হাসান মোরশেদ

০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১৫:৪৩

দাসপার্টির খোঁজে: খসড়া পর্ব- ১০

সর্বোচ্চ সম্মানের ঘোষণা দিয়ে ও রাষ্ট্র তাঁকে ভূষিত করেছে তৃতীয় খেতাবে, অথচ সহযোদ্ধাদের কাছে আজও তিনি শ্রেষ্ঠ বীর। বিশাল ভাটি অঞ্চলের বীরশ্রেষ্ঠ। হত্যা আর মরদেহ প্রদর্শনের ধরণে তাকে একাত্তরের যীশুও বলেন অনেকে। চুয়াল্লিশ বছর পর লেখক হাসান মোরশেদ বেরিয়েছেন শহীদ জগৎজ্যোতি দাস আর তাঁর দাসপার্টির খোঁজে। তাঁর সেই অনুসন্ধান ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে সিলেটটুডে২৪ ডট কম-এ। আজ প্রকাশিত হলো ১০ম পর্ব

পূর্ব প্রকাশের পর...
গতরাতে এসে আমরা বিদ্যুত পাইনি, এই দুপুর পর্যন্ত ও বিদ্যুত আসার লক্ষণ নেই। ভ্যাপসা গরমে হাসফাস লাগে। নামাজ শেষ হলে এবার আমরা পরিকল্পনা করি বিথঙ্গল যাবার। রামকৃষ্ণ গোস্বামী নামে একজন বৈষ্ণব সাধক চারশো বছর আগে এই অঞ্চলে বৈষ্ণব সাধকদের জন্য আখড়া গড়েছিলেন। এবার নদী নয়, গ্রামের পেছনের হাওর ধরে আমরা যাত্রা শুরু করি কাকেলছৈও থেকে বিথঙ্গল এর পথে । ঝকমকে রোদ্দুর, শরতের আকাশের মতো সাদা সাদা মেঘ আর ঘন নীল আকাশ। আকাশে ছায়ায় হাওরের পানি ও নীল দেখায়। এখন যে পাল তোলা নৌকা চলে- এই অঞ্চলে না আসলে জানা হতোনা।

নৌকার গলুই এ বসে হাওরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকি আমরা আর ইলিয়াসের সাথে গল্প করি।
- মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন জগতজ্যোতি দাস?
- সিংহের মতো একটা কলিজা ছিলো তার। যুদ্ধের সময় আমাদের উপরে আল্লাহ আর নীচে দাদা। দলের কোন ছেলের মন খারাপ থাকলে নিজে নেচে গেয়ে মন ভালো করে দিতেন। একবার টেকেরঘাটে সেন দা (সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত) আমাদের আগে খেতে বসে গিয়েছিলেন। জ্যোতি দা গিয়ে তারে বিরাট ঝাড়ি। আরেকবার ইন্ডিয়ান আর্মির সাথে লাগলো মারামারি...

ইলিয়াস এই ঘটনার বর্ণনা দেন। টেকেরঘাটের শরণার্থী শিবিরে আয়োজন করা হয়েছিলো দূর্গাপূজার। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো সেখানে, ভারতীয় জওয়ানরা ও আমন্ত্রিত ছিলো। এক হিন্দিভাষী জওয়ান বাঙালি এক মেয়েকে উত্যক্ত করছিলো পূজা মন্ডপে। জ্যোতি সেই জওয়ানকে মেরে মাথা ফাটিয়ে আটকে রাখেন। এই ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় ভারতীয় শিবিরে। একজন ইউনিফর্ম পড়া জওয়ানকে আঘাত করা মানে গোটাবাহিনীকে অপমান করা। জ্যোতি এবং তার দলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় মেজর ভাট এর দপ্তরে। কোর্ট মার্শাল হবে।

জ্যোতি মেজর ভার্মাকে স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন- পাকিস্তান আর্মির যে আচরণের জন্য আমরা অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছি, সেই আচরণ ভারতীয় সৈনিকের কাছ থেকে পেয়েছি বলেই আমরা আঘাত করতে বাধ্য হয়েছি। গুলি করে মেরে ফেলতে হলে মারবেন কিন্তু হাতবাঁধা অবস্থায় না। হাত খোলা অবস্থায় আমাদেরকে গুলি করবেন। আমরা ক্রিমিনাল না, আমরা মুক্তিযোদ্ধা।
মেজর ভাট শাস্তি লঘু করে দেন, তার প্রিয় গেরিলাদের দিয়ে কয়েকটা বাংকার খুঁড়ানো হয় মাত্র।

জগতজ্যোতির গল্প শুনতে শুনতে আমরা বিথঙ্গল এসে পৌঁছাই। বাজারের ঘাঁটে নেমেই পায়ে হেঁটে আখড়া। পুরনো কাঠামো, চারশো বছরের পুরনো। কিছু অংশ আবার সংস্কার করা হয়েছে। এখানে ঢুকতে হয় জুতা খোলে। চারপাশে হাওরের মাঝখানে এই দুর্গম স্থানে সেই চারশ বছর আগে বৈষ্ণবদের সাধনার জন্য নির্মিত হয়েছে , ভাবতেই অবাক লাগে। এখানে ১২০টি আলাদা কুঠুরি ছিলো , ১২০ জন বৈষ্ণব সাধনা করতেন। ইলিয়াসের হয়তো মনে পড়ে, ফুলবাসী বৈষ্ণব নামে একজন সহযোদ্ধার নাম উচ্চারণ করেন। শাল্লার বৈষ্ণব পদধারী চারভাই তাদের সাথে দাসপার্টিতে ছিলেন। ফুলবাসী বৈষ্ণব পরে খুন হয়েছেন।

পুরনো কুঠুরীগুলোর সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছেন কয়েকজন বয়স্ক রমণী। একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এগিয়ে আসেন। জিজ্ঞেস করি- এখন আর বৈষ্ণবরা আর সাধনা করেন না?
বলেন- এই দু চারজন আছে আর কি। এইটা বড় কঠিন সাধনা, এখন লোকজন চায়না আর।
ইলিয়াস তাকে মোহন্তের কথা জিজ্ঞেস করেন। আখড়ার প্রধান মোহন্ত বিশ্রামে তখন। ইলিয়াস বলেন তার নাম বলার জন্য- দাস পার্টির ইলিয়াস।

আমরা চারশো বছরের পুরনো স্থাপনা খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে দেখি। কতো মানুষ, কতো কাল, কতো ঘটনার স্মৃতি জমা এর পরতে পরতে। কিছুক্ষণ পর মোহন্ত এসে স্বাগত জানান আমাদের। বয়স আশি পেরিয়েছে তার কিন্তু কাঠামো নুয়ে পড়েনি এখনো। জানালেন আশে পাশের গ্রামের দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান সকলেই আসে তার কাছে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে। ইলিয়াস নিজের পরিচয় দেন, মোহন্ত হাসেন।
‘চিনি আপনারে- সেই যুদ্ধের সময় দেখছিলাম, আর এতো বছর পর’

বিথঙ্গল থেকে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করি। তখন আলো কিছুটা নরম হতে শুরু করেছে। কাকেলছৈও বাজারে একটা দোকানে এসে বসি। যার বাড়িতে আমরা থাকছি এটি তারই স্বর্ণের দোকান।

ইলিয়াস কাউকে ফোন করেন। কিছুক্ষণ পর একজন বয়স্ক মানুষ এসে ঢোকেন। তাকে অসুস্থ দেখালে ও পরনের লুঙ্গী ও শার্ট বলে দেয় অন্যদের থেকে কিছুটা অবস্থাসম্পন্ন। ইনি মতিউর রহমান, দাস পার্টির অন্যতম যোদ্ধা। তার সাথে মনোরঞ্জন দাস ও এসেছেন, দুপুরবেলা যার সাথে আমাদের আলাপ হয়েছে।

মতিউর রহমান জোর করে আমাদেরকে নিয়ে যান তার বাড়িতে। বর্তমানে শ্রীহীন হলে ও পুরনো আভিজাত্যের চিহ্ন রয়ে গেছে এখনো। আমরা বাড়ির বারান্দায় বসি। ইফতারের খুব দেরি নেই আর।

একাত্তুরে তার বয়স ছিলো সাতাশ। বিয়ে করেছেন কিছুদিন আগে। স্ত্রী আটমাসের গর্ভবতী, প্রথম সন্তান হবে। এই অবস্থায় চলে গেছেন যুদ্ধে। সেই সন্তানের মুখ আর দেখা হয়নি যুদ্ধ থেকে ফিরে, নবজাতকটি মারা গিয়েছিলো। ছেলে যুদ্ধে গিয়েছে এই অপরাধে মতিউর রহমানের বাবাকে ও গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। অনেক টাকা পয়সার বিনিময়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছে তাকে। যুদ্ধের আগে বেশ অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন তারা কিন্তু যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের ধাক্কায় এখন আর আগের অবস্থা নেই।

জগতজ্যোতি দাসের শেষ যুদ্ধে মতিউর রহমান ও পাশে ছিলেন। এখন অসুস্থ, ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে কিছুদিন আগে। বেশি কথা বলতে পারেন না। তবে তার ছোট ভাই যিনি কিশোর ছিলেন যুদ্ধকালে, পারিবারিক বিপর্যয়ের স্বাক্ষী তিনি- ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যে মানুষেরা যুদ্ধের সময় নিরাপদ ছিলো, যুদ্ধে যায়নাই, কোন ক্ষতি হয় নাই বরং হিন্দুদের সম্পত্তি পানির দামে কিনে সম্পদশালী হয়েছে তারাই আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে এখন এলাকার প্রধান হয়ে গেছে।

আজান হয়। প্রথম ইফতার আমরা করি মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমার বাড়ির আঙ্গিনায়।

ইফতারের পর আমরা তিনজন নদীর ঘাটে গিয়ে বসি। তখনো আলো নিভে যায়নি পুরোপুরি। সামনে প্রবাহমান নদী, দিগন্তে মেঘের উপর দিয়ে আসা অস্তমান সূর্যের শেষ ছটা। এই নদীর কোথাও ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিলো জগতকে, আমাদের আবারো মনে পড়ে।

অন্ধকার নেমে এলে পড়ে আমরা বাজারে ফিরে আসি। প্রথম রমজানের ইফতারের পর বাজার বেশ সরগরম হয়ে উঠছে তখন। একটা চায়ের দোকানে ঢুকি। কয়েকটা চেয়ার আর বেঞ্চ পাতা। আমরা একটা বেঞ্চে বসতে গেলে চেয়ার থেকে কয়েকজন উঠে প্রায় জোর করে আমাদেরকে চেয়ারে বসান। কালকে রাতে যে আমরা এসেছি, বিশেষ করে সকালবেলা আমাদেরকে ঘিরে চেয়ারম্যান ও ইলিয়াসের বাদানুবাদ – এসব বেশ ভালোভাবেই প্রচার হয়েছে। কোন চ্যানেল থেকে এসেছি, কবে অনুষ্ঠান দেখাবে- এইসব কমন প্রশ্নে আমরা ডিপ্লোমেটিক থাকি। রঙ চা, দুধ চা আবার রঙ চা এর বৃত্ত ঘুরতে থাকে আমাদের। নজরুল ও তানিম নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ডকুমেন্টারির মতো মানুষদের কাছ থেকে দাস পার্টি বিষয়ক কথা রেকর্ড করতে থাকেন।

চা-এর দোকান থেকে দীর্ঘ সময় পর উঠে বাজারের ভেতর দিয়ে আমরা ইতস্ততঃ হাঁটতে থাকি। মাঝেমধ্যে কোন একটা ভুষিমালের দোকান, একটা চুল কাটার সেলুনে ঢুকে দুই মিনিটের কথাবার্তা রেকর্ড করি- দাস পার্টি, মুক্তিযুদ্ধ এ সংক্রান্ত। সেই সময়ে তরুণ ছিলেন এমন মানুষ থেকে শুরু করে এই সময়ের তরুণ পর্যন্ত। ‘ ইলিয়াসকে চিনেন? মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস?’- এক তরুণ বলছিলেন- ‘ইল্যাস বেটা যুদ্ধের সময় বহুৎ মানুষ মারছে, তাই এখন তার মাথা নষ্ট’!

গত ২৪ ঘন্টার পর্যবেক্ষণে আমরা বুঝি, এলাকায় ইলিয়াসের পরিচিতি মোটামুটি এরকমই। মাথাগরম, অন্যায় সহ্য না করা উচ্চকন্ঠের মানুষটাকে সবাই পছন্দ করেনা কিন্তু সমীহ করে এখনো। কেউ কেউ নিশ্চয় ঘৃণা ও করে কিন্তু সরাসরি তার সাথে লাগতে আসার সাহস এখনো কারো নেই।

তারাবীর নামাজ শেষে আমরা আবার বসি ছাদের উপর। গতরাতের মতো অতোটা তীব্র না হলে ও তারার আলোয় উজ্জ্বল একটা রাত। এবার একটু গুছিয়ে তার সাথে কথা বলি, বিশেষ করে তাদের যুদ্ধদিনের টাইমলাইনটা বুঝতে চেষ্টা করি।

বালাট থেকে তারা ১১৪ জনের দল গিয়েছিলেন ইকো-১ এ প্রশিক্ষণে। প্রশিক্ষণ শেষে এদের মধ্যে ৩৬ জনকে নবগঠিত টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে সম্পৃক্ত করা হয় জুলাই’র ১ম সপ্তাহে। কমাণ্ডার জগতজ্যোতি দাস আর টু আই সি ধর্মপাশার আলী আমজদ।

জুলাইর দ্বিতীয়/ তৃতীয় সপ্তাহে তাদের প্রথম অপারেশন সদরপুর ব্রীজ ধ্বংস। টেকেরঘাট সাব-সেক্টর থেকে অনেক দূরে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের এই ব্রীজটি সফলভাবে উড়িয়ে দিয়ে তারা ফিরে যান টেকেরঘাটে।

টেকেরঘাট থেকে আগষ্ট এর তিন তারিখে শুরু হয় গুরুত্বপূর্ণ জামালগঞ্জ-সাচনা অপারেশন। মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুই দলের সাথে দাসপার্টি ও যোগ দেয় এই অপারেশনে। প্রথমদিনের আক্রমণে ইলিয়াস পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে টেকেরঘাট ফিরে গেলে তার জায়গায় আসেন কিশোরগঞ্জের সিরাজ। সিরাজ শহীদ হন এই যুদ্ধে। (ইলিয়াস আমাকে নিশ্চিত করেন যে, শহীদ সিরাজ বীরবিক্রম দাসপার্টিরই সদস্য ছিলেন।)
চলবে...

দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-১
দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-২
দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-৩
দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-৪
দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-৫
দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-৬
দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-৭
দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-৮
দাসপার্টির খোঁজে : খসড়া পর্ব-৯

আপনার মন্তব্য

আলোচিত