ফারুক আহমদ

১৮ জানুয়ারি, ২০১৬ ০১:০৭

১৯৭১ সালে কতজন শহিদ হয়েছিলেন?

১৯৭১ সালে কতজন শহিদ হয়েছিলেন? এই প্রশ্নটি আমারও। আমি সত্য ঘটনাটি জানতে চাই। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে এই প্রশ্ন করে উত্তর জানা আমার নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে বলেও আমি মনেকরি।

এতদিন এই প্রশ্নটি তুলে, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি, এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার চেষ্টা করতেন স্বাধীনতা-বিরোধীচক্র ও বিএনপির ঘরানার কিছু বুদ্ধিজীবী। সর্বশেষ বিএনপির নেত্রী, পরপর দুই বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুখ থেকেও উচ্চারিত হল।

প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি তাঁর স্বামীকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সকল ধরণের প্রচেষ্টা ও প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখলেও এই বিষয়ে এতদিন নীরব ছিলেন কেন? কেন তাঁর শাসনকালে শহিদদের সঠিক তালিকাটি তৈরির গরজ কখনো অনুভব করেননি? সাধুবাদ জানাই বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ-কারীদের। তবে খুশি হতাম, একইসঙ্গে তাঁরা যদি বঙ্গভবনে গিয়ে শহিদদের তালিকা তৈরির জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবিটা জানাতেন।

শহিদদের তালিকা প্রস্তুতের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজে। এখন এটি প্রমাণিত সত্য যে, সেই উদ্যোগের বাস্তবায়ন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দ্বারাই সম্ভব। বিষয়টি আর তামাদি রাখা যায় না। রাখা উচিৎও নয়।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে দাবিদার অনেকেও হয়তো লন্ডনবাসী প্রয়াত সাংবাদিক সিরাজুর রহমানদের মতো সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের ‘গুয়েবুলিয় প্রচারণায়’ বিশ্বাস করেন যে, তিনলাখ এই সংখ্যাটি বলে দেবার পরেও বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুখফসকে তিন লাখকে তিন মিলিয়ন বলে দিয়েছিলেন! অর্থাৎ লাখের সঙ্গে মিলিয়ন শব্দটিকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন।

যারা এমন কুৎসায় বিশ্বাস করেন, আমার ধারণা তারা বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত রাখার কাজটি জিইয়ে রাখতে চান। প্রশ্ন থাকতে পারে সিরাজুর রহমান কেন বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে এ বোমাটি ছাড়তে যাবেন? এর মূলে ছিল একটি অপ্রাপ্তিজনিত ক্ষোভ। ১৯৭২ সালের ২৭শে জুলাই, বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য যখন লন্ডনে আসেন তখন, সিরাজুর রহমান বিদেশে বাংলাদেশের প্রচার সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা পেশ করে সেটির দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন (দেখুন, তাঁরই লেখা ‘প্রীতি নিন সকলে’, ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ.১২৭-৯)। বঙ্গবন্ধুও চেয়েছিলেন দায়িত্বটি তাঁকে দিতে।

বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে ফাস্ট সেক্রেটারি মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সেকেন্ড সেক্রেটারি আব্দুর রউফকেও রাখতে হবে। কিন্তু বাধ সাধেন লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎকালীন ডেপুটি হাই কমিশনার ফারুক চৌধুরী। ফারুক চৌধুরীর বক্তব্য ছিল, সিরাজুর রহমান তো বিএ-ও পাশ করেননি (দেখুন আব্দুল মতিনের স্মৃতিচারণ : পাঁচ অধ্যায়, পৃ.-২১৩)। সুতরাং এ দায়িত্ব তিনি কীভাবে পালন করবেন? আর এই দুইজন তাঁর অধীনে চাকুরী করবেন কি? পরিণামে সিরাজুর রহমানের সেই ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি। তারপর থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর ওপর ক্ষেপা ছিলেন। প্রতিশোধ নেয়ার সময় আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টেও পরে। তখন তিনি নিজে সাক্ষী হিসেবে এই সংখ্যাতত্ত্বটি হাজির করে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে তা স্বাধীনতা-বিরোধীদের হাতে তুলে দেন।

তার পর লন্ডনে এর বড় প্রচারক ছিলেন ড. আব্দুল মুনিম চৌধুরী, ব্যারিস্টার আলী মোহাম্মদ আযহার সহ পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্টের কর্মকর্তাগণ। তারা লন্ডনে ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এ করার আন্দোলন’ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে সিরাজুর রহমান বড় ধরণের বিতর্কের সৃষ্টি করেন ২০১১ সালের ২৪ শে মে লন্ডনের গর্ডিয়ান পত্রিকায় এই বিষয়ে চিঠি লিখে। এমন কি মৃত্যুর আগেও, ‘লন্ডন ৭১’ নামক শিরোনামে প্রচারিত লন্ডনের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেই একই প্রচারণা অব্যাহত রাখেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বঙ্গবন্ধু না বললে, ত্রিশলাখ শহিদ হবার কথাটি কি হাওয়া ওপর ভর করে এসেছিল? না, হাওয়ার ওপর ভর করেও আসেনি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনে আসার আগে থেকেই দেশী-বিদেশী পত্রপত্রিকায় এই তথ্যটি সম্ভবত চরমপত্রের পরিবেশিত তথ্যের আলোকেই প্রকাশ পায়। কারণ, এই সংখ্যাটি প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রর ‘চরমপত্র অনুষ্ঠানে’ অনুষ্ঠানের লেখক-পাঠক এম আর আকতার মুকুলের কণ্ঠ থেকে। তার পর এই সংখ্যাটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ (৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১), দৈনিক পূর্বদেশ (২১শে ডিসেম্বর ১৯৭১)। পরে এনা পরিবেশিত সংবাদের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি এই সংখ্যাটি প্রচার করে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা। তারপর, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দ্য ডেইলি অবজারভার (৫ই জানুয়ারি), মর্নিং নিউজ (৫ই জানুয়ারি) দৈনিক বাংলাসহ প্রায় সব ক’টি কাগজ। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু লন্ডনে আসার আগেই এই তথ্যটি একধরণের প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়েছিল।

যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধজয়ের পরে এ ধরণের দাবি করা নতুন কোনো বিষয় নয়। যুক্তরাজ্য বিএনপির এককালীন নেতা শামসুল আলম চৌধুরী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দেশে ছিলেন। ৩০শে মার্চ তিনি ঢাকা থেকে লন্ডনে এসে পৌঁছান এবং সাংবাদিকদের কাছে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলে উল্লেখ করে কয়েকটি হত্যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেন। এমনকি তাঁর বক্তব্যের প্রমাণস্বরূপ রক্তমাখা একটি কাপড়ও দেখান এবং দাবি করেন ২৫শে মার্চ ঢাকায় ধানমন্ডি এলাকায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিকটে তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন। তাঁর দেয়া বিবরণ সেই দিনই লন্ডনের ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড ও দ্য টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। “আই সো মাসাকার ইন পাকিস্তান- স্টুডেন্ট’স স্টোরি” শিরোনামে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে শামসুল আলম চৌধুরী আরও দাবি করেছিলেন, তিনি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট থেকে একটি বার্তা নিয়ে এসেছেন। বার্তাটি, তাঁর ভাষায়, “হি হেজ আক্সড মি অ্যাপিল টু দ্য ব্রিটিশ পাবলিক অ্যান্ড টু টেল দেম অ্যান্ড দ্য হোল ওয়ার্ল্ড অব দ্য টেরিবল সিচুয়েশন দেট দ্য বেঙ্গলিজ আর ফেইসিং নাও”।

অর্থাৎ দেশে বাঙালিরা বর্তমানে যে ভয়াবহ অবস্থান সম্মুখীন হচ্ছেন তা পুরো বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়ার জন্য তিনি আমাকে ব্রিটিশ জনগণের কাছে আবেদন জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ এই বিবরণটি সত্য ছিল না। পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সুতরাং তার পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শামসুল আলম চৌধুরীর দেখা হবার কথা নয়। কিন্তু ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড ও দ্য টাইমস তখনো বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন তা জানতো না বিধায় শামসুল আলম চৌধুরী বানানো এই বিবরণটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে। এবং সংবাদটি তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে অনেকটা সহায়ক ভূমিকাও পালন করেছিল। পরিণামে তিনি লন্ডনের ১১ গোরিং স্ট্রিটে অবস্থিত স্টিয়ারিং কমিটির অফিস সেক্রেটারির পদটি লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন বর্তমান কালের মতো প্রচার মাধ্যমের এতো ছড়াছড়ি ছিল না।

স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আব্দুল মান্নানের মতে, তাঁদের ধারণা ছিল দেশে আত্মীয়স্বজন কেউই জীবিত নেই। সেজন্য এখানকার বাঙালিরা স্টিয়ারিং কমিটির তহবিলে পুরো সপ্তাহের বেতনটা তুলে দিতেও কার্পণ্য করেননি। তাঁর মতে, ত্রিশ লাখ সংখ্যাটি প্রবাসীদের কাছে তখন বেশী নয়, কম বলেই মনে হয়েছিল। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ত্রিশ লাখ মানুষ মারা গেছেন, এটা যেমন বঙ্গবন্ধুর অনুমাননির্ভর কোনো কথা নয়, তেমনি অসতর্কভাবে মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা কোনো কথাও নয়।

১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে লন্ডনের আসার পর প্রেস কনফারেন্সে তিনি, তিন মিলিয়নতো দূরের কথা, কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যাই উল্লেখ করেন নাই বরং পরিষ্কারভাবে বলেছেন, “মিলিয়ন্স অব পিপল্”। অর্থাৎ তিনি নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যার উল্লেখ করেননি। সেই প্রেস কনফারেন্সের ভিডিও ক্লিপটি এখনো ইউটিউবে আছে (শেখ মুজিবুর রহমান হিস্টরিক ইন্টার্ভিউ ফ্রম পাকিস্তান)। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত বুদ্ধিজীবীরা ত্রিশলাখের এই তত্ত্বটি অত্যন্ত সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। তবে লন্ডনে সাংবাদিকদের কাছে তিনি “মিলিয়ন্স অব পিপল্” কথাটি বললেও দেশে গিয়ে ত্রিশ লাখের কথাটি বলেছিলেন। এমন কি, ১২ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণের পরে সাংবাদিক সম্মেলনেও তিনি প্রথমে যে কাগজটি পড়েন, সেটিতেও ত্রিশ লাখের কথা ছিল। কারণ, বক্তৃতাটি যে সকল কর্মকর্তা লিখে দিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁদের জানা ও সেকালে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতেই লিখেছিলেন এবং একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সেই তথ্যটিই তিনি মানুষকে পড়ে শুনিয়েছিলেন, বলেছিলেন।

ডেভিড ফ্রস্টকে বঙ্গবন্ধু কত তারিখে সাক্ষাৎকার দিয়ে ছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে সেটি ১৯৭২ সালের ১৮ই জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টিভি থেকে ‘ডেভিট ফ্রস্ট গ্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রচারিত হয়। এই ত্রিশ লাখ সংখ্যাটি সম্পর্কে স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী শেখ মান্নান আরও বলেন, তিনি শুনেছেন, ত্রিশ লাখ এই সংখ্যাটি নিয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর মনে প্রশ্ন দেখা দেয় এবং তিনি নিজেই তখন সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্নটি তুলেন। তাঁকে জানানো হয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকেই সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে শহিদদের সঠিক তালিকা প্রস্তুতের জন্য ১২-সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করেছিলেন (গার্ডিয়ান ২৯ শে জানুয়ারি ১৯৭২)। তবে কোন মাসে কত তারিখ কমিটি গঠিত হয়েছিল, কমিটিতে কারা ছিলেন তা তিনি বলতে পারেননি। সেই কমিটির কথাই ড. জাফরুল্লা চৌধুরী, ২০১৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর, চ্যানেল আই-এর তৃতীয়মাত্রা অনুষ্ঠানে বলেছেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্যকে একটু পাশ কাটিয়ে। যাতে বঙ্গবন্ধুকে মহান দেখিয়েও বিতর্কের মধ্যে রাখা যায়, হেয় করা যায়, সেভাবে।

পাঠক একটু লক্ষ করুন,- তৃতীয়মাত্রা অনুষ্ঠানে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যাটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনে সন্দেহ দেখা দিলে তিনি তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি ড. সাত্তারের নিকট জানতে চান এই সংখ্যাটি তারা কীভাবে পেলেন”? এই প্রশ্ন থেকেই পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে, সংখ্যাটি বঙ্গবন্ধু নিজে বলেননি, কর্মকর্তাগণ তাঁকে লিখে দিয়েছিলেন। নতুবা ড. সাত্তারকে এভাবে প্রশ্ন করতেন না।

অথচ ড. জাফরুল্লাহ জানাচ্ছেন, তখন ড. সাত্তার নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, “বঙ্গবন্ধু সেটা আপনিতো ৮ তারিখের ইন্টার্ভিউতে বলেছেন, ১০ই জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বলেছেন”। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কোটেশনভুক্ত লাইনটিই হচ্ছে ড. জাফরুল্লাহর উর্বর মাথার অভিনব আবিষ্কার এবং এই প্রজাতির বুদ্ধিজীবীদের আদিও আসল চেহারা, মিথ্যাচারের নমুনা। কারণ, ড. সাত্তার বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে, ৮ তারিখে তিনি লাখ লাখ মানুষ মারা যাবার কথাটি বলার পরেও, ত্রিশ লাখের কথা বলে এর দায় স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ে ফেলার দুঃসাহস দেখাতে পারেন এটা কোনো উন্মাদও বিশ্বাস করবে না। অবশ্য এর পরে ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী সঠিক তথ্যই উপস্থাপন করেছেন এবং সেই ১২-সদস্যবিশিষ্ট কমিটির মধ্যে বর্তমানে যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের নামও উল্লেখ করেছেন।

পাঠক আরেকটি কথা এপ্রসঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধু শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহিদের তালিকা তৈরির জন্য কমিটি গঠন করেননি। তিনি বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বসূচক সকল খেতাবও বাতিল করেছিলেন। এ সম্পর্কে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীরবিক্রম লিখিত এবং মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা থেকে ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক’ শিরোনামে প্রকাশিত গ্রন্থে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার পদক তালিকা দেখে মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কারণ, সব সেক্টর কমান্ডারকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। অথচ বেশির ভাগ সেক্টর কমান্ডারের সদর দফতর ছিল ভারতের অভ্যন্তরে এবং যুদ্ধের নয়মাস তাঁরা সেখানেই কাটিয়েছেন। তাই তাঁরা কোথায় বীরত্ব দেখালেন তা নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়। তাঁদের দায়িত্ব ছিল প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা, যুদ্ধ পরিচালনা, প্রশাসন নিয়োগ ইত্যাদি। ফলে সেক্টর কমান্ডারগণ যে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন তার কোনো লিখিত প্রমাণ বা প্রতিবেদন ছিল না। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে অনেকের নিয়োগও বিতর্কিত ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও নিয়মনীতির কোনো বালাই ছিল না। নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডারগণ, যাঁরা সম্মুখসমরে নয়মাস যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তাঁদের অনেককেই উপযুক্ত স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এমন অনেক ব্যক্তিতে সাহসিকতার পদক দেয়া হয়েছে যাঁরা সরাসরি বা দেশের অভ্যন্তরে কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। যাঁরা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন পরিকল্পনা, প্রশাসন, প্রচার, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন তাঁদের সাহসিকতার পদক দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না বরং অন্য কোনো পদক দেয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। সেটা অন্য দেশেও প্রচলিত। কারণ, এ সকল কাজ সাহসিকতার পর্যায়ে পড়ে না। অথচ তাঁরাও পদক পেয়েছেন! সাহসিকতার এ পদক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে তখনকার একজন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে তিনি এ নিয়ে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করলে সফিউল্লাহই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে নিয়ে যান।

মইনুল হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়টি বিস্তৃতভাবে অবহিত করলে পরে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি পদকতালিকাটি বাতিলের আদেশ দেন। এ রহিতাদেশ পরের দিন পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়। কিন্তু কয়েক দিন পরে ওই রহিতাদেশ বাতিলপূর্বক আগের পদকগুলোই বহাল রাখা হয়। মইনুল হোসেন চৌধুরী পরে খবর নিয়ে জানতে পারেন একটি স্বার্থান্বেষী মহলের জোর প্রচেষ্টায় তালিকাটি বহাল রাখা হয়েছিল। অথচ এই মহান ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর অপবাদ দেয়া হয় যে, তিনি নাকি তিনলাখ বলতে গিয়ে তিন মিলিয়ন বলে ফেলেছেন। তবে সুখের কথা যে পূর্ণাঙ্গ না হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রস্তুত হয়েছে এবং সেটিতে সংযোজন-বিয়োজনের কাজ চলছে। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের সবচে লজ্জার বিষয় হচ্ছে, আমরা স্বাধীনতার এতোটি বছর পরেও যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিলেন, তাঁদের তালিকাটি প্রস্তুতের গরজ গত চার দশকেরও বেশী সময়ে কেউ অনুভব করিনি।

কারণ, ড. আতিউর রহমানের গবেষণা মতে, তাদের ৮৫ ভাগই যুদ্ধে গিয়েছিলেন খেটে-খাওয়ার কৃষক পরিবারের সন্তান (নির্বাচিত প্রবন্ধ, ২০০৭, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা)। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর ভাষ্যানুসারে এঁরাই ছিলেন সম্মুখ সমরে। তাই ধারণা করা অমূলক হবে না যে, শহিদের তালিকায় তাঁরাই ছিলেন শীর্ষে। তাঁরা কেউ মারা গেছেন যুদ্ধে, কেউ যুদ্ধে যাবার পথে, আবার কেউ কেউ সপরিবারে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার, অথবা পক্ষশক্তি হবার কারণে।

প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি ‘ত্রিশলাখ শহিদ’-এই শব্দগুলোর মধ্যে তাঁদের আত্মত্যাগকে বন্দি করে তৃপ্তির ঢেকুর গিলবো? আমি মনেকরি জাতীয়ভাবে শহিদদের শুধু তালিকা প্রস্তুতই নয় একইসঙ্গে তাঁদের জীবনী রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুসন্ধান, সংরক্ষণ ও প্রকাশ করার আশু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আর যদি তা না করা যায়, তা হলে, জাতীয়ভাবে স্বীকৃত এই সংখ্যাটিতে নিয়ে আর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাতে বিতর্কের সৃষ্টি করে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে বিভ্রান্ত এবং স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধের সময় শহিদদের আত্মত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে সেজন্য আশু শাস্তিমূলক আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।

ফারুক আহমদ: গবেষক
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত