সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

২৯ আগস্ট, ২০১৬ ০২:১৮

‘শহীদ কাদরী বাড়ি নেই’

“না, না, তার কথা আর নয়, সেই বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো- শহীদ কাদরী বাড়ি নেই”! হ্যাঁ, শহীদ কাদরী আজ থেকে এ বাড়ি নেই, তিনি চলে গেছেন অন্য এক বাড়িতে।

বাংলা কবিতার বিরলপ্রজ এক কবিতা, মাত্র ৪ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে কাব্যভুবনকে মাত করে দেওয়া কবি শহীদ কাদরী রোববার (২৮ আগস্ট) চলে গেছেন। থেমে গেছে তাঁর কলম, আর কখনও সে কলম থেকে বারুদ কিংবা গোলাপের পাপড়ি বের হবে না। আর কখনও তিনি লিখতে পারবেন না এমন কোনো লাইন- “জলের ওপর আমার কৈশোর, আমার যৌবন/ কচুরিপানার মতো ভেসে/ বেড়াচ্ছে কী দারুণ সবুজ!”

কবি শহীদ কাদরীর মৃত্যু সংবাদে বাংলাদেশের সচেতন সমাজ থমকে গেছে। এর রেশ পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। ফেসবুকে অনেকেই নিজেদের হাহাকার প্রকাশ করেছেন কবি ও তাঁর অমর সৃষ্টি কবিতাকে উদ্ধৃত করে, কেউ কেউ আবার কবিকে উদ্দেশ করে লিখেছেন কবিতাও।

কবি মাহবুব লীলেন লিখেন,

কত বিদঘুটে জিনিসই তো আমাদের পড়তে হয়; ভাতের জন্য- বুদ্ধির জন্য; নাগরিকতা-আধুনিকতা-নিরাপত্তা-রাজনীতি-বিজ্ঞান-বাণিজ্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ধর্ম কিংবা বিতর্কের জন্য। কিন্তু জিব আর তালুর মধ্যে চায়ে ডোবানো টোস্টবিস্কুট রেখে একইসাথে কোমলতা-উষ্ণতা আর মিষ্টতার অনুভব শুধু আসে কবিতা পাঠেই। তাই কোনো কবি চলে গেলে অন্যরকম লাগে। মনে হয় যেন আমাদের খরখরে টোস্টবিস্কুট জীবনটা ডোবানোর জন্য আরো একটা কাপের চা একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। আজ চলে গেলেন কবি শহীদ কাদরী...

কবি টোকন ঠাকুর আক্ষেপ করে লিখেন,

আফসোস রইল, বাংলাভাষার কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের কখনো দেখা হলো না...

সাংবাদিক হাসান মামুন লিখেন,

আপনাকে অভিবাদন--সৃষ্টিশীল একটি জীবন আমাদের পাঠের জন্য রেখে গেলেন বলে

কবি ফকির ইলিয়াস শহীদ কাদরীকে উদ্দেশ করে কবিতায় লিখেন-

এই দেহ গ্রহণ করো,বাংলাদেশ
গ্রহণ করো হে বাংলার মৃত্তিকা,
হে ফুল, হে পাখির ডানা,
গ্রহণ করো হে প্রিয় নদীর স্রোত, ঘাসগুচ্ছ
হে সামরিক ব্যারাক,
হে প্রেমিকার চোখ- তোমরা সবাই...
তাঁকে গ্রহণ করো, বুঝে নাও তার পদযুগল
তাঁর পাঁজর,আঙুল- যে হাত একদিন লিখতো
কবিতা,
গ্রহণ করো সেই হাতের কলম,
তিনি আসছেন তোমাদের কাছে,
তোমার কাছে,
আসছেন কবি, আসছেন শহীদ কাদরী
তাঁকে গ্রহণ করো হে প্রজন্ম, হে উত্তরাধিকারের
রক্তস্রোত -
তাঁকে স্পর্শ করো, স্পর্শ করো....

সাংবাদিক ইয়াহইয়া ফজল লিখেন,

এমন দিন‌ এনে দেব যেদিন সেনাবাহিনী বন্দুক নয় শুধু গোলা‌পের তোড়া হা‌তে কুচকাওয়াজ করবে শুধু তোমা‌কে তোমাকেই স্যালুট করবে সারা‌ দিনরাত...
তোমা‌কে অভিবাদন প্রিয় কবি
নিশ্চয়ই সেদিন আস‌বে পৃথিবীর বু‌কে, যেদিনটির স্বপ্ন তুমি দেখেছিলে। ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীর সকল শান্তিকামী, সকল প্রেমিকের হৃদয় বেঁচে রইবে তুমি।
পৃথিবীর ওপারে ভালো থাকুন কবি...

সংস্কৃতিকর্মী সঙ্গীতা ইমাম লিখেন,

গোলাপ হাতে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ আমাদের দেখা হলো না প্রিয় কবি। শান্তিটুকু আপনার হোক। অভিবাদন।

সহুল আহমেদ মুন্না লিখেন-  

প্রেমে পড়ার পরপরই ভালোবাসার মানুষকে প্রথম যে কবিতা উৎসর্গ করেছিলাম সেটা ছিল শহীদ কাদরীর সেই বিখ্যাত কবিতাটা -

'ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।'

প্রেমিকাকে দেয়ার মতো নতুন প্রেমিকের কাছে এর চেয়ে ভালো কোন উপায় ও অস্ত্র জানা ছিলনা। শহীদ কাদরীর কাছেই আমার যেতে হয়েছিল।

আমার প্রিয় এই কবি নাকি তখন কি এক দূতাবাসে চাকরি করতেন; হঠাৎ 'একদিন কবি অফিসে এসে ফাইলপত্র ছুড়ে ফেলে বললেন, হিন্দি চুলের চাকরি শহীদ কাদরী করে না। বলেই যে বের হলেন, আর কোনো দিন অফিসে ফিরলেন না।' হুহ!

কবির কাছে যখনই তালাশ করেছি প্রেমের কবিতার জন্যে, কবি দিয়েছেন উজাড় করে। কখনো বলেছেন,

'একবার শানানো ছুরির মতো তোমাকে দেখেছি
হিরণ্ময় রৌদ্রে জ্বলজ্বলে
যেখানে মাংসের লালে
শিউরে উঠেছে আমার সত্ত্বার সখ্যতা -
সেইখানে, সোনালি কিচেনে তুমি
বসন্তের প্রথম দিনেই হত্যা করেছিলে আমাকে তোমার নিপুণ নিরিখে। '

কখনো কখনো কবি হয়ে গিয়েছেন 'বৈষ্ণব'; বলেছেন -
'শাদা রাস্তা চ'লে গেছে বুকের মধ্যে
পাতার সবুজ সম্মিলিত কাচা শব্দে
যে তোমাকে ডেকেছিল, 'রাধা',
আধখানা তার ভাঙ্গা গলা, আধখানা তার সাধা।'

'রাষ্ট্র মানেই লেফট, রাইট, লেফট' কবি রাষ্ট্রের প্রধানের কাছে দিয়েছিলেন কিছু প্রস্তাব -

'রাষ্ট্র প্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো
জেনারেলদের হুকুম দেবেন রবীন্দ্রচর্চার? মন্ত্রীদের
কিনে দেবেন সোনালী গিটার? ব্যাংকারদের
বানিয়ে দেবেন কবিতার নিপুণ সমঝদার?'

রাষ্ট্রপ্রধান কি মানবেন এমন প্রস্তাব? কবির যে কোন দ্রোহের উচ্চারণের মাঝেও ছিল রোমান্টিকতা -

"মনজুর এলাহি আবার বললেন: বন্দুকের নলই
শক্তির উৎস! রক্তপাত ছাড়া শ্রেণীসাম্য প্রতিষ্ঠা
অসম্ভব, অনায়াসে কেউ শ্রেণিস্বার্থ ছেড়ে দেয় না।
আমি জানালা থেকে দেখলাম
মনজুর এলাহীর গোটা বাগান
জোনাকিরা দখল করে নিয়েছে-
বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে।"

কবিতাকে 'কবিতা, অক্ষম অস্ত্র আমার' বলছেন।
বলেছেন 'মধ্যরাত্রি পর্যন্ত অনিদ্রা এবং অস্থির জাগরণ ছাড়া তুমি কিছু নও'; তবুও এই অস্ত্রকে সক্ষম করে তুলতে চাইতেন মনেপ্রাণে -

''বরং এসো করমর্দন ক'রে যে যার পথের দিকে যাই,
তবু আরো একবার বলি:
যদি পারো গর্জে ওঠো ফিল্ডগানের মতো অন্তত একবার ..."

আমার প্রিয় এই কবি চলে গেলেন আজকে। মানতে কষ্ট হচ্ছে। হাজারো প্রেমিকের মনে কবি, তুমি বেঁচে থাকবে হাজার বছর...

উল্লেখ্য, কবি শহীদ কাদরীর জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই ও আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯)।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত