সিলেটটুডে ডেস্ক

২০ জুন, ২০২৩ ১১:২৭

আর্থিক ঘাপলায় গণ-অধিকারে বিরোধ, প্রশ্নবিদ্ধ নুর

ড. রেজা কিবরিয়াকে আহ্বায়ক এবং নুরুল হক নূরকে সদস্য সচিব করে ২০২১ সালের অক্টোবরে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ। ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টের সঙ্গে বৈঠক ও আর্থিক লেনদেন নিয়ে বিরোধে ভেঙে যেতে বসেছে গণঅধিকার নামের রাজনৈতিক সংগঠন। অভিযোগের তীর খোদ সংগঠনটির সদস্য সচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে। এনিয়ে গণঅধিকার পরিষদে চলছে তোলপাড়।

নুর মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন খোদ তারই দলের সদস্যরা। তাদের দাবি, দলের নামে তহবিল এনে কাতারেই এক প্রবাসীর গাড়ি ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছে সেই টাকা। শুধু তা-ই নয়, নুরের বিরুদ্ধে দেশের একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া, বিভিন্ন ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ, দলের জন্য প্রবাসীদের দেওয়া টাকার হিসাব না দেওয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগ এনেছেন দলের কয়েকজন নেতা।

গত রোববার রাতে অনুষ্ঠিত গণঅধিকার পরিষদের বৈঠকে এ নিয়ে তুলকালাম হয়ে গেছে। নুর যেমন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে টাকা নেন, এবং তার হিসাব দেন না বলে অভিযোগ ওঠেছে। এনিয়ে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে নুরের অনুগত কয়েকজন দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার দিকে তেড়ে যান বলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানিয়েছেন।

ঘটনার জেরে দলটির প্রধান নির্বাচন ব্যবস্থাপক এবং গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান জাকারিয়া পলাশ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলেও জানা গেছে।

এদিকে, রোববারের বৈঠকের পর সোমবার মধ্যরাতে নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী সভায় বর্তমান কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ঘোষণা করা হয়।

সূত্র জানায়, গত রোববার সন্ধ্যায় গুলশান ২ নম্বর সেক্টরের ৫৫ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়িতে দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার বাসার ছাদে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সংসদের বৈঠক বসে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। দলের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর বৈঠকে আসেন সাড়ে ৮টার দিকে। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রেজা কিবরিয়া। তিনি বলেন, ৭টার বৈঠকে কেন সদস্য সচিব সাড়ে ৮টায় উপস্থিত হবেন? এর পর থেকেই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলতে থাকে। যার রেশ থাকে শেষ পর্যন্ত। রাত ৯টা নাগাদ এক পর্যায়ে রাগ করে উঠে বাসায় চলে যান রেজা কিবরিয়া।

আলোচনার এক পর্যায়ে রেজা কিবরিয়া নুরুল হক নুরের ইসরায়েলি এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “গণঅধিকার পরিষদের নামে প্রবাস থেকে আসা টাকার হিসাব কোথায়? কেন নুর ইসরায়েলি মেন্দি এন সাফাদি ও তার ‘বাংলাদেশি বন্ধু’ শিপন কুমার বসুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন?”

এসব নিয়ে বৈঠকের পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর আরও কয়েকজন নেতা নুরের টাকার লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি আরও বলেন, শিপন বসুর সঙ্গে বৈঠক করে নুর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী নিয়ে তারা পৃথক হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করেছেন। এর পৃষ্ঠপোষক হলো মেন্দি এন সাফাদি। তিনি কেন সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন? কীসের লোভে? আমাদের কাছে কোনো উত্তর দিতে পারছেন না। তিনি এটাকে এড়াতে গিয়ে আমার ইনসাফ কায়েমে যাওয়ার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

রেজা কিবরিয়া নুরের উদ্দেশে বলেন, ‘দুবাইয়ে মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে মিটিং করতে নুর ট্যাক্সি দিয়ে যাননি। তাকে আমাদের লোক (দুবাইয়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতারা) গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছেন। তারাই কনফার্ম করেছেন যে, এ রকম মিটিং হয়েছে এবং মিটিং শেষে তিনি (নুর) একটা কালো ব্যাগ নিয়ে ফিরেছেন। তবে কালো ব্যাগে কী ছিল, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমাদের প্রশ্ন হলো, কেন ইসরায়েলিদের সঙ্গে মিটিং হবে, এটার কারণ কী?’

রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘নুর এত গাড়ি কোথায় পান! এর আগে বলা হয়েছিল কাতারের সভাপতি গাড়ি দিয়েছে। এভাবে চলতে পারে না। কাতারের সভাপতি কেন গাড়ি দেবে? তাহলে কি সংগঠন অন্যদের মতোই হবে। এরপর যে নেতা হবে, সে-ও এ রকম গাড়ি পাবে। গাড়ি দিলে, তাকে কেন সভাপতি বানাতে হবে। সভাপতি বানানোর বিনিময়ে গাড়ি কেন নিতে হবে।’

তখন নুর বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ আমাকে গাড়ি দিতে পারে। আমি পার্টির প্রেসিডেন্ট না। কিন্তু আমি ডাকসুর সাবেক ভিপি। আমার পরিচিতি আছে।’

গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক বলেন, আমার কথা খুব পরিষ্কার, সরকারবিরোধী মিটিংয়ে আমি যাব। সরকারের বিরুদ্ধে যে দলই মিটিং করুক, তারা যদি দাওয়াত দেয় তাহলে আমি যাব। কোনো অসুবিধা নেই। আমি তো সরকারের পক্ষে কোনো কথা বলিনি। আমি সরকারের পক্ষে মিটিং করেছি- এ দাবি তো হাস্যকর। নুর বলছেন, আমি সরকারের এজেন্টদের পক্ষে কাজ করছি। আমার সন্দেহ তিনি সরকারি দলের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে দলে একটা ভাঙন তৈরি করার জন্য কাজ করছেন। আমি তাকে সন্দেহ করি... তিনি সরকারি এজেন্ট হতে পারেন! যদিও আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তবে একদিন প্রমাণ পাব, যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন আমি সব খবর পেয়ে যাব। মানুষের সামনে তা তুলে ধরতে পারব। আমার সন্দেহ সরকারি স্বার্থ রক্ষার জন্য দলে একটা ভাঙন তৈরি করার চেষ্টা করছেন নুর।

তিনি বলেন, সমস্যাগুলো হলো- প্রবাসীদের টাকা কোথায় যায়! ইসরায়েলিদের সঙ্গে কেন তিনি গোপন মিটিং করলেন? ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে তার কী আলোচনা হয়েছে? সেগুলো তো আমরা জানি না। এসব জানাতে চাওয়া হলে, কোনো উত্তর নুর দিতে পারেননি। তখন তিনি উল্টো আমাকেই চার্জ করেছেন যে, ইনসাফ কায়েমের মিটিংয়ে গেছি, এটা বিএনপিবিরোধী গ্রুপ। তখন আমি বলেছি, আমি তো বিএনপির এজেন্ট না। বিএনপির সদস্যও না, তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে কোনোকিছু স্বাক্ষরও করিনি। আর ইনসাফ কায়েম কমিটিতেও আমি নেই। অতিথি হিসেবে সেখানে গিয়েছি। সরকারবিরোধী যেকোনো চক্রে আমি থাকব। কারণ আমি চাই, এ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হোক। এ ব্যাপারে কারো কাছে জবাবদিহি করা বা কারো হুকুমে আমি চলি না। নুর আমাকে হুকুম দেবে, এভাবে তো চলবে না। আমাকে নিয়ে যে ধরনের প্রশ্ন করেছেন, সেটা খুবই বাজে এবং অসম্মানজনক বক্তব্য। এ ধরনের লোকের সঙ্গে আমি কাজ করতে চাই না। যদি অসৎ লোকের সঙ্গে কাজ করতে হয় তাহলে আমি তো আওয়ামী লীগে থাকতাম। সেখানে ভালো অবস্থানে থাকতাম।

এসব বিষয়ে নুর তার বক্তব্যে সাফাদির কাছ থেকে টাকা আনার বিষয়টি অস্বীকার না করে বলেন, ‘বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা আনি দলের জন্য। তা দলের পেছনেই ব্যয় করি। কাতারে আমার কোনো ব্যবসা নেই। সেখানে পরিচিত একজন ব্যবসায়ীর গাড়ির শোরুম রয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম এ পর্যন্তই।’

এমন বক্তব্যের এক পর্যায়ে যুগ্ম আহ্বায়ক আবু হানিফ রেজা কিবরিয়ার কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘রেজা কিবরিয়া প্রতি মাসে ৩ লাখ টাকা করে নেন ইনসাফ কমিটি থেকে। আর এই টাকার বিনিময়ে তিনি গণঅধিকার পরিষদকে তাদের পক্ষে কাজ করানোর চেষ্টা করেন।’ তবে রেজা কিবরিয়া তাৎক্ষণিক এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এক পর্যায়ে আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া দলের অর্থ বিভাগের প্রধান শহিদুল হক ফাহিমের কাছে আর্থিক হিসাব-নিকাশের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সরকার যদি কখনো কোনো সংস্থা দিয়ে আর্থিক বিষয়গুলো অডিট করায়, তখন মামলা খেতে হবে। তুমি দলকেও বিপদে ফেলবে।’

বৈঠকের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. শামসুদ্দীন আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আমাদের দলের দুই শীর্ষ নেতার একজন কি তাহলে সিআইএর, একজন মোসাদের। আমরা দল তাহলে কার জন্য করছি! বাংলাদেশের রাজনীতি না করে আমরা কি সিআইএ এবং মোসাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছি।’

এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে চলা বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে রেজা কিবরিয়াকে মারতে উদ্যত হন গণঅধিকারের যুগ্ম আহ্বায়ক বিপ্লব পোদ্দার এবং অর্থ বিভাগের প্রধান শহিদুল হক ফাহিম। যুগ্ম আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, রাশেদ খান, ফারুক হাসান, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব আতাউল্লাহ, যুগ্ম সদস্য সচিব তারেক রহমান পরিস্থিতি শান্ত করতে উদ্যোগী হন। এ অবস্থায় রেজা কিবরিয়া বৈঠক ত্যাগ করেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত