ম্যাক সুমন

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ০২:৪৫

নীল জলরাশির টাঙ্গুয়া!

ফারুখ ভাই দাম হাঁকলেন, "৫০ টাকায় দিবি?" ছেলেটা 'না' বলতেই আমি ৬০ টাকা দিয়ে পানকৌঁড়ির বাচ্চাটা কিনে নিলাম। আমাদের সকল সহযাত্রীর উদ্দেশ্য অভিন্ন; টাঙ্গুয়া যাওয়ার পথে কোথাও পাখিটাকে অবমুক্ত করব। পাখিটি তার আপনজনদের সাথে প্রকৃতিতে মিশে যাবে।

সুনামগঞ্জ শহর থেকে আমরা আগের রাতেই তাহিরপুর উপজেলায় চলে এসেছিলাম। সুনামগঞ্জ জেলার বেশিরভাগ স্থানে সবচেয়ে সহজলভ্য ও রাস্তার উপযোগি যান হলো মোটর সাইকেল। আমরাও মোটরসাইকেল করে তাহিরপুর এসে পৌঁছলাম রাত প্রায় ৮ টায়। উপজেলা পরিষদ বাংলোয় আমাদের জায়গা হলো। ঘুমাতে যাওয়ার আগেই সকালের জন্য আমরা নৌকা ঠিক করে নিলাম।

আমরা ছিলাম ৬ জন; ফারুখ ভাই, ফারাবী হাফিজ, বাতিন ভাই, ন. নাজিম, রাজিব রাসেল ও আমি। মোটামুটি ভালো মানের একটা নৌকা পেলাম ১৫০০ টাকায়, যেটা আমাদের টাঙ্গুয়া হাওড়ের উপর দিয়ে ট্যাকেরঘাট সীমান্তে পোঁছে দেবে।

সকাল প্রায় সাড়ে নয়টা। আমাদের যাত্রা শুরু। সকালের নাস্তা ও কয়েকটা হাতে তৈরী মাথাল নৌকায় নিয়ে নিলাম। প্রচন্ড রোদে মাথালগুলো বেশ স্বস্তিদায়ক। তাহিরপুর নৌকাঘাট থেকে প্রায় ৪৫ মিনিট চলার পর আমরা শনির হাওড় ও মাটিয়ানহাওড়ের মাঝখান দিয়ে টাঙ্গুয়ার উদ্দেশ্যে চলছি। একটি ছোট গ্রামের দেখা পেলাম, নাম নিশ্চিন্তপুর। আর শূন্যতার শেষ সীমানায় কয়েক সারি পাহাড় দেখা যচ্ছে, মেঘ উড়ছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে। নিশ্চিন্তপুর গ্রামের রাস্তায় হাঁটুজলেরও বেশি, তারপরও মনে হলো গ্রামবাসী সুখে শান্তিতে-নিশ্চিন্তেই আছে। আমরা থামলাম, নামলাম; পাখিটাকে অবমুক্ত করতে হবে।

দু-তিনটা হাওড় পেরিয়ে আমরা টাঙ্গুয়ার হাওড়ে এসে ঢুকে পড়েছি। নীল জলরাশি, বাতাস আর নৌকার শব্দ। পানি এতই স্বচ্ছ যে, কয়েক ফুট গভীরে নীচের ঘাস পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। হাওড়ের মধ্যে কদাচ বড় বড় গাছের শাখা-প্রশাখা দন্ডায়মান। হাওড়ের যৌবনের কাছে তারা পরাজিত। তবু, সোয়াম্প ফরেস্টের মত হাওড়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে চলছে অবিরত। গান হলো, গল্প হলো, যার যার মত করে প্রকৃতির ফটোসেশন হলো। চলার প্রায় ৩ ঘণ্টা পর আমরা একটা ওয়াচ টাওয়ারের সাক্ষাত পেলাম; প্রায় এক চতুর্থাংশ পানিতে নিমজ্জিত। আশেপাশে হিজলবন। সিদ্ধান্ত নিলাম, গোসল করব সবাই। এই পানিতে গোসল না দিলে ট্যুরটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ১০/১৫ বছর বয়সী দুরন্ত ছেলেদের মত পানিতে লাফালাফি করলাম আমি, ফারাবী আর নাজিম। রাজিব রাসেলও বাদ গেল না।

ফারুখ ভাই ক্যামেরায় ক্লিক করে চলছেন। কখনও আমাদের দুরন্তপনা, কখনও কোন মাঝির ডিঙ্গি নৌকা বা দূরের পাহাড়ের উপর আমাদের প্রতিবেশি ভারতের কোন শহর, কখনও বা আবার বাতিন ভাইয়ের উদাস দৃষ্টি।

ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে দেখা সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। কোথায় কোন লোকালয় নেই, নেই কোন মানুষের সাড়া-শব্দ বা যান্ত্রিকতা। শুধুই সৌন্দর্য আর নিস্তব্দতা। নীল রঙের পানিতে বিশাল আকাশের প্রতিচ্ছবি; মেঘ উড়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট মাছগুলোর প্রাণচঞ্চল চলাচল। শুধু প্রকৃতি আর প্রকৃতি।

আরও দু-ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে হবে নৌকা করে। আমরা রওয়ানা দিলাম। নৌকা এগিয়ে চলছে, আগে থেকে খানিকটা সন্তর্পনে। পানি কম আছে কিছু কিছু জায়গায়, তাই মাঝিরা একটু সতর্কতা অবলম্বন করে। খানিক এগুতেই আবছা দেখা মিললো ট্যাকেরঘাট সীমান্তের। দূর থেকে মনে হলো কোন গ্রামের বাজার। আসলে এই সীমান্ত দিয়ে কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি হয়।

আমরা যখন ট্যাকেরঘাট সীমান্তে পৌঁছলাম, তখন প্রায় ভরদুপুর। নৌকা থেকে নেমে সামনে এগুতেই দেখা মিললো অনেক বছরের পুরানো, পরিত্যাক্ত রেল লাইন ও ইঞ্জি্নের। সম্ভবত কয়লা বা চুনাপাথর পরিবহনের জন্য কোন এক কালে এগুলো ব্যবহৃত হত। আরও সামনের দিকে এগুতে একটা শহীদ মিনারের দেখা পেলাম। সম্ভবত বাংলাদেশের দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনারগুলোর মধ্যে একটি হলো ট্যাকেরঘাট শহীদ মিনার।

শহীদ মিনারের সামনে থেকে আবারও মোটরসাইকেলযোগে রওয়ানা হলাম, একটু পেছনের দিকে, লাকমাছড়ায়। জায়গাটা দেখতে অনেকটা বিছনাকান্দির মত, আয়তনে কিছুটা ছোট। পাথুরে নদী; বালুর চর আর দূর থেকে ভেসে আসা স্বচ্ছ পানি মন কেড়ে নেয়। অদূরে ভারত সীমান্ত ঘেঁষে ঝুলে আছে কালো রঙের একটা সেতু। হালকা যান চলাচলের উপযোগী সেতুটি লাকমাছড়ার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।

সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী লাকমা ছড়া, গারো ছড়া, করইগড়া ছড়া, বড় ছড়াসহ প্রায় ৩০/৩৫ টি ছড়া দিয়ে যে পানি আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে, সেই পানি প্রধানত টাংগুয়ার হাওড়, শনির হাওড় ও মাটিয়ান হাওড়ে মিশে। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের পানি মূলত একারণেই স্বচ্ছ।

সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকায় আমরা ফিরতি পথে রওয়ানা দিলাম। লাকমাছড়া থেকে আবারও ট্যাকেরঘাট হয়ে সামনে এগুতেই দেখা পেলাম লাইমস্টোন লেক'র। ছোট একটা লেক, নীলাভ পানি। দক্ষিণপাশে রাস্তা, সবুজে ঘেরা। উত্তর ও পূর্ব পাশে পাহাড় ও টিলা। উত্তর পাশে চুনাপাথরের পাহাড়। লাইমস্টোন উত্তোলন করতে গিয়ে কৃত্রিমভাবে এই লেকটা তৈরী হয়েছিল বলে এটার নাম লাইমস্টোন লেক। পূবপাশের টিলা দেখে যে কারও মনে হবে, পরিকল্পনামাফিক কেউ এই টিলাগুলোতে গল্‌ফ কোর্স করে রেখেছে। যেন সবুজ ঘাসের বিছানা পাতানো। এই টিলাগুলোতে বসে বিকেল কাটানো বা সূর্যাস্ত দেখাটা অসাধারণ। চুনাপাথরের পাহাড়টি ঘেঁষে লেকের পশ্চিমপাড়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রয়েছে; কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল। ১৯৭১ সালে ট্যাকেরঘাট ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাব-কোয়ার্টার। আশ-পাশে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে সামাহিত করা হয়েছিল।

আমাদের মোটরসাইকেল এগিয়ে চলছে, সীমান্তঘেঁষা সবুজ পাহাড়ের পাশ দিয়ে। পরবর্তী গন্তব্য লাউড়ের গড়, বারিকটিলা আর জাদুকাটা নদী। আরও দু-চারটা সৌন্দর্যের স্বর্গ রয়েছে এই পথে! সেটা আরেকদিন জানাবো।

প্রয়োজনীয় তথ্য :
শ্যামলী, এনা বা হানিফ পরিবহনে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ সরাসরি বাস আছে।

সুনামগঞ্জ শহরের বৈঠাখালি, মনিপুরী কিংবা হাসন রাজার ঘাট থেকে নৌকা বা স্পীডবোট করে সরাসরি টাঙ্গুয়ার হাওড় যাওয়া যায়।

অথবা, সুনামগঞ্জের বৈঠাখালি বাজার থেকে মোটরসাইকেল বা লেগুনা করে তাহিরপুর বাজারে গিয়ে, সেখান থেকে নৌকায় টাংগুয়ার হাওড় ও ট্যাকেরঘাট যাওয়া যাবে। নৌকা ভাড়া প্রায় ১৫০০ টাকা।

ট্যাকেরঘাট থেকে মোটরবাইকে করে বিশ্বম্ভরপুর হয়ে সুনামগঞ্জ সদরে ফেরা যায়। এই পথে লাইমস্টোন লেক, লাউড়ের গড়, বারিকটিলা আর জাদুকাটা নদী দেখা যাবে। তাই ফেরার জন্য এটাই আদর্শ রুট।

নৌকাভ্রমণটা যত সকাল শুরু করতে পারেন, ততো সুবিধা।

ব্যাকপ্যাক যথাসম্ভব ছোট রাখবেন। সম্ভব হলে দুইজনে ১ টা করে ব্যাগ নেবেন। এতে মোটরসাইকেলে বসতে অসুবিধা হবে না।

সবকিছুর দাম অবশ্যই আগে ফিক্স করে নিবেন।

যা সাথে রাখবেন :
সঙ্গে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও পানি নিবেন। কারন হাওড়ে পানির উপরেই দিনের অধিকাংশ সময় থাকতে হবে।

পিউরিফায়ার নিলে হাওড়ের পানির স্বাদ গ্রহণ করা যাবে।

ছাতা, লাইফ জ্যাকেট, গোসলের কাপড়-চোপড় সাথে নেবেন।

ছবি : ফারুখ আহমেদ ও ম্যাক সুমন

আপনার মন্তব্য

আলোচিত