হাসান মোরশেদ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ২১:৪০

আহমদ শফি, কওমি মাদ্রাসা ও বিশ্বাস ভঙ্গ

জামায়াতে ইসলামী একটা সুবিধাবাদী, ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল। নিজেদের ইসলামিক দল বলে দাবি করলেও গণমুসলমানদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা কখনোই তেমন গড়ে উঠেনি। জামায়াতে ইসলামীর নেগোসিয়েশন পাওয়ার হচ্ছে তার ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন এবং ইসলামিক ব্রাদারহুড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক যোগাযোগ।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার সহযোগী ভূমিকা, জনমানসে তাদের গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে শেষ পেরেক। ফলে নানা সমীকরণে ক্ষমতার প্রায় কাছাকাছি দীর্ঘদিন থাকলেও আওয়ামী লীগ যখন তাদের শীর্ষ নেতৃত্বকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছে, বিএনপিকে সাথে নিয়ে কিছু নাশকতার বাইরে কোন গণপ্রতিরোধ তারা গড়তে পারেনি।

কিন্তু কওমি মাদ্রাসার গল্প আসলে অন্যরকম। এদের গণভিত্তি অনেক শক্ত। প্রচলিত রাজনীতিতে তারা তেমন আগ্রহ দেখায়নি আগে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের সাংগঠনিক স্পষ্ট অবস্থান ছিলোনা জামায়াতের মতো- রাজাকার ছিলো, নিরপেক্ষ ছিলো, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও ছিলো। সাধারণ মানুষের কাছে এদের একটা ইমেজ গড়ে উঠেছিলো- ক্ষমতামুখী রাজনীতিতে তাদের আগ্রহ নেই বরং ধর্মীয় অনুশাসনে তাদের মনোযোগ, এরা দরিদ্রশ্রেণির হলেও পয়সা দিয়ে কেনা যায়না, এদের আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও আনুগত্য প্রশ্নহীন।

বিজ্ঞাপন



১৯৯০ এর পরের রাজনীতিতে মাঝেমধ্যে কওমি শক্তি উঁকি দিলেও মুলতঃ তাদের বিষয়ে গড়ে উঠা জনধারণা গুঁড়িয়ে যায়, বিশাল কওমি নেটওয়ার্কের প্রধান আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১৩ থেকে ২০২০ সময়ের মধ্যে।

কীভাবে?
১. যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা ২০১৩ এর গণআন্দোলন কোনভাবেই ইসলামের বিরুদ্ধে ছিলো না। কওমি নেটওয়ার্কের এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কিছু ছিলো না, এই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ছিলো বিএনপি-জামায়াত, ঐতিহাসিক ভাবে কওমি নেটওয়ার্ক বিএনপিবিরোধী না হলেও জামায়াত বিরোধী ছিলো। কিন্তু বিএনপি- জামায়াতের বহুমুখী কৌশলের অংশ হিসাবে আচমকাই কওমি নেটওয়ার্ক তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে বিচার বিরোধিতায় নামে এবং বিএনপি জামায়াতের এজেন্ডা হিসাবেই সরকার পতনের ডাক দেয়। বিএনপি জামায়াতের চেয়ে তখনো তাদের গণভিত্তি এবং নিবেদিত কর্মী অনেক বেশি। আহমদ শফি কোন প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে কওমি নেটওয়ার্ককে বিএনপি জামায়াতের হয়ে কাজে লাগিয়েছিলেন সেটা নিশ্চয় প্রকাশিত হবে কোনদিন। ৫ মে ২০১৩ রাজধানী ঢাকা ঘেরাও এবং দখলের চেষ্টা করার মতো দুঃসাহসও দেখান তারা।

আওয়ামী লীগ সরকার অলআউট একশনে যায়, পরাজিত হয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়। আহমদ শফির হাত ধরে কওমি নেটওয়ার্কের প্রথম প্রকাশ্য পরাজয়।

২. ৫ মে পরাজিত করার পর আহমদ শফিকে নিয়ে শেখ হাসিনা অন্য গেমপ্ল্যান করেন। ’গোঁড়া, ধর্মান্ধ হলেও এরা সৎ, জামায়াতের মতো সুবিধাবাদী না’- এই ইমেজ গুঁড়িয়ে যায় কথিত ৩০ কোটি টাকা ও রেলের জমির কল্যাণে। নানা মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর, কেউ প্রতিবাদ জানায়নি। ৫ মের আগে বিএনপি জামায়াতের কাছে, ৫ মের পরে আওয়ামী লীগের কাছে বিক্রি হয় এই শক্তি।

এ নিয়ে দেশের প্রগতিশীল অংশের ক্ষোভ আছে শেখ হাসিনার উপর, অনেকে তার উপর আস্থা হারিয়েছেন, অনেকে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা একজন রাজনীতিবিদ। রাজনীতিবিদরা সবসময় সোজা ব্যাটে খেলেন না।

এদেরকে কেনা যায় না- এই বিশ্বাস ভঙ্গটুকু আহমদ শফির হাত ধরে দ্বিতীয় পরাজয়।

৩. এদের আনুগত্য ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রশ্নাতীত, এই মিথ ও মিথ্যা প্রমাণিত হলো। স্বয়ং আহমদ শফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হলো, কার্যত কওমি নেটওয়ার্কের বিশাল সাম্রাজ্য থেকে তিনি বিতাড়িত হলেন। এটা ঘটলো শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন থাকতেই যে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার জন্য বিএনপি জামায়াতের হয়ে তিনি ঢাকা দখল করতে গিয়েছিলেন।

ব্যক্তি আহমদ শফির পরাজয় নয় কেবল, এই পরাজয় বহুদিনে গড়ে উঠা বিশ্বাস ও ভরসার। গত সাত বছরে তার হাত ধরে প্রমাণিত হয়েছে- অন্য সবার মতো এদেরকেও কেনা যায়, এদের ভেতরে ও উপদল তৈরি করে পালাবদল ঘটানো যায়। আহমদ শফিকে ক্ষমতাহীন করে নতুন যারা দৃশ্যে তারা আপাত: আপোষহীন হলেও বিক্রি হবেন। হয়তো আরও কম মূল্যে।

কেনাবেচার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা সবার জন্যই স্বস্তির মনে হয়।

হাসান মোরশেদ : লেখক, গবেষক।

[হেফাজতের আমির আহমদ শফি শুক্রবার সন্ধ্যায় মারা গেছেন। এরআগে বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার‌ আল-জামিয়াতুল তাহলিমা দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার (যা হাটহাজা‌রী মাদ্রাসা না‌মে প‌রি‌চিত) মহাপ‌রিচাল‌কের পদ থে‌কে পদত্যাগ করেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আহমদ শফির পদ ছাড়ার পর শুক্রবার সকালে ফেসবুকে এ লেখাটি পোস্ট করেন হাসান মোরশেদ। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় প্রকাশ করা হলো]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত