স্বকৃত নোমান

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:৪৪

আপোষকামিতার জন্য প্রান্তিক পর্যায়ে ধর্মান্ধতার বিকাশ ঘটছে

এটিএন নিউজে গতকাল একটি সংবাদ দেখলাম কওমি মাদ্রাসা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো নিয়ে। দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সঙ্গীত কেন গাওয়া হয় না―সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে মাদ্রাসার এক তরুণ শিক্ষক বললেন ঠিক এভাবে, “জাতীয় সঙ্গীতে আছে ‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস।’ আকাশ তো আল্লাহর, বাংলার আকাশ হয় কিভাবে? এটা শিরিক। তাই আমরা এই সঙ্গীত গাই না।”

এই তরুণ শিক্ষকের চিন্তা-চেতনা কতটা পশ্চাৎপদ, বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু তার প্রতি ছোট্ট একটি প্রশ্ন : হে তরুণ মৌলবি, আপনার বাড়িতে যখন নতুন কোনো অতিথি আসে তখন আপনি তাকে আপনার বাড়ির শাপলা পুকুরটির কাছে নিয়ে কী বলেন? বলেন যে, এটি আমার পুকুর। একবারও কিন্তু বলেন না এটি আল্লাহর পুকুর। ঠিক একইভাবে পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে দৃষ্টিটাকে এবার জাতীয় পরিমণ্ডলে এনে যদি বলেন, এই আকাশ আমার দেশের আকাশ, এই বাতাস আমার দেশের বাতাস―তাহলে কি শিরিক হবে?

এই বলাটা যদি শিরক হয়, তাহলে আপনি যে আপনার বাড়ির পুকুরকে ‘আমার পুকুর’ বলেছেন, সেটাও কি শিরিক নয়?

অপরদিকে, এটিএন নিউজের ঐ সাংবাদিক যখন একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঢোকার চেষ্টা করলেন, তাকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হলো। ঢুকতে দিল না। প্রচারিত ঐ সংবাদের সূত্রে আরো জানা গেল, অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না।

কওমি মাদ্রাসা আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো যেন একেকটি দুর্গ। ভেতরে কী হয়, বাইরের কেউ কিছু জানে না। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। একটি স্বাধীন দেশে বসবাস করে তারা ভিনদেশের শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, ভিনদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করছে। এর নাম বহুত্ববাদ নয়, এর নাম নৈরাজ্যবাদ। শিক্ষার এই নৈরাজ্য অবস্থা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য বিরাট হুমকি। আমি বলছি না মাদ্রাসা বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। স্কুলগুলো বন্ধ করা গেলেও বিপ্লবী সরকার ছাড়া এই ‘গণতান্ত্রিক সরকারে’র পক্ষে বাংলাদেশে মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। এদের বুকে সেই সৎ সাহস নেই। বিপ্লবী সরকার না আসা পর্যন্ত মাদ্রাসা থাকুক। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষায় আনতে হবে আমূল সংস্কার। রাখতে হবে নজরদারি। নইলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের চেহারার দিকে তাকানো যাবে না।

ভোটের কথা চিন্তা করে আমাদের সরকারগুলো এসব মোল্লা-মৌলবিদের সঙ্গে দিনের পর দিন আপোষ করে গেছে। শুধু সরকার নয়, আমাদের সুশীল সমাজও আপোষ করে গেছে। আপোষ করে যাচ্ছে।

চাপাতির ভয়ে আমরা আড়ষ্ট হয়ে গেছি। আমাদের কলম থমকে গেছে। আমরা গর্দান বাঁচানোর জন্য চুপসে গেছি। আমরা ভুলে গেছি লেখালেখির পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। আমাদের সাংবাদিক সমাজও একইভাবে তাদের সঙ্গে আপোষ করে চলছে। ধর্মের সমালোচনা মানে ধর্ম-বিরোধিতা নয়; এই সহজ কথাটি দেশের বড় বড় পত্রিকার সম্পাদকরাও বুঝতে অক্ষম। ধর্ম নিয়ে কোনো কথা থাকলেই তারা ঐ লেখা ছাপার অযোগ্য মনে করে।

পেশাগত জীবনে আমিও একজন সাংবাদিক। চাকরি রক্ষার খাতিরে আমাকেও ধর্মের সমালোচনাধর্মী বহু লেখা বাদ দিতে হয়েছে, হচ্ছে। আমাদের এই অব্যাহত আপোষকামিতার জন্য দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ধর্মান্ধতার ভয়াবহ বিকাশ ঘটে গেছে।

সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি বিপ্লবী কাজ। সরকারকে এ জন্য বিশেষ ধন্যবাদ। জাতি গঠনের জন্য এই বিচার জরুরি ছিল। সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ হওয়া উচিত শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার।

শুধু সরকার নয়, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক সমাজ; এক কথায় চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। কথা বলতে হবে। আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যার যা খুশি তাই করবে, এর নাম গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে যাকে যা খুশি তা করতে দিলে একদিন দেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

শিক্ষাব্যবস্থায় এই নৈরাজ্য জারি রেখে জঙ্গিবাদ রোখা যাবে না, কোনো অবস্থাতেই না।
 ১৯.০৯.২০১৬

  • স্বকৃত নোমান : ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত