বাদল কর

০৮ এপ্রিল, ২০১৬ ১৭:০৬

লম্পটের ‘ভয়ে’ হুমকির মুখে প্রাণের উৎসব

বাংলা ও বাঙালির চিরসুন্দর বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যে উৎসবের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাই হচ্ছে 'পহেলা বৈশাখ'।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনকে কেন্দ্র করে বাঙালি মেতে ওঠে এক বর্ণিল, অসাম্প্রদায়িক প্রাণবন্ত উৎসবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ বাঙালির এই প্রাণের উৎসব হুমকির মুখে কতিপয় লম্পটের ভয়ে। 'ভয়ে' কথাটি বললাম এ জন্য যে, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন- পহেলা বৈশাখের সকল প্রকার অনুষ্ঠান বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে। মুখোশ পড়ে কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করত পারবে না। পাশাপাশি সর্বত্র থাকবে সাদা পোষাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। থাকবে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা।

ভালো কথা, জনগণের ভালো চিন্তা করে নিয়েছেন সতর্কতা। কিন্তু বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখেছি, গত বছর যেসব দুষ্কৃতিকারীরা ঢাকার টিএসসিতে আসা নারীদের উপর হামলা করে তারা কেউ মুখোশ পড়া ছিলো না। আজকের দিন পর্যন্ত সেই হামলাকারীদের গ্রেফতার করা হলো না। তাহলে অপরাধ কি যারা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলো তাদের নাকি  পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব হয়তো বলবেন, গতবছরের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় তাই এই বছর বাড়তি সতর্কতা। কিন্তু আপনাদের ব্যর্থতার দায় আমরা নেবো কেনো? কতিপয় দৃস্কৃতিকারীদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার বিপরীতে কোটি কোটি জনগণের প্রাণের উৎসবে টুঁটি চেপে ধরা! এ কেমন সতর্কতা?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন- 'আমরা জানি আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি কিভাবে রক্ষা করতে হয়।' তাই আপনাকে বলছি মাননীয় মন্ত্রী, আপনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি কতিপয় দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে জনগণ জানে তার নিরাপত্তা সে কিভাবে রক্ষা করবে। আপনাদের ব্যর্থতার দায় জনগণ নেবে কেনো?

স্বাধীন বাংলাদেশের চিরাচরিত বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে আপনি বিধিনিষেধ আরোপ করুন। বাংলার স্বাধীনতা ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছিলো 'সুরমা উপত্যকা সাংস্কৃতিক স্কোয়াড', ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পীরা 'মুক্তির গান' নিয়ে ছুটেছেন সারা বাংলাদেশে, ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীরা গড়েছিলেন 'জনতার মঞ্চ'।

আজ যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না, দেশের সংস্কৃতি, স্বাধীনতাকে মানতে চায় না সেই যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি নিয়ে রাজপথে আছে দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক দল ও তাদের কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত 'গণজাগরণ মঞ্চ'।

তাই আবারও বলছি, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পহেলা বৈশাখ নিয়ে আপনার আদেশ, নির্দেশ, আইন সবকিছু জঙ্গিদের মুখে হাসি ফুটানোর কাজটাই করছে।

কারণ ১৭ কোটি জনগণের দেশে জঙ্গি, কুলাঙ্গার, প্রতিক্রিয়াশীল কতজন? অথচ তাদের কাছ থেকে জনগণকে রক্ষার নাম করে বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গলা টিপে ধরা কেনো? এমন ধারা শাসন মানুষ মেনে নেবে না।

বাংলার সংস্কৃতি কারো ভয়ে মাথা নিচু করে থাকেনি কখনো। আজও থাকবে না।

মাননীয় মন্ত্রী, আপনি যদি আপনার বিকেল ৫টার মধ্য পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশনা বহাল রাখেন, তাহলে বুঝবো আপনি বঙ্গবন্ধুর শাশ্বত বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পথ চলতে নয়, বরং প্রতিক্রিয়াশীলদের, বাংলা, বাংলার কৃষ্টি ও হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিরোধীদের দাবি আদায়ে পরোক্ষভাবে সচেষ্ট।

ধিক্কার জানাই, এমন শাসনের আর শাসকের প্রতি, যে আমাদের হাজার বছরের স্বাধীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কতিপয় দুষ্কৃতিকারীদের ভয়ে গুটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি, সিলেট জেলা সংসদ।

এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত