মাসকাওয়াথ আহসান

১৮ মে, ২০১৬ ০৭:২৪

দক্ষিণ এশিয়াই যেন নতুন আফ্রিকা

দক্ষিণ এশিয়ার সমাজের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য দায়ী বিক্ষিপ্ত সামাজিক গতিশীলতা। পুরো সমাজকে একই সঙ্গে শিক্ষিত করে না তুলতে পারলে; জীনগত পরিশুদ্ধিতে এক এক মানুষ এক এক জায়গায় অবস্থান করলে; শিক্ষার মাধ্যমে অধিক পরিশুদ্ধ জীনের মানুষ; অপরিশোধিত জীনের উপমানব দ্বারা আক্রান্ত হতে বাধ্য।

একজন মানুষের হিংস্র জঙ্গল পরিদর্শনে যে ঝুঁকি; দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে শিক্ষিত মানুষের ঠিক একই ঝুঁকি। একারণেই দক্ষিণ এশিয়া থেকে পশ্চিমা বিশ্বে অভিবাসন প্রবণতা বেড়েছে।

যেখানে ক্ষমতা-কাঠামোর প্রতিটি স্তরে অপরিশোধিত জীনের উপমানবেরা বসে আছে; সেখানে বিশুদ্ধ জীনের মানুষ বসবাস করা অসম্ভব। অশিক্ষাগত অপরিশোধিত জীনের শাসন টিকিয়ে রাখাই এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনীতি-ধর্মের মূল উদ্দেশ্য। পশ্চিমে এমনকি দূরপ্রাচ্যের শিক্ষা ও সামাজিক ব্যবস্থায় সত্য-সুন্দর-মঙ্গল-সাম্যের সুষম পরিকল্পনা থাকায়; সেখানে কোন মানুষের মধ্যে স্ট্যাটাস বা পদমর্যাদা সচেতনতা থাকেনা। ওসব এলাকায় মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশ-সেনা কর্মকর্তাকে কেউ "স্যার" বলে ডাকেনা। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে "স্যার" ডাক শুনতে উন্মুখ অপরিশোধিত জীনের উপমানব ক্ষমতা-কাঠামো।

পশ্চিমা দেশে বা দূর প্রাচ্যে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করেনা, আপনি কী করেন! দক্ষিণ এশিয়ার তিন প্রজন্মের শিক্ষিত মানুষেরাও এ প্রশ্ন করে না। কারণ তারা চিন্তার স্তরে এগিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ মানুষ। মানুষ পরিচয়টি তাদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যারা এ প্রশ্ন করে; তারা নিশ্চিতভাবেই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত বা অশিক্ষিত।

সামাজিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে অর্থ-সম্পদকে এগিয়ে যাবার একমাত্র সূচক হিসেবে বেছে নেয়ায় দক্ষিণ এশীয় সমাজে বিপত্তির জায়গাটি আরো ভয়ংকর। উপমানবের হিংস্র হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ তার টাকার গরম। অথচ তৃতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত মানুষের টাকার গরম থাকে না। কারণ এরই মাঝে সে বুঝে গেছে টাকায় কিছু ছিলো না; যা কিছু ছিলো তা শিক্ষায়-সংস্কৃতি চর্চায়। ফলে জীনগত শিক্ষণের মাঝ দিয়ে স্বাভাবিক শিষ্টাচার প্রদর্শনে সক্ষম এরা। যে কোন মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়; সিনিয়র সিটিজেনদের দেখলে ট্রামে-বাসে উঠে দাঁড়িয়ে বসতে দেয়া, পাশাপাশি আসনে শ্রমিক এবং কর্পোরেট ব্যবস্থাপকের সহজাতভাবে বসে গল্প-গুজব চোখে পড়ে সভ্য দুনিয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাটিতে মিশে যাওয়া জার্মানি ও জাপান এই জীনগত শিক্ষণের মাধ্যমে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো অত্যন্ত সফল দুটো দেশ। জাপান-জার্মানির জনগণ যাদের সরকার প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের জায়গাটি পরীক্ষা করলে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের "রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেমন হয় তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

অথচ প্রায় একই সময়ে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়া ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলো রয়ে গেছে "কান-ধরে উঠবস করানো" বর্বরতার লীলাভূমি হিসেবে। কারণ এই উপমহাদেশের দেশগুলোর নতুন পয়সাওয়ালা ও ক্ষমতাওয়ালা মানুষের চোখ-মুখ খুবই গরম হয়ে থাকে। কেমন যেন একটা ক্রুদ্ধ চেহারায় বেগুনী হয়ে ওঠা মুখমণ্ডল। "আগে পিছে দাসী-বান্দি; মাঝে সখিনা" ভিভি আইপি কালচারে টগবগ করে ফুটছে এই অসভ্য জনপদগুলো। ভিভি আইপি সখিনার দাসী-বান্দিরাও ভি আইপিত্বের দাবীদার যেন সর্বত্র। নিজের চিন্তার পাতকুয়ার আয়নায় গোটা পৃথিবীকে দেখে এই ভিভি আই পি ও তার খাদেম ভি আইপি উপমানবগুলো। সুতরাং নিজে যা জীনগতভাবে জানে সেই বদ্ধ চিন্তার অচলায়তন থেকে এসব দেশের ক্ষমতা কাঠামোকে বের করে নিয়ে আসা বেশ কঠিন। জাপান ও জার্মানির শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান অনায়াসে নির্ধারণ করেছে এই অন্ধকার জনপদগুলোর সমাজ-রাজনৈতিক অবনমনের দুর্ভাগ্যজনক নিয়তি। নেতৃত্ব নির্বাচনে অসচেতন সমাজের আত্মঘাতী প্রবণতা বেদনাদায়ক পরিণতির অন্যতম কারণ। সে কারণেই শিক্ষা-হত্যায় মরিয়া হয়ে উঠেছে এই নরভোজী ক্ষমতা-কাঠামো। যাতে অসচেতন জনমানুষ ভোট দিয়ে বার বার নির্বাচিত করে এইসব প্রায় অশিক্ষিত, সাংস্কৃতিক আলোকায়ন বিবর্জিত হিংস্র দখলদার গ্রাম্য মাতবরগুলোকে যাদের পেট ভর্তি ইড-ইগো-সুপার ইগো। বোধের জায়গাটি শূন্য।

এই বেদনাদায়ক সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের যে শিক্ষককে অপমানিত ও চাকরীচ্যুত করা হয়েছে; তাঁর জীনগত উত্তরণের ফলে উনি চিন্তার জগতে এগিয়ে থাকা মানুষ। আর যে বা যারা তাঁকে অপমান করেছে এবং চাকরীচ্যুত করেছে, এদের দুর্বল জীন, নতুন টাকা, মাথায় উপমানব ক্ষমতাগোষ্ঠীর ছাতা। একে বলা যায় নিম্ন জীনের দলবদ্ধতা। এই দখলদার গ্রাম্য মাতবর ও তার খাদেমদের প্রতিহিংসা আসলে "শিক্ষা"-র প্রতি। শিক্ষাহীন একটি অন্ধকার জনপদ জিইয়ে রাখতে সর্বত্রই শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী তথা শিক্ষা আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিদিন। নারায়ণগঞ্জের সম্মানিত শিক্ষককে অসম্মান করে তাঁকে মানসিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই মৃত্যু শারীরিক মৃত্যুর সমার্থক। এটাই চাইছে ক্ষমতা কাঠামো; তারা সমাজকে আলো দেখাবে যারা সেই প্রমিথিউসদের হত্যা করছে প্রতিদিন।

প্রতিটি মানুষ সমান সম্ভাবনার জীন নিয়ে জন্মে। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চার মাঝ দিয়ে মানুষ সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেণী বৈষম্য বজায় থাকায় এবং শিক্ষার মাধ্যমে জীনগত পরিশোধন প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তাকে অযৌক্তিক আবেগ দিয়ে নাকচ করায় সুষম চিন্তা ও শিক্ষার সমাজ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। ফলে সময়ের দাবীতে আফ্রিকার জঙ্গলে আলো জ্বলে উঠলেও দক্ষিণ এশিয়াই হয়ে উঠেছে নতুন আফ্রিকা।এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ; সমাজকে বোঝানো; অর্থ-সম্পদ নয়; শিক্ষাই মানুষ হবার প্রথম ধাপ। শিক্ষাটা এসে পড়লে; অর্থ-সম্পদ নিজেই এসে জড়ো হয়; ও নিয়ে না ভাবলেও চলে। এরপর সাংস্কৃতিক চর্চাকে বিকশিত করলে মনের সংকীর্ণতাগুলো চলে যায়; এসে পড়ে বিনয় ও পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের মনোভঙ্গী। তখন কারো কাছে স্যার ডাক শুনতে ইচ্ছা হয়না; কেউ আমাকে কথিত সম্মান দেখালো কীনা এসব মাথায় আসে না; কারো পেশা ও পোশাক দিয়ে তাকে মাপা বা তুলনামূলক জীবন যাপনের বর্বর বদ-অভ্যাসগুলো চলে যায়।

সুতরাং দৃশ্যমান সামাজিক বর্বরতার জন্য আর কাউকে দোষারোপ করে লাভ নেই। আমাদের মনোযোগ দিতে হবে সমাজ মেরামতিতে। অন্তত: মনোজগতে সাম্যভাবনা শিশুদের মাথায় প্রোথিত করা গেলে; জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুললে; তবেই এই হিংস্র জঙ্গলটিকে আবার মানুষের বসবাস উপযোগী করে তোলা সম্ভব। জীবন একটাই। যে যার অবস্থান থেকে দুর্মর চেষ্টা চালিয়ে যেভাবেই হোক এই ভয়ংকর অন্ধকার সমাজটিকে সুচেতনায় দেদীপ্যমান করে তুলতে হবে। নইলে এই সামষ্টিক নিমজ্জন অর্থহীন করে তুলবে আমাদের ব্যক্তিগত আপাত: অর্জনগুলো।

মাসকাওয়াথ আহসান : সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা শিক্ষক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত