নিজস্ব প্রতিবেদক

২২ আগস্ট, ২০১৬ ০১:৪৭

উগ্রপন্থিদের পেজ ও সাইটে রাগীব আলীর পক্ষ নিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি

জালিয়াতির মাধ্যমে দেবোত্তর সম্পত্তি আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ভারতে পালিয়ে যাওয়া শিল্পপতি ও কথিত দানবীর রাগীব আলীর পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারণায় নেমেছে জঙ্গিবাদের উস্কানি দেয় এমন কিছু  পেজ ও  ওয়েবসাইট। এসব ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

গত ২৩ জুলাই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন বলেছিলেন, "কিছু ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। যেসব ওয়েবসাইট এসব অপপ্রচার চালিয়ে তরুণ কোমলমতি কিশোরদের বিভ্রান্ত করছে, সেগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।" এসব পেজের মধ্যে "নয়ন চ্যাটার্জি" নামের পেজটিও ছিল। রিপোর্টের ভিত্তিতে এটি একাধিকবার বন্ধ হলেও ফেসবুকের ওপেন পলিসির সুযোগে বারবার এটি নতুনভাবে চালু হয়ে উস্কানি ছড়াচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায় জঙ্গিবাদে উস্কানিদাতা ফেসবুক পেজ "নয়ন চ্যাটার্জি-২" থেকে পলাতক রাগীব আলীর পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এবং এ পেজের অধিকাংশ পোস্টগুলোই স্পন্সরড, অর্থাৎ টাকা দিয়ে ফেসবুকে প্রচার করা। এছাড়াও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা (জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম এদের অনুসারি) পরিচালিত "দাওয়াহ ইল্লাল্লাহ" নামক ওয়েবসাইট থেকে রাগীব আলীর পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

নয়ন চ্যাটার্জি-২ ফেসবুক পেজে ১৯ আগস্ট লিখা হয়, "এখন শোনা যাচ্ছে- রাগীব আলী মেডিকেল কলেজটি নাকি পঙ্কজ গুপ্তকে দিয়ে দেওয়া হবে, যার নাম পরিবর্তন করে ‘বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত মেডিকেল কলেজ’ করা হবে। আগে মেডিকেল কলেজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় করতো রাগীব আলী আর এখন সেই অর্থ ভারতীয় ব্যাংকে জমা করবে পঙ্কজ কুমার গুপ্ত।

ওখানে আরও লিখা হয়, "আসলে আমি আগেই বলেছিলাম- সিলেটে আবার গৌড় গোবিন্দের শাসন চালু হয়েছে। অবশ্য এর জন্য আর কেউ দায়ী নয়, খোদ সিলেটবাসী দায়ী। কারণ ‘কুকুরের পেটে যেমন ঘি হজম হয় না’, ঠিক তেমনি হিংসুটে সিলেটিদের ভালো জিনিস সহ্য হয় না। মুসলমানের শাসন থেকে হিন্দুর শাসনই তাদের বেশি পছন্দ।"

একই তারিখে একই পেজ থেকে আরও লিখা হয়, "শুনেছি একজন সিলেটি মন্ত্রী নাকি আড়াল থেকে রাগিব আলী বিরোধী প্রচারণায় আছেন। কেউ যদি ভেবে থাকে- দূর রাগীব আলী তো রাজনীতি করে না। ফালতু ফালতু জনকল্যাণে টাকা ব্যয় করে কি লাভ? তাকে সরিয়ে দিয়ে টাকাগুলো লুটে নিলে কেমন হয়? ডেসটিনি, শেয়ার বাজার, হলমার্ক, রিজার্ভ গায়েবের পরবর্তী প্রজেক্ট যদি শিল্পপতি রাগীব আলীর সম্পত্তি হয়ে থাকে তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।"

ভারতে পালিয়ে যাওয়া রাগীব আলীর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে নয়ন চ্যাটার্জি-২ পেজে ১৮ আগস্ট তারিখে লিখা হয়, "১৯৭১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ছেড়েছে প্রায় ৫৫ লক্ষ হিন্দু। এই হিন্দুদের সকলেই ভারতে আশ্রয় নেয়। আচ্ছা এ সকল হিন্দুদের তো অনেক জমি-জমা ছিলো। এই জমিগুলো কি তারা ফ্রি ফ্রি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে? আপনার কি মনে হয়?? এই জমিগুলো কিন্তু তারা ফ্রি ফ্রি ছেড়ে দেয়নি। তারা স্থানীয় মুসলমানদের কাছে বিক্রি করে করে গিয়েছিলো। সে সময় যে মুসলমানরা হিন্দুদের প্রতি দয়া দেখিয়ে সেই সব জমি ক্রয় করেছিলো তারা কিন্তু ভুল করেছে।"

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভারতে পালিয়ে যাওয়া রাগীব আলীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিতর্কিত এসব পেজ সরাসরি ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে চলেছে। "ফের গৌড়গোবিন্দের কবলে সিলেট" এমন উস্কানি দিয়ে জেএমবির সাইট থেকে বলা হচ্ছে "সিলেট এর চা বাগান কে ইস্যু করে সিলেটের মুসলিমদের কে উচ্ছেদের পরিকল্পনা ভারতের"। এসব পোস্টে সরাসরি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।  

"দাওয়াহ ইল্লাল্লাহ" নামক এক ওয়েবসাইট থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতি সম্পন্ন মানুষদের উস্কে দেওয়ার লক্ষে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচারণা চালিয়ে সরকারকে নব্য গৌড়গোবিন্দ আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদের আহ্বান জানানো হচ্ছে। এই ওয়েবসাইটটি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখার দ্বারা পরিচালিত বলে ধারণা করা হয়। দাওয়াহ ইল্লাল্লাহ নামের ডোমেইন বন্ধ করে দেওয়া হলেও একই নামের "ডটইন" ডোমেইন নিয়ে আবারও কার্যক্রম শুরু করেছে উগ্রবাদের চর্চাকারী এ ওয়েবসাইটটি। এবং সেখানে নয়ন চ্যাটার্জি ফেসবুক পেজের অনুরূপ রাগীব আলীর পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়েছে।

এদিকে, উগ্রবাদী ফেসবুক পেজ নয়ন চ্যাটার্জি থেকে একইভাবে রাগীব আলীর পক্ষে প্রচার চালাতে গিয়ে ধর্মীয় উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা সম্পর্কেও অপপ্রচার চালাচ্ছে। একই সঙ্গে হাইকোর্টে দেওয়া রায় সম্পর্কেও বিরূপ মন্তব্য করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, সিলেটের তারাপুর চা বাগানের দেবোত্তর সম্পত্তিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার ভূমি আত্মসাতের আলোচিত দুটি মামলায় গত ১০ আগস্ট রাগীব আলীসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এরপরই কোনো এক সময়ে রাগীব আলী সপরিবারে ভারত পালিয়ে যান। রাগীব আলীর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে সিলেটের পুলিশ প্রশাসন।

৪২২ দশমিক ৯৬ একর জায়গায় গড়ে ওঠা তারাপুর চা-বাগান পুরোটাই দেবোত্তর সম্পত্তি। ১৯৯০ সালে ভুয়া সেবায়েত সাজিয়ে বাগানটির দখল নেন রাগীব আলী। গত ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্টের আপিল বিভাগের এক বেঞ্চ তারাপুর চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। রায় বাস্তবায়ন করতে সিলেটের জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

গত ১৫ মে চা বাগানের বিভিন্ন স্থাপনা ছাড়া ৩২৩ একর ভূমি সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয় সিলেট জেলা প্রশাসন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত