সিরাজুম মুনিরা

০৯ এপ্রিল, ২০১৬ ১৭:৫১

কেরালা: গাঢ় সবুজ আর মেঘ-পাহাড়ের দেশে

প্রথম অংশ: মুন্নার

দ্বিতীয়বার ভারত ভ্রমণ নিয়ে লিখব লিখব করে আঙুল কি-বোর্ডে বসছিলই না। আসলে কাগজে কলমে লেখা অনেক সহজ। ভাবের গভীরতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা কলমেই বোধ করি বাঙালির ভালো ভাবে আসে।


সে যাই হোক, ইদানীং ক্রিকেট ম্যাচ থেকে শুরু করে জাতিগত বিদ্বেষে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক যে সীমানায় পৌঁছেছে তাতে আবার ভারতে যেতে পারব কিনা কে জানে! অথচ এই দুই দেশের সম্পর্ক এমন হবার কথা ছিলনা। আবার সব ভারতীয় যে একইভাবে বাংলাদেশকে দেখে এটাও সত্য না। ভারত শত কোটিরও বেশি মানুষের দেশ। এদের মন ও প্রকৃতিও বৈচিত্র্যময়। জাতিগত বিদ্বেষ দমন বা ভারতের মাহাত্ম্য প্রকাশ আমার উদ্দেশ্য নয়। কেবলই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বলাই আমার মুখ্য ও একমাত্র উদ্দেশ্য। আমি শিল্পী নই যে এক করতে যেয়ে হয়ে যাবে আরেক।

ভ্রমণের জন্য অনেকেরই ভারত পছন্দের নয়। কেউ নিরাপত্তার কথা ভাবে, কেউ ভিসা না পাবার বিড়ম্বনায় বিরক্ত, কেউ বা ভাবে ভারত যাওয়ার মধ্যে সে রকম কোন স্ট্যাটাস নাই (খরচ আর কি, ২০-৩০ হাজারই হবে, এমনটা বলতে শুনেছি অনেকের কাছে!কিন্তু সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, ভারতের দুই/তিনটা প্রদেশ একটু আরামে আর কম সময়ে ঘুরতে যে খরচ তা দিয়ে ইস্ট এশিয়ার দুই/তিন রাষ্ট্র ঘুরে নেয়া যাবে অনায়াসে।)।


দ্বিতীয়বার ভারত ভ্রমণে বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল দক্ষিণ ভারত। এ এক অন্য রকম ভুবন। এখানে কলকাতার মত অলিগলি, রাজপথ ভর্তি মানুষ আর যানবাহনের ভিড় নেই; দিল্লী কিংবা আগ্রার মত নিরাপত্তাহীনতা নেই; জয়পুর, জয়সেলমির মত দুর্গের মহড়া নেই; সিমলা মানালির মত ওত শান্তও যেন নয়। এ এক অন্য ভারত। তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, লাক্ষাদ্বীপ, পন্ডিচেরী, তেলেঙ্গানা, আন্দামান নিকবোর নিয়ে এক বিশাল এলাকা এই দক্ষিণ ভারত। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর আর ভারত মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত এই ভূমি। আর চারপাশে এত সাগর বলেইতো এর অর্থনৈতিক ভিত শক্ত, জনগণ সুশিক্ষিত, পরিবেশ নিরাপদ এবং প্রকৃতিও এখানে অকৃত্রিম ভাবে সাজিয়েছে নিজেকে। এতগুলো রাজ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। কেবল তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্র প্রদেশ/তেলেঙ্গানার কিছু অংশ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সন্তুষ্ট না বলে পরিতৃপ্তই বলি। নতুবা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মাহাত্ম্য ছোট করা হয়।


দক্ষিণ ভারত দেখা শুরু করি হায়দ্রাবাদ দিয়ে। কিন্তু এই লেখায় শুধু কেরালা আর তামিলনাড়ুর অংশটিই আসবে। হায়দ্রাবাদ আসবে অন্যভাবে। বাংলাদেশ থেকে কেরালার দূরত্ব প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার। কেরালা ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমাংশে  অবস্থিত একটি রাজ্য। আমাদের যাওয়ার রুট ছিল কলকাতা থেকে হায়দ্রাবাদ বিমানবন্দর এবং সেখান থেকে কেরালার কোচি বিমানবন্দর। কেরালায় মোট তিনটি বিমানবন্দর আছে। রাজধানী ত্রিভান্দ্রামে একটি, কোচিতে একটি এবং অন্যটি কালিকুটে। সরাসরি কলকাতা থেকে কোচিতে ফ্লাইট নেই। কলকাতা থেকে অবশ্য রেল পথে কোচি যাওয়া যায়।     

হাওড়া থেকে এরনাকুলাম যেতে প্রায় দুইদিনের ঝক্কি। তাই বিমানকেই বেছে নেয়া। কোচি এয়ারপোর্ট ছিল অনেক ছিমছাম।যে যায়গায় এয়ারপোর্ট তার নাম নেদুম্বাসেরি। ভিড় ওত একটা নেই বললেই চলে। কেরালাতে ভ্রমণের জায়গা অনেক। মুন্নার, কভালাম, আলেপ্পি, কুমারাকাম,ভারকালা, ওয়াআন্ড, ভাগামন, ত্রিভান্দাম, ত্রিশুর, কালিকুট, থেনমালা,থেক্কাডি, পেরিয়ার ইত্যাদি। সব আমরা একবারে যেতে পারিনি। সম্ভবও না। আবার কিছু যায়গা একই রকম সৌন্দর্যের ছটা। যেমন  পাহাড় পর্বতের সৌন্দর্যে বিমোহিত হতে চাইলে মুন্নার, ওয়াআন্ড, দেভিকুলাম, পমুন্ডি; ব্যাকওয়াটার দেখতে চাইলে আলেপ্পি, কুমারাকাম;সি-বীচ দেখতে চাইলে আলেপ্পি, কোভালাম, চেরাই, মারারি, ভারকালা, কোল্লাম; ওয়াইল্ড লাইফ দেখতে চাইলে চিন্নার, পেরিয়ার, এরাভিকুলাম, কুমারাকাম ইত্যাদি।

কেরালায় মজার ব্যাপার হল পাহাড়, সমুদ্র, বৃক্ষরাজি সবই আছে। একঢিলে অনেক পাখি আর কি। কোচি এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল মুন্নার।কোচি থেকে মুন্নার ট্যাক্সিতে যাওয়া যায় আর এয়ারপোর্ট থেকেই প্রি-পেইড ট্যাক্সি মিলবে ৩৫০০ রুপীতে। সাদা রঙ এর এসি ট্যাক্সি গুলোর মান বেশ ভালো। এখন প্রশ্ন হল আবহাওয়া কেমন? আমরা যাই সেপ্টেম্বরে তখন না গরম না ঠাণ্ডা এমন ছিল কোচিতে। কিন্তু যতই মুন্নারের দিকে আগাচ্ছিলাম পাহাড়ের ঠাণ্ডা জেঁকে বসছিল। আমি এই পাহাড়ি ঠাণ্ডাটা খুব খুব ভালবাসি বলেই বার বার পাহাড়ে যাওয়া। কোচিতে যতক্ষণ ছিলাম তাতে বুঝলাম এখানে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষই বেশি। রাস্তায় অনেক গির্জা আর যিশু মূর্তি। আর বাড়িগুলো মোটেও উঁচুতলার নয়। সামনে উঠোন আর গাছ সেই সাথে দোতলা বাড়ি। সব বাড়ি প্রায় একই রকম। কিন্তু কি নিরিবিলি আর শান্তি শান্তি ভাব। ভারতের একটা ব্যাপার বেশ ইতিবাচক। ওদের অনেক গাছ। মানুষের বাড়িতেও , রাস্তায়ও। এই জিনিসটা আমরাও গ্রহণ করতেই পারি। ট্যাক্সি গুলোর মালিকও খ্রিস্টানরা। তবে ড্রাইভাররা হিন্দুই বেশি, মুসলিমও আছে। এখানে এক সময় পর্তুগীজরা এসেছিল সেই প্রভাবেই বোধ করি খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাব বেশি। তবে ধর্ম যাই হোক শান্তি আছে বোঝা যায়।

কেরালার ট্যাক্সি গুলোর মধ্যে বেশ একটা ভালো ভাব আছে। বাইরে থেকে ময়লা না ঢুকতে পারে তার জন্যই সব সময় এসি অন করে কাঁচ বন্ধ, সামনে যিশুর মিনি মূর্তি আর যেতে যেতে এত বাঁক রাস্তায়! সিমলা থেকে মানালি যেতেও এত আঁকাবাঁকা রাস্তা ছিল না। যাদের মাথা ঘুরানোর সমস্যা নাই তাদের জন্য ভালো। আমারও নাই। কিন্তু এবার সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল।ভাবছিলাম কখন গাড়ি থামবে। যাক পথে একটা ঝর্ণার ধারে গাড়ি থামল। ওখানে অনেক টুরিস্ট ও ছিল। ঝর্নাটা তেমন আহামরি কিছুনা। কিন্তু রাস্তায় যে ফল বিক্রি হয় যেগুলো বেশ ভালো ছিল। ডাব,কাঁচা আম, পেঁপে, শসা অনেক কিছুই ছিল। সবই যে ফ্রেশ তাতে সন্দেহ নাই। আমাদের দেশে স্ট্রীট ফুডের মতনা। ওরা খাবার পরিষ্কারে বেশ সচেতন। এটা পুরো দক্ষিণ ভারতেই দেখলাম। এটাও শিখার আছে। কাঁচা আমটা বেশ ছিল। কিন্তু আমি এক টুকরা খেতে না খেতেই পতিদেব পুরো প্যাকেটই খেয়ে নিল! যা হোক, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম মুন্নার।

মুন্নার ভারতের কেরালা রাজ্যের ইডুক্কি জেলাতে অবস্থিত। পাহাড় প্রস্তর ঘেরা এই মুন্নার একটি তামিল ও মালায়লাম শব্দের মিশ্রণ যার অর্থ তিন নদী।  নদী গুলোর নাম ও দাঁত ভাঙ্গা কঠিন: মুদ্রাপূজা, নাল্লাথান্নি ও কুণ্ডলী। মুন্নার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত কেরালার একটি হিলস্টেশন। আমরা যেদিন মুন্নারে গেলাম এটা ছিল কুরবানি ঈদের আগের দিন। ওরা বলে বকরি ঈদ। ঈদ আর কি কি মিলায়ে তখন ভারতে প্রায় ৪/৫ দিনের সরকারি ছুটি। আমরা মুন্নারে যেয়ে হোটেল পেতে একটু বিপাকেই পড়লাম। কারণ সব হোটেলই আগে থেকে বুকড হয়ে আছে। বুঝলাম আমরা যেমন ছুটি পেলে কক্সবাজার, সিলেট যাই তেমনি ওদের কেরালা।

যাক শহরের একটু ভিতরে যেয়ে ভালই হল। এত সুন্দর একটা হোটেল পেলাম যে মনঃপ্রাণ জুড়িয়ে গেল । হোটেল ইষ্টএন্ড। ভাড়া একটু বেশি হলেও মান বেশ। যা হোক সস্তার তিন অবস্থা তা আমি সিমলাতে দেখেছিলাম। এবার আর কোন ঝামেলা নয়। এসেছি শখ পূরণে, শোক মাতাতে নয়। হোক ৪৫০০ টাকা রুম রেন্ট। হোটেলের সামনের দৃশ্য এত চমৎকার যে বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে সময় কেটে যাবে অনায়াসে। সমস্যা হল গোসল করতে যেয়ে। এত ঠাণ্ডা যে গরম পানিও গায়ে লাগাতে ভয় হচ্ছিল। সেই সাথে রাজ্যের ক্ষুধা। সেই কখন হায়দ্রাবাদ থেকে সকালের নাস্তা খেয়ে কোচির উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। এখানে বলে রাখা ভালো ভারতের কোন ডোমেস্টিক ফ্লাইটে খাবার দেয়া হয় না! এটা ভালো লাগেনি। দক্ষিণের খাবার নিয়ে বেশ শঙ্কায় ছিলাম। নিশ্চয়ই নারিকেল দিয়ে রান্না হবে। যা হোক সে বেলা কি যে খেলাম এখন আর মনে নাই। তবে দিল্লী আগ্রার চেয়ে ঢের ভাল খাবার। সেদিনতো বেলা পড়েই এসেছিল তাই আশেপাশের এলাকা ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হয়নি। কিছুটা সিমলা বা দার্জিলিং এর মল রোডের মত। ঠাণ্ডা একটা বাতাস আর বৃষ্টির ছোঁয়া। পাহাড়ে বুঝি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে বৃষ্টি হবেই। এ যেন পাহাড় আর বৃষ্টির অভিসারের আই মিন টু সে ডেটিং এর সময়।

এই সুযোগে আমরা লোকাল মার্কেট দেখে নিলাম। বেশ ভালো জিনিসই আছে। বিশেষত রূপচর্চার আর চকলেট। চা ও আছে। এখনাকার চকলেট সব হ্যান্ডমেড। রূপচর্চায় স্যাফ্রন, চন্দন সহ আরও নানান প্যাক। এখানেও অনেক স্ট্রীট ফুড আছে। সমস্যা হল ঝাল খাবারেও মিষ্টি মসলা। যা হোক, বৃষ্টি বাড়ছিল। রাস্তায় মানুষের ভিড় ছিল। এখানেও অনেক গির্জা। আর দলে দলে লোক মালা কিনছিল পূজার জন্যে। এখানে প্রতি সন্ধ্যায়ই ফুল বিক্রি হয়। সাউথের মানুষ গুলো দেখতে কালো আর বিশালাকার আর রাগী চোখের হলেও এদের স্বভাব বোধ করি ভারতের অন্য প্রদেশের মত হিংস্র নয়। ও ভালো কথা এখানে খুব সমস্যা ভাষার। এরা হিন্দি পারেই না। ইংলিশ কেউ কেউ পারে। মালায়লাম আর তামিল ই বলে সবাই। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে আকাশ থেকে পড়ে। এখান থেকে কেউ নাকি যায়না। যা হোক কার এত সাহস যে লক্ষ টাকা খরচ করে এই অচিন শহরে যাবে। কিন্তু কেরালা না গেলে যে বুঝতামই না, কেরালা কে কেন ভগবানের নিজের দেশ বলে।


হোটেলে ফিরে ভাবছিলাম এই লম্বা নিশি কি করে যাপন করব। টিভিতে বাংলা দূর হিন্দি চ্যানেলও ধরেনা। সন্ধান পেলাম হোটেলেই আছে নিজস্ব আয়ুর্বেদ সেন্টার। দেরী না করে ছুটলাম। রাত প্রায় আটটা বাজে। শুরু করলাম ফেসিয়াল। ম্যান ফর ম্যান, উইম্যান ফর উইম্যান। বিপরীত আছে কিনা আমার জানা নাই। এদের হাতের কাজ অন্য রকম। আমাদের পার্লারের মত কেমিক্যালের ইউস না, বরং প্রাকৃতিক উপাদানই ব্যবহৃত হয়। আমাদের পার্লারকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য না। ব্যবসায়িক সততার ব্যাপারটাই ইস্যু। আর যেই মেয়েটা কাজ করল আহা কি তার হাতের ছোঁয়া। মেয়েটা কৃষ্ণবর্ণ আর সুক্ষ্মকায় । কিন্তু তার হাতের কাজ যে অসাধারণ! এক সময় সে বিহারে কাজ করত। ভাবা যায়, দক্ষিণ থেকে সেই বিহারে যেয়ে একটা মেয়ে থাকত। কতটা কাজের দরকার হলে এত কষ্ট মেয়েরা করে। ভারত এখনও যা পারেনি তার সব রাজ্যের সব মানুষকে উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে। সে যাই হোক, পার্লারের ব্যাপারে বলি যে, বাংলাদেশের নামীদামী স্পা সেন্টারে যাওয়ার মত আর্থিক বা মানসিক জোর আমার হয়নি। তবে আমার মনে হয়না আমাদের এখানে এত কম খরচে এত ভালো সার্ভিস পাওয়া যাবে। সময় থাকলে কেউ বডি স্পা টা করাতেই পারেন।



যা হোক এবার হোটলে রুমে ফেরার পালা। কিন্তু সেই কি বৃষ্টি । আমাদের ঘনঘোর বর্ষার মতই। ছাতা মাথায় ফিরে সোজা ডাইনিং এ। এদের ডাইনিং টা চমৎকার। বেশ বড় পরিসরে। কথায় কথায় জানলাম এখানকার বেশিরভাগ কর্মী এসেছে ভারতের মনিপুর, পশ্চিমবঙ্গ এসব রাজ্য থেকে। বছরে একবার বা দুই বছরে একবার এরা বাড়ি যায়। ভারতের এক রাজ্যের মানুষের কাছে আরেক রাজ্য প্রবাস জীবনেরই মতই। দক্ষিণের খাবার ততটা খারাপ নয়, যতটা ভেবেছিলাম। আলু চাট বলতে একটা খাবার দিল , কত চেষ্টা করলাম দেশে এসে বানানোর হলই না ওমন। ওদের মাছ ও বেশ সুস্বাদু খেতে। দামের কথা বলতে কমও না বেশিও না। বাইরের হোটেলে খেলে স্বাভাবিক একটু কমই লাগত। তখনও বাইরে বৃষ্টি ঝরছেই। ডাইনিং এ অনেক মানুষের আনাগোনা। ব্যস্ত সময়, ব্যস্ত জীবন... ব্যস্ত প্রকৃতিও।


মুন্নারে রাত টা কেন যে একটু ভুতুড়ে ছিল বুঝলাম না। সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখলাম, এমনকি সাহেবও মাঝ রাতে জেগে বলল বাতিটা জ্বলুক। কি জানি, হয়ত নিজ দেশ থেকে যোজন যোজন দূরে, অচেনা ভূমিতে, জলপাহাড়ের দেশে দুইজন মাত্র মানুষ তাই একটা ভয় ছিল মনে। পরদিন ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। ট্যাক্সি ঠিক করাই ছিল হোটেলের পক্ষ থেকে মুন্নার ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। দিনটা কুরবানি ঈদের দিন। যদিও সবাই খুব অবাক আর বিরক্ত যে এমন দিনে কেউ ঘর ছেড়ে বাহির হয়? এ দিনে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে কুরবান করতে হয় পশু। আর আমি কিনা বসে আছি প্রকৃতি দেখতে। আচ্ছা ভেবে বলুনতো , এই প্রকৃতিও কি সেই স্রস্টারই সৃষ্ট নয়? তার সৃষ্টির সৌন্দর্য কি হৃদয়ে ধারণ করার অধিকার আমার নেই? আমিওতো তারই জয়গান করছি।

ঈদের সকালে এখানেও নামাজ হয়। কেরালায় আমার সবচেয়ে ভালো লাগল এই ধর্মনিরপেক্ষ ভাবটা। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান সব মানুষের বসবাস এখানে। প্রকৃতিই বুঝি মানুষের মনকেও উদার করে। প্রকৃতিতেই বুঝি প্রকৃত ঈশ্বরের বাস।

সাহিত্য কম করি, ঘুরার কি কি আছে তাই বলি। মুন্নারে দেখার আছে অনেক কিছু। উল্লেখযোগ্য হল, এরাভিকুলাম ওয়াটার ফল ও ন্যাশনাল পার্ক,আত্তুকার ওয়াটার ফল,  টি- ভ্যালি, মাতুপেত্তি ড্যাম, ইকো পয়েন্ট, রাজমালা, কুন্ডলা লেক, টাটা টি মিউজিয়াম, ব্লসম পার্ক, পথামেন্দু ভিউ পয়েন্ট, ইন্দ-সুইস ডেইরি ফার্ম আরও কত কি! সব কি আর একদিনে দেখা যায়?



আমরা কিছু কিছু জায়গা বেছে নিলাম। মুন্নারের ব্লসম পার্ক এর ফুলের সমারোহ যে কি অসাধারণ তা না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। আর সব ফুলেরই গাঢ় রং। ম্যাজেন্টা, হলুদ, কমলা, ঘন ক্রিম, বেগুনি, উজ্জ্বল গোলাপি, নীল, টকটকে লাল।  আমাদের দেশের বলদা গার্ডেন কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেনে যদি একটু সৌন্দর্য আর নিরাপত্তার ছোঁয়া দেয়া যেত! বার বার এটাই মনে হচ্ছিল। সেই সব ফুলের কি রঙ কি রূপ যেন ভুবনমোহিনী তার রূপের পসার নিয়ে বসেছে। এরপর পথে থেমে থেমে আরও দেখলাম বিভিন্ন ওয়াটার ফল আর ড্যাম। মাতুপেত্তি ড্যাম মূলত হাইড্রলিক প্রজেক্টের অধীনে পানি সমস্যা সমাধানে নির্মিত। এদের লেক স্বচ্ছ । মাতুপেত্তি ডেইরী ফার্মে চড়ে বেড়াচ্ছে গবাদি পশুর দল। এরা আবার বৈজ্ঞানিকভাবে পালিত উচ্চমানের ক্যাটেল। এরপর কুন্দলা লেক। চাইলে এখানকার লেকে ভ্রমণ করা যায়। কিন্তু যারা আলেপ্পি যাবেন তাদের এই লেকে না ঘুরলেও চলবে। পানির খেলা তো সেই আলেপ্পিতে। এখানে শুধু দূর থেকে দেখে ছবি তোলাই শ্রেয়তর। যেতে যেতে আরও দেখলাম কিছু গির্জা আর অদ্ভুত এক মন্দির। গাছের উপর মন্দিরের চিন্ময় দেবদেবীর মৃন্ময় রূপ। কোন দেবতা বলতে পারবনা। বজ্রংবলি হতে পারে বা অসুর ও! পথে যে চা বাগানের সৌন্দর্যের দেখা মিলবে তা অতুলনীয়া। আমাদের সিলেটের কিংবা দার্জিলিং এর চেয়ে এগুলোর বিস্তার অনেক বেশি। আসলেই ঠিকই বলে, আল্লাহ যারে দেয়, ছাপ্পর ফেইলা দেয়। চারিদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ।



এখানে চেন্নাই এক্সপ্রেস মুভির কিছু শুটিং হয়। সেই যে "কাশ্মীর তু মে কন্যাকুমারী..." এখানে নেমে চাইলে ছবি তোলা যায়, ঘোড়ায় চড়া যায়। সিমলাতে ঘোড়ায় চড়ার যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল এরপর আর ঘোড়া দর্শনের সাধ মিটে গেছে। ঘুরেই শান্তি, ঘোড়ায় না। কিন্তু তাই বলে কি বাঙালির শিক্ষা হয়? এরপরে হাতিতে চড়ব এবং আবার আতঙ্কগ্রস্ত। এলিফ্যান্ট পার্কে হাতিতে ঘুরানো হয় ১৫ মিনিটের মত। খরচ ছবি তোলা সহ পাঁচশর মত। হাতিতে বসে তো আর নিজের ছবি হাতিসমেত তোলা যায়না, তাই এই প্যাকেজ টি নেয়া।

 ওখানে পরিচয় হল ভারতীয় এক কাস্টম অফিসারের সাথে। সে বাংলাদেশ চিনে এবং একটু বেশ অবাকই হল যে এত দূর এসেছি। পরিচয় হল তার স্প্যানিশ বন্ধু যুগলের সাথে। অফ চান্সে আমার স্প্যানিশ চর্চা টা করে নিলাম। ভাষা জানা এক দারুণ ব্যাপার। স্প্যানিশ মেয়েটি হাতিতে চড়বে কিন্তু তার বয় ফ্রেন্ডের হাতি ফোবিয়া, উনি চুপচাপ নিচেই বসে রইলেন। আমরা বীরের জাতি। দুইজন নিজেদের হাতির মত শরীর নিয়ে উঠে পড়লাম হাতিতে। উফ, হাতির শরীরে কারও হাত পড়েছে কখনও? সেই কি বাজে অনুভূতি। যদিও পিঠে বসার জায়গাটি মোটা কাপড়ে মোড়ানো। হাতিতে ঘুরতে ঘুরতে এই মজা, এই ভয়! যখন পাহাড়ের ঢালে নামে মনে হয় পড়েই গেলাম, আবার উঠে আবার ভয়। ঘোরা শেষে আবার হাতিকে খাবার দিতে হয়। সেই খাবারের দাম ১০০ রুপি। খাবার না দিলে হাতি বাবা আপনাকে নামতে দিবেনা। এটা যদিও ট্রেইন করা। তবুও বেচারা হাতি এতক্ষণ আমাদের নিয়ে কষ্ট করল খাবার দেয়াটা উচিতই বটে। তবে এই কস্টিং আগে বলা হয় না। হিডেন কষ্ট ইস এভরিহোয়্যার। হাতি মেরা সাথী কে ছেড়ে এরপর ড্যাম দেখা, ইকো পয়েন্ট দেখা চলল। আর এবার সেই বিখ্যাত ডাব খাবার পালা। কেরালার ডাব ভালো। পানি অটো ঠাণ্ডা বরফ। এখানেও ভুট্টা, আম, শসা সহ বিভিন্ন তাজা স্ট্রীট ফুড আছে। আমার স্যার সেই আম একাই খেয়ে ফেলেন গপাগপ। বেলা ততক্ষণে অনেক গড়িয়েছে। আমাদের গন্তব্য মুন্নারের শেষে তামিলনাড়ু সীমান্ত। এ এক অপূর্ব স্থান। স্রস্টা এখানে অকৃপণ। সৃষ্টি এখানে উদার। দর্শক সব সম্মোহিত। আর কিভাবে বলে এর সৌন্দর্য প্রকাশ করব জানিনা। পাহাড়ের সবুজ চা বাগান আর আকাশের নীল রং। আসলে পাহাড়ের অনেক বান্ধবী। দিনে আকাশের হলুদ রৌদ্র, বিকেলে কালো মেঘ, রাতে ঝরঝর বৃষ্টি। আহারে কি সৃষ্টি!


ইকো পয়েন্ট নামে যে জায়গা ওটা আর তেমন কিছু মনে হয়নি। প্রায় তিনটা বাজে, খাবার সময় ও বটে। এদিকে আবার বৃষ্টিও চলে আসছে। তামিলনাড়ু থেকে আবার চলে আসার পালা মুন্নারের অভ্যন্তরে। তামিলনাড়ু অনেক বিশাল অঙ্গরাজ্য। কিন্তু তার একখানা হাতের অঙ্গুলির মত যে সামান্য রূপ দেখলাম তাতে মনে হল পুরো রাজ্য না জানি কত সুন্দর। বুঝলাম নেহুরু প্রকৃত জ্ঞানী ছিলেন বলেই ভারতবর্ষ হতে বেছে বেছে সমৃদ্ধশালী স্থান গুলোই নিজের করে নিয়েছেন। সব কিছুর মাঝে যেটা ভালো লাগছে নিরাপত্তা। এখানে সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। দিল্লি, আগ্রা, কলকাতা, বিহারের মত সুযোগ সন্ধানী, অসাধু মানুষের তৎপরতা নেই। ও সারাদিনের ট্যাক্সি খরচ ৪০০০ রুপীর মত। দুপুরে খাওয়ার জন্য দক্ষিনী ধাঁচের মাছ, মাংস খেলাম। ভালই বলা যায়। এবার খাওয়া শেষে টি মিউজিয়াম দেখার পালা। এই মিউজিয়ামে চা এর সাথে সম্পর্কিত পুরানো অনেক কিছু আছে, আছে চা তৈরির কৌশল সরাসরি দেখার সুযোগ আর তাজা চা পানের ব্যবস্থা। মিউজিয়ামের বাইরে বেশ কিছু জংলি ফুলের সমারোহ দেখলাম। কি অপূর্ব সাদা আর বেগুনি সব ফুল। আমাদের দেশে গ্রামের মাঝে এমন সব ফুল চোখে পড়ে। মুন্নারে চাইলে আরও একদিন থেকে বাকি স্থান দেখা যায়। কিন্তু আমাদের পরের দিনের গন্তব্য যে আলেপ্পি তাই সেদিনের মত সন্ধ্যা নামার আগেই হোটেলে ফিরে এলাম। এই হোটেল টা এত্ত সুন্দর যে আমি ভুলতেই পারিনা। বিকেলে চা নাস্তা হোটেলেই সারলাম। পাহাড়ের চা যে কেন এত অসাধারণ হয়। ঘরের চায়ে সেই মজাটা আসেইনা। সারাদিন এত ঘুরেও সেইভাবে ক্লান্ত ছিলাম না। হয়ত সুন্দর আবহাওয়ার জন্যই। ভাবছিলাম বাসায় থাকলে এখন কুরবানির মাংস নিয়ে কস্তাকস্তি করতে হত। আহা ছুটির দিন, আহা ভ্রমণ! ভালই কাটল ঈদের দিন।

কেরালার বাকি অংশ পরবর্তী লেখায়
আলোকচিত্র: লেখক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত