুয়ালালামপুর শহর থেকে দক্ষিণে ৪৫ কিলোমিটার দূরে এই বিমানবন্দরের অবস্থান। বিমানবন্দরের ভবন ও রানওয়ের মধ্যেই অদ্ভুত এক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ গাছ, যা আমাদের দেশের বিমানবন্দরে দেখা যায় না। বিমানবন্দরের আয়তন ১০০ বর্গ কিলোমিটার, যা কৃষি জমির অধিকৃত করে করা হয়েছে। এখানে রয়েছে তিনটি সুবিশাল রানওয়ে ও দুটি টার্মিনাল যার প্রত্যেকটিতে আলাদা করে স্যাটেলাইট ভবন রয়েছে। বিমানবন্দরের প্রধান টার্মিনালের ডিজাইন করেন জাপানি স্থপতি কিশো কুরকাওয়া। এই এয়ারপোর্ট কমপ্লেক্সে দিনের আলোর পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে ও ইসলামি ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বর্তমানে বিমানবন্দরে ঘন্টায় অন্তত ৮৫টি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা করে। বছরে সাড়ে ৫ কোটিরও বেশি যাত্রী এই বিমানবন্দর দিয়ে যাতায়াত করেন। স্যাটেলাইট টার্মিনাল-২ এর মধ্যখানে একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণার অরণ্য আছে যা মালয়েশিয়ার অতিবৃষ্টি আবহাওয়া নিদর্শন।

সারাবছর ধরেই উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া বিরাজ করে মালয়েশিয়ায়। আবহাওয়ার বড় ধরনের পরিবর্তন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুব একটা হয় না। দিনে তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে মতো আর রাতে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। মালয়েশিয়া নিরক্ষ রেখার খুব কাছে হওয়াতেই এমন আবহাওয়া। এখানে নেই কোনো শরৎ, হেমন্ত ও শীতের মতো ঋতু। সারা বছর এমনই বৈচিত্র্যহীন আবহাওয়া বিরাজ করে মালয় দেশে। এক কথায় দেশটি সারা বছর এক ঋতুর ফাঁদে আবদ্ধ। মালয়েশিয়ায় সারা বছর বৃষ্টি হয়। এখানকার গড় বৃষ্টির পরিমাণ প্রায় ২৯০ মিলিমিটার। এয়ারপোর্টে থাকাকালীন সময়ে হঠাতই সন্ধ্যার আগে দেখি বৃষ্টি ঝরছে। মালয়েশিয়া আসলাম আর বৃষ্টি দেখলাম না তো বোধ হয় হতেই পারে না।

থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই এর সঙ্গে স্থল সীমান্ত আছে মালয়েশিয়ার। সমুদ্র সীমানা আছে ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে। দেশটির উপকূল রেখার মোট দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৬৭৫ মিটার। দক্ষিণ চীন সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ পূর্ব ও পশ্চিম মালয়েশিয়াকে আলাদা করে রেখেছে।

এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যাওয়ার জন্য আছে চালকবিহীন বৈদ্যুতিক ট্রেন। এতো সাজানো-গোছানো, ছিমছাম, পরিপাটি আর এতো কোলাহলমুক্ত বিশাল জনসমাগমস্থলে এতো কম শব্দ আমার আগে দেখা হয়নি।

আমাদের দেশে আমরা সাধারণত আবর্জনা একই ঝুড়িতে বা বাক্সে ফেলি। এমনকি বিমানবন্দরেও একই ঝুড়িতে সব ধরণের বর্জ্য, যেমন- প্লাস্টিক, ধাতু, কাগজ এবং অন্যান্য ধরণের বর্জ্য ফেলি। কিন্তু মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে দেখলাম ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একেক ধরণের ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য পৃথক পৃথক ঝুড়ির ব্যবস্থা রয়েছে। প্লাস্টিক, কাগজ, ধাতু ও অন্যান্য আবর্জনার জন্য আলাদা আলাদা ময়লার ঝুড়ি। বিষয়টা অনেক ভালো লেগেছে দেখে। আর সেই ময়লার ঝুড়ির চাকচিক্য দেখলে তো অবাক হয়ে যাওয়ার জো। কিছুক্ষণ পরপরই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসে তা পরিষ্কার করে ঘষে-মেজে একদম নতুনের করে ফেলছেন। আর এসব পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি শ্রমিক।

শফিক উদ্দিন নামের এক শ্রমিক ৬ বছর ধরে মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে কাজ করছেন। কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, আগামী বছর (২০২০) এ দেশে যাবেন। তার অপেক্ষার দিন যেন কাটছেই না। বাংলাদেশের রংপুর এলাকায় তার বাড়ি। ভিনদেশে একজন বাঙালির দেখা পাওয়া গেলে কতো আপন মনে হয়।

আরেকটি বিষয় নজর কেড়েছে এই বিমানবন্দরে। আর তা হলো- পানি খাওয়ার গ্লাস। পাবলিক প্লেসে আমরা সচরাচর প্লাস্টিকের কাপ বা গ্লাসে পানি খেয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু অধিকাংশ প্লাস্টিকের পুনঃচক্রায়ন বা রিসাইকেলিং করা সম্ভব হয় না, আর হলেও তা খুবই সময়সাপেক্ষ। আর এই প্লাস্টিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এ জন্য বর্তমানে প্রাণী-উদ্ভিদকুল বিশাল হুমকির মুখে। বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনে এটি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধে কাগজের তৈরি বিশেষ ধরণের ফানেল আকৃতির কাপ ব্যবহৃত হচ্ছে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে, যা দিয়ে সর্বোচ্চ তিন কাপ গরম বা ঠাণ্ডা পানি খাওয়া যায়। এরপর তা পানি পানের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর কারণ হলো- পেপার কাপগুলো শতভাগ পরিবেশবান্ধব। কারণ মাটিতে ফেলে দেওয়ার ২১ দিনের মধ্যে কাপগুলো পুরোপুরি পচে গিয়ে জৈব সারে পরিণত হয়। এমন উদ্যোগ মালয়েশিয়ার পরিবেশ সচেতনতারই প্রমাণ।

একই ধরণের অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন হয়েও মালয়েশিয়ার তুলনায় আমরা উন্নয়নে অনেক পিছিয়ে। এখানে নাগরিক সেবা অনেক উন্নত। পর্যটকবান্ধব দেশ হিসেবে ইতিমধ্যেই দেশটি খ্যাতি অর্জন করেছে। আমাদের দেশের যাবতীয় সমস্যা রোধ করে করে একটুখানি মনযোগ দিলে আমরাও হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ছাপিয়ে যেতে পারতাম মালয়েশিয়াকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত