সিলেটটুডে ডেস্ক

০৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০১:৪৭

‘সংসদ আইন প্রণয়নে অপরিসীম ক্ষমতাবান নয়’

অপারেশন ক্লিনহার্ট নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথবাহিনীর অপারেশন ক্লিনহার্ট- কে দায়মুক্তি দিয়ে জাতীয় সংসদে করা আইন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় প্রকাশ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সোমবার ৫২ পৃষ্ঠার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়।

রায়ের পর্যাবেক্ষণে বলা হয়েছে। জাতীয় সংসদ কোন ভাবেই সংবিধানের বিধানবলীর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করবে না। সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নন। সংসদকে কখনই ভুল করা কিংবা ভুলে গেলে চলবে না যে তাদের ক্ষমতা সংবিধানের অন্যান্য বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। কারণ সংবিধান লিখিত।

রায়ে বলা হয়, এই অভিযানের সময় যৌথ বাহিনীর কোনো সদস্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবে।

এ সংক্রান্ত জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোহাম্মদ আশরাফুল কামাল সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’কে দায়মুক্তি আইন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করেন। রায় দেয়ার এক বছর তিন মাস পর সোমবার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হলো। মূল রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের সিনিয়র বিচারক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। নিজস্ব অভিমত দিয়ে রায়ে একমত পোষণ করেছেন কনিষ্ট বিচারক বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।

রায়ে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়ন না করতে জাতীয় সংসদকে বারণ করে আদালত বলেছেন, আইনগত প্রতিকার পাওয়ার অধিকার সংবিধান সকল নাগরিককে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোনো আদালতে প্রতিকার চাইতে এবং কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করতে পারবে না-এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ যথা-নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি অঙ্গই সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট। অর্থাৎ তিনটি অঙ্গের কেউ সার্বভৌম নয়। প্রত্যেকটি অঙ্গ সংবিধানের বিধি বিধান সাপেক্ষে স্বাধীন। শ্রেষ্ঠত্ব শুধুমাত্র এই সংবিধানের। সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মানে জনগণের শ্রেষ্ঠত্ব। জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছার প্রতিফলন এই সংবিধান। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গই সংবিধানের বিধি বিধান মেনে চলতে বাধ্য।

সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের সকল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধুমাত্র সংসদের এবং এই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সংসদ স্বাধীন। এতদ্বসত্ত্বেও এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদের কিছু সুনিদ্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। অর্থাৎ সংসদকে আইন প্রণয়ন করতে হবে সংবিধানের ‘বিধানবলী সাপেক্ষে’। জাতীয় সংসদ কোন ভাবেই সংবিধানের বিধানবলীর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করবে না। সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নন। সংসদকে কখনই ভুল করা কিংবা ভুলে গেলে চলবে না যে তাদের ক্ষমতা সংবিধানের অন্যান্য বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। কারণ সংবিধান লিখিত। দেশের জনগণ সকলকেই এই সংবিধানের বিধি বিধান মোতাবেক চলার নির্দেশনা দিয়েছে।

রায়ে বলা হয়, যৌথ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আইনের উর্ধে্ব নয়। ইতমধ্যে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে কেউ আইনের উর্ধে্ব নয়, বরং সকলেই আইনের অধীন। যৌথ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে যদি কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে তা বেআইনি, অসাংবিধানিক ও নিন্দাযোগ্য।

এ ধরনের কোন নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখেন। রায়ে বলা হয়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফজতে মৃত্যুর ঘটনা হচ্ছে মানবাধিকার লংঘনের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। সংবিধান অনুসারে একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীরও আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। আমরা মনে করে যৌথ বাহিনী বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না।

রায়ে বলা হয়েছে যৌথবাহিনীর ওই অভিযানের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা ফৌজদারি ও দেওয়ানী মামলা করতে পারবে এবং প্রতিকারের জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদনও করতে পারবেন।

আদালতের পর্যবেক্ষণে বলেন, সংসদ দায়মুক্তি আইন করতে পারে না, ইচ্ছাকৃত নয়, এমনটা ঘটলে দায় মুক্তি দেয়া যেতে পারে। সংসদকে মৌলিক অধিকারের দিকে খেয়াল রেখে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

বিএনপি জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর ওই অভিযান পরিচালিত হয়। ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩’ করা হয়। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না ২০১২ সালের ১৪ জুন হাইকোর্টে এই রিট আবেদন করেন। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ড. শাহদীন মালিক। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যডভোকেট এম মনজুর আলম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহের হোসেন সাজু।

রিটের প্রাথমিক শুনানি করে একই বছরের ২৯ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দ সমন্বয়ে গঠিত  বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে পরিচালিত অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনটি কেন সংবিধানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ওই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চাওয়া হয়। সরকারের আইন সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিব, সেনাসদর দপ্তরের কমান্ডার ইন চিফ অব আর্মড ফোর্সেস ও পুলিশের আইজিকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

রিট আবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে। এর ১৪ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কেউ নির্যাতিত হলে ও এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ প্রদানে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। অথচ দায়মুক্তি আইনে বলা হয়, অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কোনো আদালতে প্রতিকার চাইতে পারবেন না। কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করা যাবে না, যা এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

রিটে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তথ্য সংবলিত ৪০টি পত্রিকা কাটিং রিটে সংযুক্ত করা হয়েছিল। ওই নিরাপত্তা হেফাজতে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়।

‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ দায়মুক্তি আইন প্রসঙ্গে বলা হয়, শুরুতেই আইনটি বাতিল। জন্মই যার মৃত্যু, তার কোনো ভিত্তি নেই। সুতরাং এই আইনের কোনো কার্যকরিতা নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিতে ১৯৭৫ সালে ইনডেমনেটি অধ্যাদেশ করা হয়েছিল, এই নিয়ে কেউ উচ্চ আদালতে চালেঞ্জ করেননি। যা দুর্ভাগ্য ও দুঃখজনক। এই প্রথম দায়মুক্তি আইন নিয়ে কেউ রিট করেছেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত