নিজস্ব প্রতিবেদক

০৭ জানুয়ারি, ২০২০ ১৫:৪১

টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র: বিস্ফোরণের ১৫ বছর পরও উদগিরণ হচ্ছে গ্যাস

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণের ১৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এ দীর্ঘ সময় পরও গ্যাসফিল্ডের আশপাশের এলাকাজুড়ে প্রতিনিয়ত গ্যাস উদগিরণ হচ্ছে এখনো। বিশেষ করে টেংরাটিলা গ্রামের কৃষিজমি, পুকুর, টিউবওয়েলসহ বিভিন্ন সড়ক এমনকি বসতঘরের ফাটল দিয়েও বুদবুদের মতো করে বেরিয়ে আসছে গ্যাস। ব্যাপক নিঃসরণ বজায় থাকায় আশপাশের গ্রামগুলোতেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক স্বাস্থ্য সমস্যা।

২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি রাত ১০টায় সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। সে সময় গ্যাসফিল্ডের প্রডাকশন কূপের রিগ ভেঙে আগুনের উচ্চতা উঠে যায় ২০০-৩০০ ফুট পর্যন্ত। গ্যাসফিল্ডের আগুন জ্বলতে থাকে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে।

দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণ ঘটে একই বছরের ২৪ জুন রাত ২টায়। ওই সময় গ্যাসফিল্ডের আগুন আশপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব্যাপক আতঙ্কের সঞ্চার করে। কূপ এলাকার তিন কিলোমিটার দূরেও অনুভূত হয় ভূকম্পন। দুই দফা অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় টেংরাটিলা, আজবপুর, গিরিশনগর, কৈয়াজুরি, টেংরাবাজার এবং শান্তিপুরের বসতবাড়ি, গাছগাছালি ও হাওড়ের ফসলি জমি।

স্থানীয়রা জানান, বিস্ফোরণের পর আজ পর্যন্ত একদিনের জন্যও ওই এলাকায় বুদ্বুদ আকারে গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ হয়নি। এতে ১৫ বছর ধরে দূষিত হয়ে আসছে টেংরাটিলা ও আশপাশের বাতাস। ফলে স্থানীয়দের মধ্যে নানা ধরনের রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাবও রয়েছে ব্যাপকভাবে।

এছাড়া এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্তরা। এমনই একজন ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দা সফিক মিয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ব্লো-আউটের (বিস্ফোরণ) ১৫ বছর পরও এখনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। যদিও এখনো নিঃসরিত হচ্ছে গ্যাস। পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়েছে। এলাকায় হাঁপানিসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়েছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, যাতে দ্রুত আমাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে সুনামগঞ্জের ডেপুটি সিভিল সার্জন আশরাফুল আলম জানান, টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড এলাকায় বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা আছে। স্থানীয়দের মধ্যে হাঁপানি, অ্যালার্জি, শরীরের বিভিন্ন অংশে জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এছাড়া টিউবওয়েলের পানিতেও আর্সেনিকের মাত্রা বেড়েছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা প্রতি বছর এসব গ্যাস নিঃসরণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা করে থাকি। সে তালিকা অনুযায়ী বিভিন্ন সময় আমরা স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ ও সেবা দিয়ে আসছি। এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

এদিকে স্থানীয়দের কেউ কেউ ঝুঁকিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ স্থানীয় প্রযুক্তিতে গ্যাস উত্তোলন করে ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এ গ্যাস রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হলেও এটি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ এখানে নেই। এছাড়া এ বিস্ফোরণ ও বিস্ফোরণের পর থেকে চলমান গ্যাস উদ্গিরণের কারণে এলাকার কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্যও এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

তারেক আহমদ নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ফলে গ্যাসফিল্ডের আশপাশ এলাকায় ফসলি জমিতে কোনো ধরনের ফসল আবাদ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে গ্যাস উদ্গিরণের বিরূপ প্রভাবে গাছপালাসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া আমাদেরও নানা রোগবালাইয়ে ভুগতে হচ্ছে।

টেংরাটিলা গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড একটি সরকারি সম্পদ। এখানে প্রচুর গ্যাস আছে। এখনো অনেক গ্যাস উড়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ভুগতে হচ্ছে স্থানীয়দেরও।

একই কথার পুনরাবৃত্তি করে স্থানীয় সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার মামুনুর রশিদ বলেন, ব্লো-আউটের ফলে এলাকায় অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পায়নি। টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এটির সুরক্ষা প্রয়োজন।

সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ফলে স্থানীয় জীববৈচিত্র্যেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখনো বিস্ফোরণস্থলের আশপাশে গ্যাস উদ্গিরণ হচ্ছে এবং এ গ্যাস অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনারও আশঙ্কা তৈরি করে। কিন্তু ২০০৫ সালের বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো নিয়ে বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। মামলার আদেশ পাওয়া গেলে এ বিষয়ে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে বলে আমরা আশাবাদী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত