তপন কুমার দাস

০২ মার্চ, ২০২০ ১২:৫২

লাল শিমুলে জীবিকার মালা

মোটরসাইকেল চলছে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বিন্নাকুলি গ্রামের পাকা রাস্তা ধরে। সড়কের দুপাশে বিস্তীর্ণ মাঠে সবুজ ধানের চারা হাওয়ায় দুলছে। হাওর এলাকায় এটাই একমাত্র ফসল। কোথাও বা মৌসুমের সবজি ক্ষেত। কিষাণ-কিষাণি ব্যস্ত ক্ষেত পরিচর্যায়। মিনিট পনেরো পর দেখা মিলে অদূরের মেঘালয় পাহাড়ের। সকাল থেকে মেঘদল সূর্যকে ঢেকে রেখেছে। দূর থেকে কুয়াশা আচ্ছন্ন মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের ঘরগুলো আবছা আবছা দেখা যায়। বৃষ্টির দুএকটি ফোঁটা এসে পড়ছিল গায়ে। বইছিল মৃদুমন্দ বাতাস।

মিনিট দশেক পর পৌঁছলাম জাদুকাটা নদীর ঘাটে। নদীতে চলছে নতুন ব্রিজের নির্মাণ কাজ। এখানে-ওখানে চর জেগেছে। নদী পার হচ্ছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল মানিগাঁও গ্রামের শিমুল গাছ। টকটকে লাল শিমুল ফুল নিয়ে গাছগুলো যেন পর্যটকদের অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে! নদী পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম বাগান এলাকায়। টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম। বসন্তকাল। শিমুল বাগান লাল ফুলে ছেয়ে গেছে। শিমুলের এই রূপ দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমিয়েছেন পর্যটকরা। পর্যটকের উচ্ছাসে মুখরিত বাগান এলাকা।

আর তখনই কিছু দৃশ্যে চোখ আটকে যায়। বেশকিছু শিশু শিমুল ফুলের মালা গেঁথে পর্যটকদের কাছে ঘুরছে। ওদের শরীর পুরনো কাপড়। কিশোরী ও নারী পর্যটকরা তাদের কাছ থেকে মালা নিয়ে মাথায় বেঁধে ছবি তুলছেন। খুশি হয়ে কেউ ১০টাকা থেকে ১০০টাকা দিচ্ছেন। কেউ বা ৫০০ টাকাও দিচ্ছে। পর্যটনের নতুন ক্ষেত্র শিমুলবাগান এখন এলাকার অনেকেরই মৌসুমি জীবিকার উৎস হয়ে ওঠেছে।

এটা আগে ছিল না। শিমুল ফুল ফোটার মৌসুমে বাগানে পর্যটক আসা শুরু হলে এরা আসে, ফুল কুড়ায়। বিক্রি করে। এই মৌসুমে এলাকার অর্ধশতাধিক শিশু ছাড়াও বেশ কয়েকজন নারী অন্যসব কাজ ছেড়ে বাগানকেন্দ্রিক রোজগার করেন। এটা দিয়ে তারা তাদের পরিবারের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেন। শিমুলের মৌসুমে বাগানে গেলে এমন শিশুদের দেখা মিলবে অহরহ। যে সময়টা তাদের বইখাতা নিয়ে পাঠশালায় যাওয়ার কথা। সময় কাটানোরে কথা খেলাধুলায়। কিন্তু বাস্তবতা তাদের শৈশব উপভোগ করতে দেয়নি। ছিটকে ফেলেছে স্কুলের গণ্ডি থেকেও। সংসারের দায় মেটাতে তাদের এই বয়সে নামতে হয়েছে রোজগারের সন্ধানে।

কথা বলার জন্য এক শিশুর কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলাম। উত্তরে সে বলল, নাম দিয়ে কি হবে মালা নেন। অনেক চেষ্টার পর নাম বলল শফিক। বয়স বড়জোর নয় কিংবা দশ হবে। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। স্কুল খোলা। কিন্তু সে স্কুলে যায় না। স্কুলে যেতে মন চায়। সে সুযোগও তার নেই। তার মতো বাকি শিশুদের কাহীনিও এক। সে জানায়, পরিবারে সহযোগিতার জন্য নামতে হয়েছে জীবিকার সন্ধানে।

অপরদিকে বাগানে আসা পর্যটকদের ছবি তুলে, ঘোড়ার উপর বসিয়ে অনেকেই রোজগার করেন। বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে দোলনা। বসার জন্য আলাদা বেঞ্চ ও চেয়ারের ব্যবস্থা করেছে বাগান কর্তৃপক্ষ।