অনলাইন প্রতিবেদক

১৯ মে, ২০১৬ ০৯:৫৪

পাকিস্তান ও তুরস্কের উচিত গণহত্যাকে স্বীকার করা : পাকিস্তানি লেখক

যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর পাকিস্তান ও তুরস্কের সমালোচনা করেছেন  পাকিস্তানের আইনজীবী ও লেখক ইয়াসির লতিফ হামদানি।

পাকিস্তানের ট্রিবিউন পত্রিকার অনলাইনে গত সোমবার প্রকাশিত ‘মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির জন্য বাংলাদেশকে কশাঘাত করলে ইতিহাস বদলাবে না’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি অতীত ইতিহাস ঘেঁটে লিখেন, আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর উচিত তাদের পুরনো নৃশংসতাকে কার্পেটের আড়ালে লুকিয়ে না রাখা। পাকিস্তান ও তুরস্ক—উভয় দেশকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে তারা অতীতে একসময় তাদের নিজের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছে, গণহত্যা করেছে।

তিনি লিখেন, ফাঁসির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেওয়া তুরস্কের সিদ্ধান্তও বেশ শিক্ষামূলক। ওই দেশটিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অটোম্যান সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এখানে বাংলাদেশ ও আর্মেনিয়া একই অবস্থানে। অন্যদিকে পাকিস্তান ও তুরস্ক অতীতকে প্রত্যাখ্যান করছে।

একই সঙ্গে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করায় বাংলাদেশ নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াকে একজন পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে লজ্জার বিষয় বলে অভিহিত করেছেন তিনি।

হামদানি লিখেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে অতীতের ভুল শোধরানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারেন না যে এটি এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কেবল দুই দেশের মধ্যে দূরত্বই বাড়াতে পারে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এটি একটি বার্তা যে আমরা অতীত থেকে এখনো শিক্ষা নিইনি।’

ইয়াসির লতিফ হামদানি নিয়মিতই পাকিস্তানের ট্রিবিউন পত্রিকায় নিবন্ধ লেখেন। পাকিস্তানের ‘অসাম্প্রদায়িক’ পরিচয় এবং দেশে সবার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের তিনি একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি লাহোরভিত্তিক ‘ওয়াইএলএইচ অ্যান্ড কো’ নামে আইনি সেবা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

ইয়াসির লতিফ হামদানি লিখেছেন, মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন আলবদর নেতা। অত্যন্ত পরিহাসের বিষয় হলো, ১৯৪৭ সালে যে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছিল, ২৪ বছর পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন অভিজাত শ্রেণি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ সুরক্ষায় সেই জামায়াতেরই ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করেছে। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলনে যে বাঙালি জনগণ মুসলিম লীগ ও জিন্নাহর প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিয়েছিল, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ‘আলবদর দস্যুদের’ লেলিয়ে দিয়েছে। কে শত্রু আর কে বন্ধু তা বোঝার ক্ষমতা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ছিল না। ১৯৬৫ সালে বাঙালি জনগণই আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ফাতিমা জিন্নাহর পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

হামদানি লিখেছেন, ১৯৪৭ ও ১৯৬৫—উভয় বছরের আন্দোলনেই সামনের সারিতে ছিলেন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জাতির জনক হওয়া শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এক শহর থেকে আরেক শহরে সাইকেলে করে গিয়ে মুসলিম লীগের জনসভায় অংশ নেন। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তরুণ নেতাই মুসলিম লীগের বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন। বাঙালিদের সাহায্য ছাড়া পাকিস্তান সৃষ্টি সম্ভব হতো না।

হামদানি আরো লিখেছেন, ‘অথচ ১৯৭১ সালে ওই বাঙালি জনগোষ্ঠীকেই পাকিস্তানের এক সামরিক জান্তা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সামনে যে দাবি তুলেছিলেন তা ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ। আমাদের এটিও স্বীকার করতে হবে, শেখ মুজিব নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন।’

ইয়াসির লতিফ হামদানি লিখেছেন, সত্য হলো, শেখ মুজিবের ছয় দফা মেনে নিলে পাকিস্তান আরো শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক দেশ হতো। অন্তত অন্য দিকের গল্প জানতে প্রত্যেক পাকিস্তানির শেখ মুজিবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়া উচিত। মুজিব ছিলেন দেশপ্রেমিক। তিনি পাকিস্তানের সবার সমান অধিকার চেয়েছিলেন এবং তরুণ কর্মী অবস্থাতেই এ লক্ষ্যে লড়াই করেছেন।

হামদানি লিখেছেন, ইতিহাস থেকে শেখার বদলে পাকিস্তানের জান্তা তাদের হীন স্বার্থে আমাদের ইতিহাসের ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে। মতিউর রহমান নিজামীর লোকদের নিয়ে গড়া ব্রিগেডগুলোকে আমরা দুর্ভাগা জনগোষ্ঠীর দিকে ঠেলে দিয়েছি। আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়াই ছিল ওই জনগোষ্ঠীর একমাত্র অপরাধ।

তিনি লিখেছেন, দুর্ভাগ্যজনক সেই যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানের বিভাজন দেখেছি। আল বদর, আল শামস ও রাজাকাররা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। এসব অপরাধের জন্যই বাংলাদেশে মতিউর রহমান নিজামীর বিচার ও ফাঁসি হয়েছে।

হামদানি লিখেছেন, মৃত্যুদণ্ডকে হয়তো কেউ পছন্দ করেন না। তবে এখানে যে অপরাধ হয়েছে, তার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বাইরে কেউ কিছু চিন্তাও করতে পারেন না।

তিনি লিখেছেন, এ ব্যাপারে পাকিস্তানি হিসেবে আমাদের দেশের প্রতিক্রিয়ায় আমি লজ্জিত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফাঁসির নিন্দা জানিয়ে বলেছে, পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য দেখানোই ছিল মতিউর রহমানের একমাত্র অপরাধ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে কোন সংবিধান বলবত ছিল?

তিনি আরো লিখেছেন, ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের অন্তর্বর্তী সংবিধান বা বর্তমানে প্রচলিত ১৯৭৩ সালের সংবিধান তখন প্রণীত হয়নি। মেনে চলার মতো কোনো সংবিধান তখন ছিল না। পাকিস্তানে তখন আমাদের যা ছিল, তা হলো একটি অবৈধ দখলদার সরকার যে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদীয় আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি।

হামদানি লিখেছেন, যখন নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস লেখা হবে তখন কেবল এই অংশটুকু টিকে থাকবে। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল, জনগণের ইচ্ছায় নয়, বেয়োনেটের জোরে ক্ষমতা দখল করা।

তিনি লিখেছেন, আমরা অব্যাহতভাবে ভুল করে চলেছি, সেটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বালুচদের মোকাবিলা হোক আর আফগানিস্তানে ‘ভালো’ তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়েই হোক। পরিস্থিতি এখন আমাদের অতীত থেকে বর্তমানের পার্থক্যকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করার তাগিদ দিচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের থিংক ট্যাংকরা এখনো পুরনো প্রশ্নবিদ্ধ প্রজ্ঞাই ফিরিয়ে আনতে ব্যস্ত।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত