খলিলুর রহমান ফয়সাল

২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:৩১

একটি বাংলাদেশ, একজন জাফর ইকবাল

ছবি: জি আর সোহাইল

সরকারদলীয় বিরোধীদলীয় সিলেটের কিছু রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে জামাত-শিবির পর্যন্ত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ইস্যুতে সব রসুনের এক পাছা নীতি অবলম্বন করেন। যে করেই হোক জাফর স্যারকে সিলেট ছাড়া করতে চান। এটা ভেবে বৃহত্তর সিলেটে জন্ম নেয়া এবং বর্তমানে সিলেটে বসবাসরত হিসেবে আমার খুবই লজ্জা লাগে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল সিলেটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবে কাজ করে এ অঞ্চল তথা সমগ্র দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এটা ভেবে খুব কষ্ট লাগে যে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে আমরা সিলেট থেকে তাড়াতে চাই। বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেয়না এটা পুরানো অভ্যাস, কিন্তু ইচ্ছে করেই ভাল দাঁতে ইট মেরে রক্তাক্ত করা এটা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে হয়।

অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বারবার পিছিয়ে গেলেও এদেশের মানুষের পরিশ্রম, মেধায়, প্রজ্ঞায় আমরা কিন্তু ঠিকই এগিয়ে চলেছি। বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন এই বাংলাদেশ। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষা ও কৃষ্টি কালচার। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতিগুলো আমাদেরকে করেছে আরও সমৃদ্ধশালী। সিলেটের হাসনরাজা, রাধারমণ, আব্দুল করিমের গান শুনেই আমি বড় হই। ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি সিলেটে একজন আছেন যিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেন, তরুণদের স্বপ্ন দেখান তিনি হচ্ছেন প্রফেসর জাফর ইকবাল।

জাফর স্যারকে সরাসরি প্রথম দেখি সিলেটের কোন একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সেদিন যাকে পেয়েছি তাকেই বলেছি - "জাফর ইকবালকে আজ দেখলাম, জাফর ইকবালকে আজ দেখলাম"...শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম ভাল সাবজেক্ট পাওয়ার আশায় নয়, শাবিপ্রবিতে জাফর স্যার আছেন তাই। এই বুড়ো বয়সেও সাদা গোঁফের মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আমার দেখা সেরা স্মার্টদের একজন। তখন আমি ছাত্র ছিলাম। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন "আমার বন্ধু রাশেদ" সিনেমাটি দেখানো হয়, তিনি ছিলেন উত্তরদাতা আমি ছিলাম অনুষ্ঠান সঞ্চালক। একটার পর একটা প্রশ্ন আসছিল তিনি খুব গুছিয়ে উত্তর দিতে থাকলেন । গণজাগরণের সময় চৌহাট্টায় জাফর স্যার আমাদের সবার মতোই মাটিতে বসে থাকতেন। সবার শেষে মাইক নিয়ে রাজাকারদের গালে চপেটাঘাত করতেন। তারপর বহুবার বিভিন্ন কারণে শাবিপ্রবির এ বিল্ডিং বিশাল কক্ষে গিয়েছি শুধু স্যারের সাথে দেখা করার জন্য।

২০১৩ সালে তাঁর অগ্রজ ও প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে স্যারের চেম্বারে গিয়ে দেখি উনার মনটা খুব খারাপ। জাফর স্যার সেদিন তাঁর দাদাভাইয়ের গল্প শোনালেন। হিমু পরিবহন নামে একটি সংগঠন আছে যারা বাংলাদেশে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল গড়তে চায়। হিমু পরিবহনের হয়ে স্যারের কাছে যেদিন গেলাম, তিনি শোনালেন তাঁর স্বপ্নের কথা। তারপর বিভিন্ন কারণে শাবিপ্রবি যাওয়া হয়। এক বৃষ্টির দিন স্যার বড় একটি ছাতা দুলিয়ে দুলিয়ে চেম্বারের দিকে আসছিলেন। আমি মুক্তমঞ্চের সামনের মাঠে বসে খাচ্ছিলাম। আমাকে দেখেই স্যার এক গাল হাসি দিলেন। আমি বললাম, “স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?” জাফর স্যার বলেন, “আরে তুমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না, এখানে কি করো?” আমি বলি- “স্যার আমি তো আর ছাত্র নাই, চাকুরী পেয়ে গেছি।” সাথে সাথে জিহ্বায় কামড় দিলাম, এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। স্যার আবার একগাল বললেন, “আরে তোমাকে চিনি তো। তোমাদের ভার্সিটিতে আগে বহুবার গিয়েছি। একটা বন আছে। শেয়াল-টেয়ালগুলো কি এখনো ডাকে?” আমি আর উত্তর দিতে পারি না। জাফর স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন এটা ভেবে খুশিতে কি করবো সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।

আমি যখন ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দিই তখনকার কথা বলি। আজ বিকালে একটা ভার্সিটি পরীক্ষা দিয়ে স্টেশনে দৌড়াই। কারণ কাল বাংলাদেশের আরেক মাথায় যেতে হবে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার জন্য। পরশু আবার আরেকটা। বয়স কম, মনে হতো এডভেঞ্চারে আছি। সারারাত এডভেঞ্চার করে ভর্তি পরীক্ষার জন্য যা পড়ে এসেছিলাম, সব বাসে বা ট্রেনেই রেখে আসতাম। বাবার টাকা আর মায়ের দুশ্চিন্তার কথা নাই বা বললাম। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একমাত্র তারাই এ সমস্যাটির কথা বুঝতে পারবেন। যারা কলেজের গণ্ডি পেরুতে পারেননি কিংবা বাবার কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দমতো সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে যায় তারা এ কষ্ট বুঝতে পারবেন না।

কদিন আগে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেলো। সময়ের প্রয়োজনে আমি ছিলাম পরিদর্শক। দেখেছি কতগুলো টেনশনে ভরা মুখ, তাঁদের দিকে তাকানো যায় না। জাফর স্যার শুধু তাঁদের টেনশন কিছু কমাতে চেয়েছিলেন। বাবা-মায়ের কিছু টাকা বাঁচাতে চেয়েছিলেন। ভর্তি কমিটির কাগজ কলমের মারপ্যাঁচ বা প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে চেয়েছিলেন। তাতেই সব রসুনের এক পাছা হয়ে গেলো। জাফর স্যারের মতো আমিও বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত পরীক্ষা নেয়ার পক্ষে। অনেকে তখন সিলেটের শাবিপ্রবির সাথে যশোরের যবিপ্রবির মানের তুলনা করছেন। আরে ভাই, ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মানেরও তো পার্থক্য আছে। কিন্তু একই প্রশ্নে কিন্তু পরীক্ষা হয়। সবচেয়ে মেধাবীরা “চয়েস” এর ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজগুলিতে স্থান পায়। সেরকমটা এখানেও হতে পারতো। আমাদেরতো গর্ব হওয়া উচিত ছিলো, বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে পুরানো ধারা থেকে বেরুতে পারেনি শাবিপ্রবি সেখানে সাহস দেখিয়েছিল। যেমনটা তারা এসএমএস এর মাধ্যমে ভর্তি ফরম কাটার বুদ্ধিটি দিয়ে বাংলাদেশে ভর্তি পরীক্ষা কতো সহজ করে দিয়েছে। শুধু মেডিকেল কলেজ বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই নয়, একজন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে যেসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি (কৃষি বিজ্ঞান, ফিসারিজ, এনিম্যাল সায়েন্স, ভেটেরিনারি, কৃষি প্রকৌশল, কৃষি অর্থনীতি, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক্স ইত্যাদি) পড়ানো হয় সবগুলোর ভর্তি কার্যক্রম একসাথে হওয়ার দাবী জানাই। এতে করে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা দুটোই কমবে। অনেক সময় পেড়িয়ে যাচ্ছে- "কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাঁকলে করবে টাশ টাশ।"

এবার আসি সিলেটের কিছু "সচেতন মানুষ" এর কথায়। চিঙ্কু বাম কি জিনিস আমি বুঝিনা, জামাত পন্থি আওয়ামী-লীগ, জামাত নির্ভর বিএনপি এগুলো আবার কি? তবে ফেইসবুকীয় ভাষার এ চরিত্রগুলো সিলেটের জন্য কতো যে ভয়ংকর হবে, তা আগে বুঝিনি। আমি যখন টুকটাক সাংবাদিকতা করতাম তখন এ বিষয়গুলো খুব কাছ থেকে দেখি। এখানকার কয়েকজন রাজনীতিবিদদের চেতনা (সবার কথা বলছি না) মাইকে সীমাবদ্ধ। সভা সমাবেশে মাইক পেলে ১৯৭১ আমার চেতনা। সভা শেষে বাসায় ফিরে ১৯৭১-এর বিশ্বাসঘাতকদের সাথে চায়ের সাথে পরোটা, ব্যবসার পার্সেন্টেজ নিয়ে আলাপ। টাকার বিনিময়ে কোন কোন আওয়ামী লীগ নেতা চাকুরীর জন্য বিএনপি-জামাতী প্রার্থীর নামও সুপারিশ করেন। একই ব্যাপারটি আওয়ামী প্রার্থীর বেলায়ও ঘটে। চেতনা বা আদর্শ বলতে কিছু নেই।

সত্যি বলতে কি তাঁদের হীন উদ্দেশ্য শিক্ষিত সিলেটবাসীর সমর্থন করা তো দূরের কথা; যাদের জন্য এই আয়োজন অর্থাৎ খোদ ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরাও (কয়েকটা ছাগু বাদে) তখন তা সমর্থন করেনি।  স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু একদম ভিন্ন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। বিশ্ববিদ্যালয় কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের না। এটি সমগ্র বিশ্বের পাঠশালা। স্থানীয় জনপ্রতিধিরা সাহায্য করবেন কিন্তু তাদের স্বার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। অচিরেই বাংলাদেশে স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজ কে শিক্ষামন্ত্রনালয়ে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করা জরুরী বলে মনে করি। একটা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই বাইরের মানুষের কথায় চলতে পারে না।

আমরা বাঙালিরা খুব রসিক ও হুজুগে। যখন যা পাই তা গোগ্রাসে গিলি- ভাল মন্দ বিচার করি না। বুঝে না বুঝে দুভাগ হয়ে যাওয়া আদ্যিকালের অভ্যাস। সিলেট অঞ্চলে হাসন রাজা, বাউল শাহ আব্দুল করিম, বিপ্লবী সুহাসিনী দাশ, জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানি, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, এম সাইফুর রহমান, আবেদ খান, সুবীর নন্দী, সালমান শাহ, রোশনারা আলীর মতো লোকরা জন্ম নিয়েছেন। এখানকার চা, সাতকরা, কমলালেবু সারা বাংলাদেশের গর্ব। সিলেটের মতো সুন্দর ও সবুজ আবহাওয়া বাংলাদেশে অন্যান্য জায়গায় কমই আছে। সুতরাং সিলেটকে অযোগ্য - অস্পৃশ্য বলার কিছু নাই। যা কিছু হবে যোগ্যতার ভিত্তিতেই হবে।

সিকৃবিতেও যেমন চট্টগ্রামের মেয়ে মেধাতালিকায় চান্স পেতে পারে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও মৌলভীবাজারের ছেলে নিজ যোগ্যতায় চান্স পেতে পারে। মনের মিল থাকলে কুমিল্লার মেয়েকে যেমন হবিগঞ্জের ছেলে বিয়ে করতে পারে তেমনি চাকুরীতে ভাল পজিশন নিয়ে রাজশাহীতেও সুনামগঞ্জের মানুষ থাকতে পারে। ছোট্ট একটা দেশ- এতো বিভেদ কেন ? প্রত্যেকটা এলাকায়ই ভাল মানুষ খারাপ মানুষ আছে। বরং খারাপ মানুষের তুলনায় ভাল মানুষ বেশি আছে । ভাল মানুষেরা চুপ করে থাকেন আর খারাপরা লাফালাফি করে, তাই খারাপটাই আমাদের চোখে পড়ে।

এটা বাংলাদেশ। হিন্দু-মুসলমান সবার দেশ। ঢাকাইয়া, চাটগাঁইয়া, রাজশাহীর, খুলনার, বরিশাইল্যা, সিলেটী, রংপুরী, ময়মনসিংগ্যা সবাই মিলেই বাংলাদেশ। কালার দেশ-ধলার দেশ, কৃষকের দেশ- অফিসারের দেশ, ছাত্রের দেশ-গৃহিণীর দেশ, ফকিরের দেশ-বেশ্যার দেশ, লম্বার দেশ-খাটোর দেশ, নারী-পুরুষ-শিশুর দেশ। এটা বাংলাদেশ। এই দেশে জাফর স্যারদের খুব প্রয়োজন।

শুভ জন্মদিন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

খলিলুর রহমান ফয়সাল: কর্মকর্তা, জনসংযোগ ও প্রকাশনা দফতর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
www.facebook.com/Gaanwala

আপনার মন্তব্য

আলোচিত