রাজন দাশ

২১ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ১৫:১৩

শহিদ মিনার : কেমনে চিনিব তোমারে

স্থাপত্যে ভাষা আন্দোলন

‘হাজার শহীদ ঘুমিয়ে আছে বাংলার পথে প্রান্তরে
ওরা মরে না, শহীদ বেঁচে থাকে যুগ যুগান্তরে’

সিলেটের মদনমোহন কলেজ-প্রাঙ্গণে ১৯৬৯ সালে নির্মিত শহিদ মিনারের গায়ে উপরের কথাগুলো লেখা আছে। ১৯৬৯-এর দিনগুলোর কথা যদি মাথায় রাখি তবে এখানে ‘হাজার শহিদ’-এর কথা যে লেখা আছে তাদের ঠিকানা খুঁজতে কেউ ব্যস্ত হবে না। কারণ, এ হলো কবিতার চরণে কবিমানসে জন্ম-নেয়া হাজার শহিদ। আমরা হয়ত হাতে-গোনা সালাম-বরকতের মতো পাঁচ-ছয় জনের নাম জানি (গবেষণার অভাবে আরও কতো শহিদ অজ্ঞাত), কিন্তু বাঙালির মানসপটে থাকা ’৬৯-এর ‘হাজার শহীদ’, ৭১-এর পর লক্ষ লক্ষতে প্রতিভাত হয় বাস্তব সত্যেই।
     
হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন : ‘৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এবং ২০শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে এক শতাব্দী ব্যবধান।’ তিনি ভাষা আন্দোলনের সেই দিনকার নবচেতনাকে আত্মআবিষ্কারের ক্ষণ বলেছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আত্মপরিচয়ের গোড়ায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং ২০ শে ফেব্রুয়ারি যে শুধু মুসলমান ছিল, ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে সে বাঙালিতে পরিণত হয়। ‘একুশের দিন স্বাধীনতার যে বীজ রোপিত হয়েছিল, সে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে প্রায় দু-দশক লাগলেও বাঙালির মূল স্বাধীনতা দিবস হলো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ পণ্ডিত হুমায়ূন আজাদের রাখঢাকহীন ভাষ্যে এ-কথাগুলো প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক এবং সংবেদনশীল মননের অধিকারী প্রত্যেকটি মানুষেরই মনের কথা। তিনি বাঙালির আত্ম-আবিষ্কারের চেতনার উন্মেষকালকে ইঙ্গিত করেই আবার বলছেন, ‘এই চেতনা থেকে আমাদের এক নতুন সাহিত্যধারার জন্ম নেয়। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতায় এক আধুনিক চেতনার বিকাশ লক্ষ করা যায়।’
     
গুরুত্বপূর্ণ ভাষাসৈনিক ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক ‘একুশের কবিতা ও আমাদের সাহিত্য’ প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা আবেগ সাহিত্য অঙ্গনের সবকিছু তছনছ করে দিয়েছিল। তীব্র জ্বালাময় অভিব্যক্তি নিয়ে কবিতাই প্রথম একুশের পতাকা কাঁধে তুলে নিয়েছে।’ ১৯৫৩ সালের মার্চে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনে সুকুমার রায়ের উপমার মতোই যেন শব্দ করে ফুল ফোটা শুরু হয়েছিল কবিতায় কবিতায়। ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণচূড়ার কাল না হলেও তখন ‘সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে’। বীররস করুণরস, আরও কত রস- রক্তঝরা আন্দোলনের কাব্যকলা হল, সংগীতকলাও হল। আমরা কান্না ভুলে ‘ফাঁসির দাবি’র কথা শুনলাম, ‘স্মৃতির মিনার ভাঙ্গা’র কথা শুনলাম, দুঃখিনী বর্ণমালার কথা শুনলাম; ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারির গান শুনলাম; মুখের ভাষা কাইড়া নেয়ার  লোকসুর শুনলাম, মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনার গল্প শুনলাম, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দুর ক্ষণস্থায়ী অথচ চিরঅক্ষয় দ্যুতির কথা শুনলাম, কিন্তু যা শুনিনি পড়িনি কেবল দেখেছি- যে কলা রচিত হল দিবসের প্রথম সূর্যের আহ্বানে তা হল স্থাপত্যকলা। বাঙালির ইতিহাসের  সেই অক্ষয়া তিথি ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুরবেলার অক্ত’ যখন বৃষ্টির মতো ঝরল বরকতের রক্ত, তার পরদিনই রাত ১০টায় শুরু হলো দ্রোহ-শোক-মুক্তির অস্ফুট আবেগকে রূপদানের দুর্মর সৃষ্টিযজ্ঞ। আর ২৪ ফেব্রুয়ারির সূর্যের প্রথম আলোয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ-প্রাঙ্গণেই জেগে উঠল প্রথম ‘শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’। বাঙালির প্রথম প্রতিবাদী স্থাপত্যশিল্প।
     
একবার ভেবে দেখুন, নতুন ভবন নির্মাণের জন্য পড়ে-থাকা ইট-বালি-সিমেন্ট দিয়ে মিস্ত্রি ডেকে রাতের বেলা তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় ছ-ফুট চওড়া দশ ফুট উঁচু যে-আঙ্গিক দাঁড়িয়ে গেল ২৪ তারিখ সক্কালেই, সেই কঠিন অবয়বের ভেতরে কী থাকতে পারে? কী তার শক্তি? পাকিস্তানিরাই-বা একে এত ভয় পেল কেন? তখনও তো প্রতিবাদী কবিতা-গান হয়নি, গল্প-উপন্যাস-চিত্রকলা হয়নি, আন্দোলনের উত্তাপে থাকা প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানব-মানবীর অভ্যন্তরে তখনও সুর-বাণী-রং-ছবি টগবগ টগবগ করছে বহিঃপ্রকাশের বেদনাক্রান্ত অপেক্ষায়Ñভবিষ্যতে যা শিল্পরূপ নিয়ে জন্মাবে- তখনও তা জন্মায়নি। ২৪ তারিখের প্রথম শহিদ মিনার হল সেই অপেক্ষার তাৎক্ষণিক টগবগানি; আন্দোলনে-কাঁপা তারুণ্যের ভেতরকার সুর-বাণী-রং-ছবি প্রকাশ করতে না-পারার যে-বেদনা তারই জমাটবদ্ধ রূপ। পাষাণপ্রতিমা, বরফায়িত সংগীত।
     
দলে দলে লোকে এ সংগীতের কাছে এল। ভিড় জমালো এর পাশে কারফিউর ভয় তোয়াক্কা না করে। যেন সবার মনের দ্রোহ-ক্ষোভ-শোক-বিহ্বলতা সর্বোপরি মনের গভীরে থাকা সব অপ্রকাশিত আবেগ এই একখানা প্রতীকে এসে কেন্দ্রীভূত হল। এভাবেই বাঙালির আত্মপ্রকাশ প্রথম ভাষা পেল স্থাপত্যে। কেন পেল? কেনই-বা সেদিনের সংগ্রামী তরুণরা কবিতা না লিখে ছবি না এঁকে ইটের পর ইট গেঁথে কলেজ-প্রাঙ্গণের রক্তভেজা ঘাসের বুকে অমর করে রাখলেন শহিদ স্মৃতিকে। কেন বেছে নিলেন স্থাপত্য? কী তার শক্তি? আহমদ রফিক ‘শহিদ মিনার : স্মৃতির মিনার’ প্রবন্ধে বলছেন :

‘শহিদ মিনারের নিহিত শক্তি ও নীরব চ্যালেঞ্জ মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র এবং অবাঙালি-প্রধান সেই আমলাতন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত এ দেশীয় পুতুল সরকারের নেতৃবৃন্দ। তাই ছাব্বিশ  ফেব্রুয়ারি বিকালে হঠাৎ করেই পুলিশ ঘেরাও করে মেডিক্যাল ব্যারাক। ভেতরে ঢোকে সশস্ত্র পুলিশ, সঙ্গে ট্রাক এবং কোদাল-শাবল-গাঁইতি হাতে ঘাতক স্কোয়াড। আঘাত পড়ে শহিদ মিনারের পাঁজরে। বেশ কষ্ট করেই ভাঙতে হয় মিনারের স্থাপত্য।
ওরা চলে যায়। যাবার আগে টুকরা-টুকরা করে ভাঙা শহিদ মিনারের ইট-সিমেন্টের শেষ খণ্ডটি ট্রাকে তুলে নেয়। না, ওদের বাধা দেওয়ার মতো কেউ সেখানে ছিল না, বাধা দেওয়ার কোনো চেষ্টাও করা হয়নি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শহিদ মিনারের শূন্যস্থানটির দিকে শেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওরা দ্রুত অকুস্থল ত্যাগ করে। পেছনে রেখে যায় কিছু ধুলা আর পোড়াজ্বালানির উৎকট গন্ধ; সেই সঙ্গে মিনারের নির্বাক বেদনা। দূর থেকে কয়েকজন ছাত্র অসহ্য বেদনার এই করুণ দৃশ্যটি দেখে, আর স্মৃতিতে ধরে রাখে।’

একটি স্মৃতিস্মারক স্থাপত্যের প্রধানতম শক্তি হল সে আকাশতলে মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়ে নিশ্চল একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তার পাশ দিয়ে ভ্রমণকারী ব্যক্তিমাত্রই তাকে উপেক্ষা করতে পারে না। আকার ও উচ্চতাভেদে তার দৃষ্টিগ্রাহ্যতার সীমানা বাড়ে। আমি-তুমি-সে অনুপস্থিত থাকলেও আমাদের সম্মিলিত ভাবনা-বক্তব্য তার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি। হাজার কণ্ঠের প্রতিবাদ সে ধারণ করতে পারে। কোটি মানুষের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যয়-প্রত্যাশা সে তার মাঝে জ্বালিয়ে রাখতে পারে। চর্মচোখে হয়ত সেগুলো দেখা যায় না কিন্তু এর বিমূর্ত ভাবশিখার উত্তাপ টের পায় আশায় বুক-বাঁধা স্বপ্ন-দেখা মানুষ। আর দুষ্টশক্তি সে উত্তাপ সহ্য করতে পারে না। অত্যাচারিত-নিপীড়িত মানুষের রুখে দাঁড়ানোর বাসনাকে সে ভয় পায় সবচেয়ে বেশি। তাই তো সেই ইচ্ছার প্রতিমূর্তি কাঠামো সে গুঁড়িয়ে দিয়ে অকুস্থল ছেড়ে পালায়।
     
প্রথম শহিদ মিনারের স্থাপত্যশৈলী নিয়ে বেশি বলবার কিছু নেই। ব্রিটিশ আমলে গির্জা সংলগ্ন সমাধিস্থলে বড় বড় ব্যক্তি বা ফাদারদের সমাধিসৌধ যেভাবে হতো এটিও অনেকটা  সেরকম। একটি চারকোণা ঘনকের উপর আরেকটি খানিক-উঁচু ছোট ঘনক; তার উপর একটি বর্গাকৃতি স্তম্ভ যা উপরের দিকে ক্রমশ কৌণাকৃতি ধারণ করেছে। ব্যক্তিসমাধি হলে হয়ত তাতে একটি এপিটাফ লেখা থাকত, এক্ষেত্রে লেখা ছিল ‘শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’।    
     
প্রথম শহিদ মিনারের যে জন্ম-ইতিহাস, যে স্বপ্ন-আশা-দ্রোহ-শোক-সংগ্রাম নিয়ে তার সৃষ্টি দুটির বেশি সূর্যোদয় সে দেখতে পায়নি; মায়ের চোখের অশ্রুবিন্দুর মতো সে ঝরে পড়েছিল। আর সেই অশ্রুর হিরণ্ময় ছটা ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার পথে-প্রান্তরে। সিলেটের মদনমোহন মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ১৯৬৯ সালে নির্মিত শহিদ মিনারটি সেরকমই একটি অশ্রুবিন্দু।

পরের ইতিহাসটুকু হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন অনবদ্য ভাষায়, তাঁর ‘শহীদ মিনার : কাফনে  মোড়া অশ্রুবিন্দু’ প্রবন্ধে :

‘শহীদ মিনার বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত স্থাপত্যকলা। শোকে যেমন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অজ্ঞাতে, উদ্গত হয় অশ্রুরেখা, ঠিক তেমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মথিত বুকের গীতিকার মতো উৎসারিত হয়েছে একেকটি শহীদ মিনার। কোনো পূর্বপরিকল্পনার প্রয়োজন পড়েনি, অনেক ভেবে বের করতে হয়নি তাদের অবয়বকাঠামো। মাথা জীর্ণ ক’রে উদ্ভাবন করতে হয়নি তাদের রূপকার্থ। একটি ইট ছুঁড়ে দিলেই হয়েছে শহীদ মিনার। এক টুকরো জমির ওপর একধাপ মাটি জড়ো করলেই তা রূপ ধরেছে শহীদ মিনারের। একগুচ্ছ ফুল জড়ো করলেই রচিত হয়েছে একটি শহীদ মিনার। প্রত্যেকটিতে জড়ো হয়েছে শোক বেদনা দীর্ঘশ্বাস; প্রতিটিই বহন করেছে দ্যুতিময় রূপকার্থ। এমন অবলীলায় কোনো বস্তু বা উপাদানকে এতো অর্থদ্যুতিময় করতে পারে নি কোনো শিল্পী; কিন্তু শহীদ মিনারÑবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, রাস্তার পাশে, ছাত্রাবাসের সম্মুখে, মাঠের প্রান্তে- যারা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ ভরে, তাঁরা অবলীলায় বস্তুকে পরিণত করেছেন অবিনাশী রূপপ্রতীকে। যার মাটি নেই, সে আকাশে মনে মনে এক টুকরো মেঘকে জড়ো করে বানাতে পারে শহীদ মিনার। পথের পাশে কয়েকটি তৃণগুল্মলতা জড়িয়ে রচনা করা সম্ভব প্রদীপ্ত শহীদ মিনার। প্রতিটিই টলমল করতে থাকে অশ্রুবিন্দুর মতো, প্রতিটিই দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে অতল অভ্যন্তর থেকে।’

১৯৫৩ থেকেই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়-উপজেলায় গ্রামে-গঞ্জে স্কুলে-কলেজে শহিদ মিনার নির্মাণ হতে থাকে। এসব শহিদ মিনারের স্থাপত্যরূপ কী রকম ছিল তা অজানা। কারণ ক্ষণস্থায়ী উপকরণ দিয়ে এগুলো নির্মিত হয়েছিল।
     
পরবর্তীকালের ইতিহাস মোটামুটি লিখিত পাওয়া যায়। ১৯৯১ সালে  বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ভাষা-আন্দোলনের শহীদেরা নামক সংকলনে সুকুমার বিশ্বাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ সরকার ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন। শিল্পী ও স্থপতিদের কাছে নকশা চাওয়া হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, এম.এ. জব্বার (তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার) এবং ডক্সিয়োডিস (গ্রিক স্থপতি; সেসময় তিনি ঢাকায় একটি কাজে নিয়োজিত ছিলেন) এর সমন্বয়ে গঠিত কমিটি নকশা নির্বাচনের দায়িত্ব পান। শিল্পী হামিদুর রহমান এবং নভেরা আহমেদের নকশা নির্বাচিত হয়। (অন্য কারো নকশা কমিটির কাছে জমা পড়েছিল কিনা তা ইতিহাসের পাতায় নেই।)