মোসাইদ রাহাত, সুনামগঞ্জ

২১ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ১৩:১৯

মামলায় আটকে আছে সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণ

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হলে ভাষা শহীদদের সম্মানার্থে ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর সন্তানদের শ্রদ্ধা জানানো জন্য সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ডিএস রোড এলাকায় তৈরি করা হয় শহীদ মিনার। সেই শহীদ মিনারেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে প্রথম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধাসহ পুরো সুনামগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। সুনামগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধায় শহীদ মিনারটি সম্মান দেওয়া হলেও সেটি এখন শুধুমাত্র রয়ে গিয়েছে দিবস কেন্দ্রীক।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শুধুমাত্র ব্যবহার করা হয় এ শহীদ মিনারটি। দিবসের একদিন আগে শহীদ মিনারের আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হলেও বাকি দিন গুলো পড়ে থাকে অবহেলায়। ধুলাবালি, গাছের পাতা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে পড়ে থাকা এবং দেখাশোনার কোন লোক না থাকায় শহীদ মিনারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হচ্ছে না।

মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি সুনামগঞ্জের ঐতিহ্য ধারণ করা এই শহীদ মিনারটি প্রশাসনের উচিত সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করা। তাছাড়া শহীদ মিনার নিয়ে সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে একটি মামলা চলমান থাকায় সংস্কার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছে শহীদ মিনারটি।
 
জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই সুনামগঞ্জ মুক্তদিবসের পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও হাওরাঞ্চলেরর মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক অধিনায়ক সালেহ চৌধুরী এর নকশা করে দেন। বালাট সাব সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মোতালিব ঐতিহ্যবাহী এই শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযোদ্ধা জনতা। এভাবেই সুনামগঞ্জ ডিএস রোডের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যায়।

সরজমিনে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গেলে দেখা যায়, বছরের বেশিরভাগ সময় যে শহীদ মিনারটি ধুলাবালি ও গাছের ঝরা পাতায় ভরে থাকে সেটি এখন আলপনার ছোঁয়ায় সুন্দর করা হয়েছে। সামাজিক নাট্য সংগঠন রঙ্গালয় সুনামগঞ্জ এর উদ্যোগে ও জেলা শিল্পকলা একাডেমীর পৃষ্ঠপোষকতায় করা হয় এই আলপনা। বছরের কয়েকটি দিবস ছাড়া যে শহীদ মিনারটি অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে সেই শহীদ মিনারে দেওয়া হয়েছে লাইট।



তাছাড়া শহীদ মিনারের মূল বেদিতেই বিভিন্ন জায়গা রঙ উঠে যাওয়ার পরও নেওয়া হয়নি কোন উদ্যোগ। তাছাড়া পর্যটক ও বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের কাছে এই শহীদ মিনারের ইতিহাস জানার জন্য নেই কোন সাইনবোর্ড বা ফলক। উদ্বোধনের একটি ফলক থাকলেও বর্তমানে তার উঠে গিয়ে বুঝাই দায় হয়ে গিয়েছে আসলে এই শহীদ মিনারের উদ্বোধন কে করেন এবং কত তারিখে করা হয়।

তাছাড়া শহীদ মিনারের জায়গা নিয়ে সমস্যা থাকলেও স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে বর্তমান ডিএস রোড এলাকাতে এটি রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের দাবি ছিলো যাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আজকের এই বাংলাদেশ তাদের সম্মানার্থে এই শহীদ মিনারটি যেনো সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করা হয়। কিন্তু দাবি অনেকবার প্রশাসন মেনে নিলেও বাস্তবে কোন উন্নয়ন হয়নি এই শহীদ মিনারের।

সামাজিক নাট্য সংগঠন রঙ্গালয় সুনামগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, আমাদের একমাত্র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণ নেই। এটির কথা শুধু মাত্র জাতীয় দিবসগুলোর সময় মনে হয়। এখনতো বিজয় দিবসের ও স্বাধীনতা দিবসের শ্রদ্ধা নিবেদন জেলা কালেকটরেট প্রাঙ্গণে তৈরি করা বেদিতে সম্মান দেওয়া হয়। তাই শুধুমাত্র ভাষার মাস আসলেই প্রশাসনের শহীদ মিনারের কথা মনে হয়। বাকি দিন গুলো ধুলাবালি এবং গাছের ঝরা পাতায় নিমজ্জিত থাকে। আমরা চাই প্রশাসন এই শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সঠিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া হোক। তাছাড়া তরুণ প্রজন্ম যেনো এই শহীদ মিনারের ইতিহাস জানতে পারে সেজন্যও একটি কার্যকারী পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, আমাদের শহীদ মিনারটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। যে শহীদ মিনারটিকে প্রতিদিন ঝাড়– দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করার কথা সেটি হয় শুধু দিবসে। তাছাড়া রাতের বেলা অন্ধকারের মধ্যে থাকে শহীদ মিনারটি। শুধুমাত্র দিবস আসলেই আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। প্রশাসনের উচিত এই শহীদ মিনারটি রক্ষণাবেক্ষণ করা। যাদের রক্তের মাধ্যমে আজকে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং যাদের রক্তের বিনিময়ে আজকের এই বাংলাদেশ তাদের সম্মানার্থে যেনো শহীদ মিনারটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় সেটিই আমার দাবি।

এদিকে কিছুদিন আগে শহীদ মিনারের পাশেই তৈরি করা বাণিজ্যিক ভবন। কে বা কারা হঠাৎ শহীদ মিনারের দেয়াল ঘেঁষে তৈরি করে এই বাণিজ্যিক ভবন সেটির তথ্য অনেকেই জানেন না। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রেক্ষিতে এক রাতের মধ্যে ভেঙে ফেলা হলেও শহীদ মিনারের দেয়ালটি আর মেরামত করা হয়নি। তাছাড়া ২০১৪ সালে শহীদ মিনারের জায়গা নিয়ে করা মামলা আজ পর্যন্ত নিষ্পত্তি না হাওয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযোদ্ধা মালেক হোসেন পীর বলেন, ২০১৪ সালের শহীদ মিনারের জায়গার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে জজ সাহেবের নাজির। সে সময়  মামলায় শহীদ মিনারের জায়গাটি বলা হয় জজ সাহেবের। কিন্তু আমরা যুদ্ধের সময় ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্ত করার পর এই স্থানেই শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। তাই আমরা এই জায়গাটি মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়ার জন্য অনেকবার অনুরোধ করেছি। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের জায়গা দেওয়ার জন্য পক্ষভুক্তি ছেয়ে একই আদালতে পিটিশন দায়ের করি। সে সময় আদালত আমার পিটিশন খারিজ করে দেয়। পরবর্তীতে ১৬-০২-২০২০ সালের পুনরায় পিটিশন দায়ের করি। আমরা চাই এই জায়গাটা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নামে দেওয়া হোক।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু শহীদ মিনারের উপর মামলা। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে যতদিন শহীদ মিনার মামলা মুক্ত হবে না ততদিন আমি শহীদ মিনারে প্রবেশ করবো না এবং এবারের ২১শে ফেব্রুয়ারিতেও আমি শহীদ মিনার যাবো না।   

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেছেন, শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। যেহেতু এই জায়গার মধ্যে আদালতে মামলা চলতেছে তাই আমরা কিছু করতে পারতেছি না। যদি জায়গাটি মুক্তিযোদ্ধারা পেয়ে যান তাহলে সুনামগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উন্নয়নে জেলা প্রশাসন কাজ করবে। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত