ডয়চে ভেলে

০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৩:০৬

‘আমাদের আইনে বিচার’ বলে পুলিশের কাছে ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দু কিশোরকে গণপিটুনি

খুলনায় এক কিশোরের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ ওঠে৷ খুলনা মেট্রোপিলটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের দপ্তরে নেয়া হলে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর উপস্থিতিতেই গণপিটুনি দেয়া হয় তাকে৷

পুলিশকে উদ্ধৃত করে মৃত্যুর খবর কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও পরে জানানো হয়, উৎসব মণ্ডল নামের ১৬ বছর বয়সি কিশোর মারা যায়নি, সে এখন চিকিৎসাধীন৷

বুধবার রাতে গণপিটুনির পর পুলিশও কিশোরটিকে মৃত ঘোষণা করেছিল। মৃত ঘোষণার পর উন্মত্ত জনতা পুলিশের কার্যালয় ছেড়ে চলে যায়।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মো. তাজুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তখন আমরা তাকে মৃত ভেবেছিলাম। কিন্তু সে মারা যায়নি। সে এখন সেনা হেফাজতে চিকিৎসাধীন আছে।”

বাবা-মাসহ ওই কিশোরের পরিবারের সদস্যদেরও নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, "গণপিটুনির ব্যাপারে মামলা হবে। আর মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগেও মামলা হবে। কিন্তু ওই অভিযোগে কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়ে তাকে গণপিটুনি দিলেও এখন মামলা করতে কেউ আসছে না। কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার মহানবী (সা.)-কে নিয়ে ওই কিশোর ফেসবুকে কটূক্তি করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। পরের দিন দুপুরে ওই কিশোর নগরের টুটপাড়া এলাকায় কোচিং সেন্টারে গেলে তার বন্ধুরা তাকে আটকায়। কেন সে কটূক্তি করেছে তা জানতে চায়। খবর পেয়ে ওই কিশোরের বাবা কোচিং সেন্টারে যান। তিনি ছেলে ও অন্যদের নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে তাদের পুলিশের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।

বিকেলের দিকে ওই কিশোর, কিশোরের বাবা ও কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রথমে সোনাডাঙা থানায় যান। সেখানে লোকজন ভিড় করলে উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ)-এর কার্যালয়ে ওই কিশোরকে নিয়ে যাওয়া হয়। উন্নত্ত জনতা ওই কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও সেখানে যান। তারা আইনের মাধ্যমে অভিযুক্তের বিচারের আশ্বাস দেন। কিন্তু উত্তেজিত জনতা তা শোনেনি। রাত ১১টার দিকে বিক্ষোভকারীরা উপ-পুলিশ কমিশানেরর অফিসের গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে ওই কিশোরকে পিটুনি দেয়। এক পর্যায়ে সে মারা গেছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

রাত সাড়ে ১২টার দিকে ওই কিশোরের দেহ পলিথিনে মুড়িয়ে সেনাবাহিনীর গাড়িতে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পুলিশ কার্যালয়ের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনো উত্তেজিত জনতা সেনাবাহিনীর গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করে।

উপ-পুলিশ কমিশনার মো. তাজুল ইসলাম বলেন, "উত্তেজিত জনতার সঙ্গে মাদ্রাসার কয়েক হাজার ছাত্র যোগ দিলে আমরা আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আমরা প্রচলিত আইনে বিচারের আশ্বাস দিলেও তারা ‘আস্থা নাই' বলে ওই কিশোরকে তাদের হাতে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানায়। তারা দাবি করে, পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও তাদের হাতে (ছেলেটিকে) ছেড়ে দিতে হবে, দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হবে না, ‘ওদের আইনে' ওরা বিচার করবে। ওই সময় আমাদের পুলিশ সদস্যদের অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়ে। তারা তখন তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দেয়।”

খুলনার সাংবাদিক হেদায়েত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ওই কিশোর সবার সামনে ক্ষমাও চেয়েছিল। কিন্তু উত্তেজিত লোকজন প্রথমে তার মাথা মুড়িয়ে গলায় জুতার মাালা পরিয়ে শহরে হাঁটানোর দাবি জানায়। এরপর তারা নিজেরাই বিচারের ঘোষণা দেয় এবং গণপিটুণি শুরু করে।”

হেদায়েত হোসেন আরো বলেন, "পুলিশ এখানে আসলে সময়ক্ষেপণ করেছে। তারা কোনো অ্যাকশনে যায়নি। সেনাবাহিনী ও নৌ বাহিনীর সদস্যরা যখন আসে, তখন সেখানে কয়েক হাজার লোক। তখন পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে ছিল না। পুলিশের হাত থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের সামনেই গণপিটুনি দেয়।”

গণপিটুনিতে কিশোরটির কী অবস্থা হয়েছিল তা ফুটে ওঠে সাংবাদিক হেদায়েত হোসেনের এই কথায়, "মরে গেছে ভেবে তার দেহ পলিথিনে ঢেকে বের করা হয়। মসজিদের মাইক থেকেও বলা হয় সে মারা গেছে। বৃহস্পতিবার সকালে আমাদের জানানো হয় যে, বেঁচে আছে।”

তিনি বলেন, "প্রথমে ওই কিশোরকে থানায় নেয়া হয়। সেখানে মানুষের চাপ বাড়লে পাশেই ডেপুটি পুলিশ কমিশনার অফিসে নেয়া হয়। সময়ক্ষেপণ করায় খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকাজন বাড়ে। তাদের অধিকাংশই ছিল মাদ্রাসার ছাত্র।”

খুলনা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত কুমার ডয়চে ভেলেকে বলেন, " ধর্ম অবমাননা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেটা যে ধর্মই হোক না কেন। সেটা প্রমাণ হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু আমাদের এখানে যা ঘটলো তা তো আর মেনে নেয়া যায় না। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া হয়েছে। যে কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তো প্রমাণ হয়নি। তার আগেই তার বিচার হাতে তুলে নেয়া হলো।”

তার কথা, " আর পুলিশের সামনেই যখন তাকে পিটানো হলো, তাহলে তো পুলিশও নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এই অবস্থা হলে নানা ইস্যু তুলে তো যে কেউ যে কাউকে মেরে ফেলবে। দেশে তো আর আইনের শাসন থাকবে না।”

তিনি বলেন, "অতীতেও আমরা দেখেছি এইভাবে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ম অবমাননার কথা তুলে আক্রমণ হয়েছে, যার অনেকগুলো ছিল ষড়যন্ত্র। ওই কিশোর আসলেই ধর্ম অবমাননা করেছে, না তাকে ফাঁসানো হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।”

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, "আমাদের এখানে সমস্যা হয়েছে যে, এখানে আন্দোলনের পর আমরা সবাই নিজেদের এমনভাবে স্বাধীন ভাবছি যে, এখানে কোনো নিয়ম নীতি আইন কোনোভাবেই মানার চেষ্টা করা হচ্ছে না। অতীতের বিচারহীনতার কারণে অনেকেই পুলিশ প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তারা মনে করছেন, তারা নিজেরাই বিচার করবেন। এটা অশনি সংকেত।”

তার কথা, "এই ফেসবুককেন্দ্রিক অপপ্রচারের মাধ্যমে অতীতে আমরা অনেককে ঘায়েল করতে দেখেছি। সুতরাং তদন্ত ছাড়া কাউকে দায়ী করা যাবে না, অপরাধী বলা যাবে না। আর তার বিচার করবে আইন-আদালত। এভাবে পুলিশের সামনে গণপিটুনি দিয়ে প্রায় মেরে ফেলা প্রমাণ করে- পুলিশ এখনো সক্ষম হয়ে ওঠেনি। তারা এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি। আর সব ঘটনায় যদি সেনাবাহিনীকে যেতে হয়, তাহলে তো কঠিন।”

"এই ঘটনায় গণপিটুনি যারা দিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে, তা না হলে এই ধরনের ঘটনা আরো বাড়বে। অনেকেই সুযোগ নেবে। আর ওই কিশোর আসলেই ধর্ম অবমাননা করেছে, না তাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে তার সঠিক তদন্ত হতে হবে।”

বৃহস্পতিবার গণপিটুনিতে আহত উৎসব মণ্ডলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। পুলিশ জানায়, তারা নিরাপত্তার কারণে গোপন স্থানে অবস্থান করছেন।

আইএসপিআর জানিয়েছে, ওই কিশোরের অবস্থা উন্নতির দিকে। তাদের তত্তাবধানে তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তার নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে আর কোনো তথ্য দেয়নি আইএসপিআর।

উপ পুলিশ কমিশনার মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, "আমরা এখনো নিশ্চিত নই যে, ওই কিশোর ধর্ম অবমাননা করেছে কিনা, কারণ, এখনো মামলা হয়নি। আমরা তদন্ত শুরু করিনি। তদন্ত শেষে এ ব্যাপারে বলা যাবে।”

আপনার মন্তব্য

আলোচিত